ছিন্নপত্র (১৯১২)/২



সোলাপুর

অক্টোবর

১৮৮৫

 আপনি ত সব্‌-ডেপুটি সাহেব—বন্যার মুখে বাংলা মুল্লুকে ভেসে বেড়াচ্চেন—আমরা কলকাতায় যাচ্চি সে খবর রাখেন কি? এই চিঠি এবং আমরা শুক্রবারের সকালের ডাকে কলিকাতায় বিলি হব। আমাদের প্রবাসের পালা সাঙ্গ করলুম—এখানকার অগাধ আকাশ, অবাধ বাতাস, উদার মাঠ, বিমল শান্তি এসব পশ্চাতে রেখে সেই বাঁশতলার গলি, যোড়াষাঁকোর মোড়, সেই ছেক্‌ড়া গাড়ির আস্তাবল, সেই ধুলো, সেই ঘড়্‌ ঘড়্‌—হুড়্‌ মুড়্‌—হৈ হৈ, সেই মাছি-ভন্‌ভন্‌ ময়রার দোকান, সেই ঘোরতর হিজিবিজি হ-য-ব-র-লর মধ্যে সম্পূর্ণ আত্মবিসর্জ্জন করতে চল্‌লুম। সেখানে তিন হাজার গির্জ্জের চূড়ো, কলের চিমনি, জাহাজের মাস্তুল নীল আকাশে যেন গুঁতো মারতে উঠেচে, কলকাতা তার সমস্ত লোষ্ট্রকাষ্ঠ দিয়ে প্রকৃতিকে গঙ্গা পার করেছে—তার উপরে আবার এক পাঁচিল দেওয়া নিমতলার ঘাট, মানুষের মরেও সুখ নেই। এখানে আমরা ক’জনে মিলে অশোক কাননের নীড়ের মধ্যে ছিল্লুম, সেখানে এক প্রকার ইটের খাঁচার মধ্যে প্রবেশ করতে চল্লুম। সেখানকার সেই লক্ষ লক্ষ কয়েদির সঙ্গে Municipalityর দুর্গের মধ্যে বন্দী হতে চল্লুম। শুনে সুখী হলেন ত?

 এতদিন ভুলে ছিলেম কিন্তু আজ আবার আমার দেই পর্দ্দাটানা ঘোমটা-দেওয়া ঘরটি মনে পড়চে।—কিন্তু কোথায় আপনি, কোথায় আপনার সেই ছাতা, পাপোষশয্যায় শয়ান সেই পুরাতন জুতোযুগল! আমার সেই হৃষ্টপুষ্ট বিরহিনী তাকিয়া—সে কি আমাদের বিরহে রোগা হয়ে গেছে, আমি তাই ভাব্‌চি। আমার বইগুলো কাঁচের অন্তঃপুর থেকে চেয়ে আছে—কিন্তু কার দিকে চেয়ে আছে? আমার শূন্যহৃদয়া চৌকি দিনরাত্রি তার দুই বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু এখন তার এই নীরব আহ্বান কেউ গ্রাহ করে না। আমার সেই ঘড়িটা টিক্‌ টিক্‌ করচে, সে বড় একটা কাউকে খাতির করে না, সে কেবল সময়ের পদচিহ্নের হিসেব রাখ্‌তেই ব্যস্ত।—কিন্তু আমার সেই হার্ম্মোনিয়ম! সে আপনার নীরব সঙ্গীতের উপর বনাত মুড়ি দিয়ে ভাব্‌চে, ঘড়িটা ব্রাকেটের উপরে দাঁড়িয়ে মিছে মিছি তাল দিয়ে মর্‌চে কেন? দেয়ালগুলো তাকিয়ে আছে—ভাব্‌চে ঘরের প্রধান আস্‌বাবটা গেল কোথায়? কলকাতার সেই জনতাসমুদ্রের মধ্যে আমার সেই বিরহান্ধকার ঘরটিই কেবল বিজন। তার সেই রুদ্ধ দ্বারের ভিতর থেকে কাতর স্বর উঠ্‌চে—“রবি বাবু—উ—উ—উ।” রবিবাবু আজ এখান থেকে সাড়া দিচ্চেন—“এই যা—আ—আ—ই।”

 কল্‌কাতায় ফিরে গিয়ে কি আর আপনার সঙ্গে দেখা হতে পারে না? আপনি কি এখন ইহজন্মের মত সব্‌ ডেপুটিপুরে প্রয়ান করলেন? শীঘ্র আর মুক্তির ভরসা নেই? আইনের গলগ্রহ গলায় বেঁধে আপনি কি তা হলে সর্ব্বিস-সরোবরে একরকম ভুব মারলেন? যাক, তা হলে আপনার আশা একেবারে পরিত্যাগ করে আমরা আস্‌মানে বিহার করি আর বলাবলি করি “আহা, শ্রীশ বাবু লোকটা ছিলেন ভাল।”