ছিন্নপত্র (১৯১২)/৩
সাব্ ডেপুটি সা’ব,—
৺গয়াধামে আপনি গমন করেচেন, এখন আমার কি গতি করে গেলেন? আপনার দর্শন আমার নিয়মিত বরাদ্দের মত হয়ে গিয়েছিল এখন তার থেকে বঞ্চিত হয়ে আমি মৌতাতহীন অহিফেন-সেবীর মত ছট্ফট করচি। বাস্তবিক আপনি আমাকে অহিফেনই ধরিয়েছেন বটে। আপনি এসে নানা কৌশলে আমাকে গোটাকতক ছোট ছোট কল্পনার গুলি গেলাতেন, আমার স্বপ্ন জাগিয়ে তুল্তেন, আমাকে আমারই প্রভাতসঙ্গীত সন্ধ্যাসঙ্গীতের মধ্যে আচ্ছন্ন করে ফেল্তেন, আমি চোখ বুজে আনন্দে আমার নিজের মধ্যে প্রবেশ করে বসে থাক্তুম এবং সেইখান থেকে নেশার ঝোঁকে স্বগত উক্তি প্রয়োগ কর্ত্তুম, আপনি শুনে মনে মনে হাস্তেন। আফিমের নেশা একেই বলে। আত্মম্ভরিতার মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে নিজের স্বপ্নে ভোর হওয়াকেই বলে আফিমের নেশা। আপনি সেই নেশাটাই আমাকে অভ্যেস করিয়েচেন। আপনি প্রায় আপনার নিজের কথা বল্তেন না, উল্টে পাল্টে আমারই কবিতা, আমারই লেখা, আমারই কথার মধ্যে আমাকে টেনে নিয়ে ফেল্তেন—আমাকে খুব মাতিয়ে রেখেছিলেন যাহোক্। ইংরেজেরা বর্ম্মায়, চীনে আফিম্ চুকিয়েচে, আপনি আমার সেই অয়েল্ক্লথ্ মণ্ডিত ক্ষুদ্র ঘরটীর মধ্যে গোপনে অলক্ষ্যে আফিমের ব্যবসা প্রবেশ করিয়েচেন—আপনি সহজ লোক্টী নন্। কিন্তু একবার আফিম্ ধরিয়ে আপনি কৌটা সমেত কোথায় অন্তর্ধান হলেন? আমি মৌতাত-বিরহে এই দুরন্ত গ্রীষ্মে একলা ঘরে বসে দুবেলা হাই তুল্চি এবং গা-মোড়া দিচ্চি। নিদেন, আমার দ্বারের পার্শ্বে আপনার সেই পরিচিত ছাতিটা, জুতোটা রেখে গেলেও আমার কথঞ্চিৎ সান্ত্বনা ছিল। আপনার পত্র পাঠে অবগত হলেম্ আপনি শ্রীগয়াধামে আপনার প্রেতপুরীতে মনুষ্যাভাবে নিতান্ত কাতর আছেন, কিন্তু আপনার কাজ আপনার সঙ্গী অর্থাৎ আপনি আছেন এবং আপনার চিরসঙ্গী “সাব্-ডেপুটি” আপনার ছায়ার মত সঙ্গে আছেন॥ সে সঙ্গীকে এখনও আপনার তেমন ভাল লাগচে না কিন্তু ক্রমে তার প্রতি প্রীতি জন্মান কিছু অসম্ভব নয়।
আমি-ব্যক্তির হাতে এখন কোন কাজকর্ম্ম নেই—চাপকানের বোতামগুলো খুলে দেহ এলিয়ে এখন গায়ে বাতাস লাগাচ্চি। সৌভাগ্যক্রমে এখন অহিফেনের ততটা দরকার বোধ হচ্চে না। আমার তাকিয়ার মধ্যে স্বপ্ন পোষা রয়েচে—সেটা এক্টা স্বপ্নের বৃহৎ ডিবের মত বোধ হচ্চে, তার উপরে মাথা রাখলেই মাথার মধ্যে হুহু করে নেশা প্রবেশ করে। এতদিন মাথার উপরে বালক কাগজের বোঝাটা থাকাতেই মাথা যেন রূদ্ধ হয়ে ছিল, নেশা একেবারে ছুটে গিয়েছিল—এখন সমস্ত খোলাসা—দক্ষিণে বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা ষেন চারদিকে উড়ে বেড়াচ্চে।
এ সময়ে আমাকে যদি একটা বাগান দিতে পারতেন। নদীর তীর, গাছের ছায়া, মাঠের বাতাস, আমের বোল, কোকিলের কুহু, বসন্তী রঙের চাদর, বকুল ফুলের মালা, এবং সেই সঙ্গে আপনাকেও চাচ্চি। কল্কাতা সহর, পোলিটিকেল্ এজিটেষন্, বসন্তকালে এ ত সহ্য হয় না। কোথায় আপনার বাগান শ্রীশ বাবু, কোথায় আপনি! সংস্কৃত কবি বলেচেন—
সঙ্গম বিরহ বিকল্পে
বরমপি বিরহো ন সঙ্গমন্তস্যাঃ
সঙ্গে সৈব তথৈকা
ত্রিভুবনমপি তন্ময়ং বিরহে।
ভাবার্থ: “সঙ্গম এবং বিরহের মধ্যে বরং বিরহ ভাল তবু সঙ্গম কিছু না—কারণ মিলনের অবস্থায় সে একা আমার কাছে থাকে মাত্র, আর বিরহাবস্থায় ত্রিভুবন তা’তেই পুরে যায়।” কিন্তু ভট্চার্য্য মশায়ের সঙ্গে আমার মতের মিল হল না—আপনার বিরহে আমার এই রকম মনে হচ্চে যে, ত্রিভুবনময় শ্রীশ বাবুর ঝাঁক থাকার চেয়ে হাতের কাছে এক্টা শ্রীশ বাবু থাকা ভাল। ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে “ঝোপের মধ্যে গণ্ডাখানেক পাখী থাকার চেয়ে মুঠোর মধ্যে একটা পাখী থাকা ঢের ভাল।” এ সম্বন্ধে আমি এই ইংরেজের মত practical view নিয়ে থাকি। আপনি কি বলেন আমি জান্তে ইচ্ছে করি।