ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪
৩০ এপ্রেল
১৮৮৬
ইতিমধ্যে একদিন গো—বাবুদের ওখানে যাওয়া গিয়েছিল। সেখানে আমি আপনার “বাঙ্গালার বসন্তোৎসবের” কথা পাড়লুম, আশ্চর্য্য হলুম, তাঁরাও সকলে একবাক্যে আপনার এই লেখার প্রশংসা করলেন। আশ্চর্য্য হবার কারণ এই যে, ভাল লাগা এক, এবং ভাল বলা এক। ভাল জিনিষ সহজেই ভাল লাগে, তর্কবিতর্ক যুক্তি বিচার করে ভাললাগে না—কিন্তু সমালোচনা করবার সময়ে মনের মধ্যে এমনি তর্কবিচারের প্রাদুর্ভাব হয়, যে, খপ ক’রে একটা জিনিষকে ভাল বলা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, যে লেখাটা পড়লুম সেটা লিখচে কে, তাতে আছে ক, তাতে নূতন কথা বলা হয়েচে কি, এই রকম লেখাকে সমালোচকেরা কি বলে থাকে, এ কোন্ শ্রেণীর অন্তর্গত ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং তার পরে দেখতে দেখতে দলে দলে “যদি” “কিন্তু” “কি জানি” “হয় ত” প্রভৃতি সহস্র রক্তশোষকের আমদানী হয়। তাঁরা চতুর্দ্দিকে তিন ক্রোশের মধ্যে রসকস কিছুই অবশিষ্ট রাখেন না। “ভাল লাগা” জিনিষটি এম্নি কোমল সুকুমার যে, ভাল লেগেছে কি না এই সহজ সত্যটুকু ঘটা করে প্রমাণ কর্ত্তে বস্লে সে ব্যক্তি যায়-যায় হয়ে ওঠে। সমালোচকেরা আপনার বিরুদ্ধে আপনি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে থাকে, ভাল লাগলেও তারা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করে দেয় যে ভাল লাগেনি। এই গেল সমালোচনতত্ত্ব। যাহোক্, আপনার বহিটা শেষ হয়ে গেলে সাধারণ পাঠকদের কি রকম লাগে জানতে ইচ্ছে রইল। হয়ত বা ভাল লাগতেও পারে। ভাল লাগবার একটা কারণ এই দেখচি, আপনি আপনার কেতাবের মধ্যে আমাদের চিরপরিচিত বাংলাদেশের একটি সজীব মূর্ত্তি জাগ্রত করে তুলেচেন, বাংলার আর কোন লেখক এতে কৃতকার্য্য হন নি। এখনকার অধিকাংশ বাংলা বই পড়ে আমার এই মনে হয় যে, আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের সময় বাংলাদেশই ছিল কি না ভবিষ্যতে এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে। আপনি হয় ত শুনে থাকবেন কোনো মার্কিন দেশীয় ভাষাতত্ত্ববিদ্ বলেন, পাণিনি যে ভাষার ব্যাকরণ, সে ভাষাই কোনকালে ছিল না—তিনি দেখেছেন পাণিনিতে এমন অনেক ধাতু প্রভৃতি পাওয়া যায় সমস্ত সংস্কৃত ভাষায় যা খুঁজলে মেলে না। এইরূপ নানা কারণে তিনি ঠিক করে রেখেচেন যে পাণিনি ব্যাকরণটি এমন একটি ঘোড়ার ডিম যা কোন ঘোড়ায় পাড়েনি। অনেক ভাষা আছে যার ব্যাকরণ এখনও তৈরি হয়নি কিন্তু কে জান্ত এমন ব্যাকরণ আছে যার ভাষা তৈরি হয় নি? এই ঘটনায় আমার মনে হয়েছে ভবিষ্যতে এমন একজন তত্ত্বজ্ঞের প্রাদুর্ভাব হতে পারে, যিনি নিঃসংশয়ে প্রমাণ করে দিতে পারবেন, যে, বাংলা সাহিত্য যে দেশের সাহিত্য সে দেশ মূলেই ছিল না—তখন বঙ্কিম বাবুর এত সাধের “সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং,” পুরাতত্ত্বের গবেষণার তোড়ে কোথায় ভেসে যাবে! পণ্ডিতেরা বল্বেন, বঙ্গসাহিত্য একটা কলেজের সাহিত্য, এটা দশের সাহিত্য নয় কিন্তু সে কলেজটা ছিল কোথায় এ বিষয়ে কিছুই মীমাংসা হবে না। আপনার সেই লেখাটির মধ্যে বাংলাদেশের সন্ধান পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের পূর্ব্ববিভাগের জিওগ্রাফির প্রতি বিশ্বাস জন্মায়। আপনার সেই লেখার মধ্যে অধিকাংশ স্থলে বাংলার ছেলেমেয়েরা কালেজি কথা কয় না ও কালেজি কাজ করে না, তারা প্রতিদিন গৃহের মধ্যে যে রকম কথা কয় ও যে রকম কাজ করে তাই দেখতে পাওয়া যায়। অন্য কারো অথবা ক্ষুদ্র আমার লেখায় সেইটি হবার যো নেই। কিন্তু আপনাকে আর অহঙ্কৃত করা হবে না, অতএব এখানেই সমালোচনায় ক্ষান্ত হলুম।