ছিন্নপত্র (১৯১২)/৫
আপনার চিঠি এইমাত্র পেলুম, বেলা দশটা বেজে গেছে। বাহিরে অসহ্য উত্তাপ আমাদের ঘরের সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ—অন্ধকার—মাথার উপরে পাখা আনা-গোনা করচে; আর্দ্র খস্খস্ ভেদ করে প্রচণ্ড পশ্চিম পবন শীতল ভাবে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করচে। ঘরের মধ্যে এক রকম আছি ভাল। সেই পুরাতন ডেক্সের উপর ঝুঁকে পড়ে চিঠি লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি। আপনার ফুলজানি আমি পূর্ব্বেই ভারতীতে পড়েছি এবং পড়েই আপনাকে একটা চিঠি লিখব মনে করেছিলুম। তার পরে ভাবলুম আপনি একেই ত চিঠির উত্তর বহু বিলম্বে দেন তার পর যদি বিনা উত্তরেই চিঠি লিখি তবে আপনাকে অত্যন্ত আস্কারা দেওয়া হয়। এ রকম ব্যবহার পেলে বন্ধুদের স্বভাব খারাপ হয়ে যায়। তাই নিবৃত্ত হলুম। আপনার লেখা আমার ভারি ভাল লাগে। ওর মধ্যে কোন রকম নভেলি মিথ্যা ছায়া নেই। আর এমন একটি ছবি মনে এনে দেয় যা আমাদের দেশের কোন লেখকের লেখাতে দেয় না। আপনি কোন রকম ঐতিহাসিক বা ঔপদেশিক বিড়ম্বনায় যাবেন না—সরল মানবহৃদয়ের মধ্যে যে গভীরতা আছে—এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখদুঃখপূর্ণ মানবের দৈনন্দিন জীবনের যে চিরানন্দময় ইতিহাস তাই আপনি দেখাবেন। শীতল ছায়া, আম কাঁঠালের বন, পুকুরের পাড়, কোকিলের ডাক, শান্তিময় প্রভাত এবং সন্ধ্যা এরি মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে, তরল কলধ্বনি তুলে, বিরহ মিলন হাসি কান্না নিয়ে যে মানব-জীবনস্রোত অবিশ্রান্ত প্রবাহিত হচ্চে তাই আপনি আপনার ছবির মধ্যে আনবেন। প্রকৃতির শান্তির মধ্যে, স্নিগ্ধচ্ছায়া শ্যামল নীড়ের মধ্যে যে সব ছোট ছোট হৃদয়ের ব্যাকুলতা বাস করচে দয়েল কোকিল বউকথাকওয়ের গানের সঙ্গে মানবহৃদয়ের যে সকল আকাঙ্ক্ষাধ্বনি মিশ্রিত হয়ে অবিশ্রাম আকাশের দিকে উঠছে আপনার লেখার মধ্যে সেই ছবি এবং সেই গান মেশাবেন। কোন রকম জটিলতা বা চরিত্রবিশ্লেষণ বা দুর্দ্দান্ত অসাধারণ হৃদয়াবেগ এনে স্বচ্ছ মধুর শান্তিময় ঘটনাস্রোতকে ঘোলা করে তুল্বেন না। আমার বিশ্বাস, আপনি যদি অধিক ফলাও কাণ্ড না করেন তাহলে বাংলার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসলেখকের সঙ্গে সমান আসন পেতে পারবেন। বাংলার অন্তর্দেশবাসী নিতান্ত বাঙালীদের সুখদুঃখের কথা এ পর্য্যন্ত কেহই বলেন নি—আপনার উপর সেই ভার রইল। বঙ্কিম বাবু ঊনবিংশ শতাব্দীর পোষ্যপুত্র আধুনিক বাঙালীর কথা যেখানে বলেছেন সেখানে কৃতকার্য্য হয়েছেন, কিন্তু যেখানে পুরাতন বাঙালীর কথা বল্তে গিয়েছেন সেখানে তাঁকে অনেক বানাতে হয়েছে; চন্দ্রশেখর প্রতাপ প্রভৃতি কতকগুলি বড় বড় মানুষ এঁকেছেন (অর্থাৎ তাঁরা সকল দেশীয় সকল জাতীয় লোকই হতে পারতেন, তাঁদের মধ্যে জাতি এবং দেশকালের বিশেষ চিহ্ন নেই) কিন্তু বাঙালী আঁক্তে পারেন নি। আমাদের এই চিরপীড়িত, ধৈর্য্যশীল, স্বজনবৎসল বাস্তুভিটাবলম্বী প্রচণ্ডকর্ম্মশীল-পৃথিবীর এক নিভৃতপ্রান্তবাসী শান্ত বাঙালীর কাহিনী কেউ ভাল করে বলে নি।