চুহালি।
জলপথে; ১৬ই জুন, ১৮৯১।

 এখন পাল তুলে যমুনার মধ্যে দিয়ে চলেছি। আমার বাঁ ধারে মাঠে গরু চরচে—দক্ষিণ ধারে একেবারে কুল দেখা যাচ্চে না। নদীর তীব্র স্রোতে তীর থেকে ক্রমাগতই ঝুপ্‌ঝুপ্ করে মাটি খসে পড়ছে। আশ্চর্য্য এই, এত বড় প্রকাণ্ড এই নদীটার মধ্যে আমাদের বোট ছাড়া আর দ্বিতীয় একটি নৌকা দেখা যাচ্চে না—চারি দিকে জলরাশি ক্রমাগতই ছল্ ছল্ খল্‌ খল্‌ শব্দ করছে—আর বাতাসের হু হু শব্দ শোনা যাচ্চে। কাল সন্ধের সময় একটা চরের উপর বোট লাগিয়েছিলুম—নদীটি ছোট্ট— যমুনার একটি শাখা—একপারে বহুদূর পর্য্যন্ত শাদা বালি ধূ ধূ করছে, জনমানবের সম্পর্ক নেই, আরএক পারে সবুজ শস্যক্ষেত্র এবং বহুদূরে একটি গ্রাম। আর কত বার বল্‌ব,—এই নদীর উপরে, মাঠের উপরে, গ্রামের উপরে সন্ধ্যাটা কি চমৎকার— কি প্রকাণ্ড, কি প্রশান্ত, কি অগাধ; সে কেবল স্তব্ধ হয়ে অনুভব করা যায় কিন্তু ব্যক্ত করতে গেলেই চঞ্চল হয়ে উঠ্‌তে হয়। ক্রমে যখন অন্ধকারে সমস্ত অস্পষ্ট হয়ে এল, কেবল জলের রেখা এবং তটের রেখায় একটা প্রভেদ দেখা যাচ্ছিল—এবং গাছপালা কুটীর সমস্ত একাকার হয়ে একটা ঝাপ্‌সা জগৎ চোখের সাম্‌নে বিস্তৃত পড়ে ছিল—তখন ঠিক মনে হচ্ছিল এ সমস্ত যেন ছেলেবেলাকার রূপকথার অপরূপ জগৎ—যখন এই বৈজ্ঞানিক জগৎ সম্পূর্ণ গঠিত হয়ে ওঠেনি—অল্পদিন হল সৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে—প্রদোষের অন্ধকারে এবং একটি ভীতি বিস্ময়পূর্ণ ছম্ ছম্ নিস্তব্ধতায় সমস্ত বিশ্ব আচ্ছন্ন—যখন সাত সমুদ্র তেরোনদীর পারে মায়াপুরে পরমাসুন্দরী রাজকন্যা চিরনিদ্রায় নিদ্রিত—যখন রাজপুত্র এবং পাত্তরের পুত্র তেপান্তরের মাঠে একটা অসম্ভব উদ্দেশ্য নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্চে—এ যেন তখনকার সেই অতি সুদূরবর্ত্তী অর্দ্ধ-অচেতনায় মোহাচ্ছন্ন মায়ামিশ্রিত বিস্মৃত জগতের একটি নিস্তব্ধ নদীতীর এবং মনে করা যেতেও পারে আমি সেই রাজপুত্র—একটা অসম্ভবের প্রত্যাশায় সন্ধ্যারাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি—এই ছোট নদীটি সেই তেরোনদীর মধ্যে একটা নদী এখনো সাত সমুদ্র বাকি আছে—এখনো অনেক দূর, অনেক ঘটনা, অনেক অন্বেষণ বাকি; এখনো কত অজ্ঞাত নদীতীরে কত অপরিচিত সমুদ্রসীমার কত ক্ষীণ চন্দ্রালোকিত অনাগত রাত্রি অপেক্ষা করে আছে—তার পরে হয়ত অনেক ভ্রমণ, অনেক রোদন, অনেক বেদনের পর হঠাৎ একদিন, আমার কথাটি ফুরোলো নটে শাকটি মুড়োলো—হঠাৎ মনে হবে এতক্ষণ একটা গল্প বল্‌ছিলুম—এখন গল্প ফুরিয়েচে এখন অনেক রাত্রি, এখন ছোট ছেলের ঘুমোবার সময়।