চুহালি।
১৯শে জুন, ১৮৯১।

 কাল পনেরো মিনিট বাইরে বস্‌তে না বস্‌তে পশ্চিমে ভয়ানক মেঘ করে। এল খুব কালো, গাঢ় আলুথালুরকমের মেঘ, তারি মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে উঠেছে। দুটোএকটা নৌকা তাড়াতাড়ি যমুনা থেকে এই ছোট নদীর মধ্যে প্রবেশ করে দড়িদড়া নোঙর দিয়ে মাটি আঁক্‌ড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বস্‌ল। যারা মাঠে শস্য কাট্‌তে এসেছিল তারা মাথায় একএক বোঝা শস্য নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে চলেছে, গরুও ছুটেচে, তার পিছনে পিছনে বাছুর লেজ নেড়েনেড়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়বার চেষ্টা করচে। খানিকবাদে একটা আক্রোশের গর্জ্জন শোনা গেল; কতকগুলো ছিন্নভিন্ন মেঘ ভগ্নদূতের মত সুদূর পশ্চিম থেকে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটে এল—তারপরে বিদ্যুৎ বজ্র ঝড় বৃষ্টি সমস্ত একসঙ্গে এসে পড়ে খুব একটা তুর্কি নাচন নাচ্‌তে আরম্ভ করে দিলে— বাঁশ গাছগুলো হাউ হাউ শব্দে একবার পূর্ব্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে লুটিয়ে পড়তে লাগ্‌ল—ঝড় যেন সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মত বাঁশি বাজাতে লাগ্‌ল আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের মত ফণা তুলে তালেতালে নৃত্য আরম্ভ করে দিলে। কালকের সে যে কি কাণ্ড সে আর কি বল্‌ব। বজ্রের যে শব্দ সে আর থামে না— আকাশের কোন্‌খানে যেন একটা আস্ত জগৎ ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্চে। বোটের খোলা জানলার উপর মুখ রেখে প্রকৃতির সেই রুদ্রতালে আমিও বসেবসে মনটাকে দোলা দিচ্ছিলুম। সমস্ত মনের ভিতরটা যেন ছুটি পাওয়া স্কুলের ছেলের মত বাইরে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল। শেষকালে বৃষ্টির ছাঁটে যখন বেশ একটু আর্দ্র হয়ে ওঠা গেল তখন জান্‌লা এবং কবিত্ব বন্ধ করে খাঁচার পাথীর মত অন্ধকারে চুপচাপ বসে রইলুম।