ছিন্নপত্র (১৯১২)/২৫
সাজাদপুর।
জলপথে ২০শে জুন, ১৮৯১।
কাল টেলিগ্রামের উত্তর পেয়ে আমাদের সমস্ত কাজ সেরে সন্ধ্যার সময় নৌকো ছেড়ে দিলুম। আকাশে মেঘ ছিল না—চাঁদ উঠেছিল—অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছিল— ঝুপ্ঝুপ্ দাঁড় ফেলে স্রোতের মুখে ছোট নদীটির মধ্যে ভেসে যাওয়া যাচ্ছিল। চারিদিক পরি-স্থান বলে মনে হচ্ছিল। সে সময়ে অন্যান্য সমস্ত নৌকো ডাঙায় কাছি বেঁধে পাল গুটিয়ে চন্দ্রালোকে স্তব্ধ হয়ে নিদ্রা দিচ্ছিল। অবশেষে ছোট নদীটা যেখানে যমুনার মধ্যে গিয়ে পড়েচে তারি কাছে একটা খুব নিরাপদ স্থানে গিয়ে নৌকো বাঁধ্লে। কিন্তু নিরাপদ স্থানের অনেক দোষ; হাওয়া পাওয়া যায় না— ঝুপ্সির ভিতরে অন্যান্য নৌকোর কাছে—জঙ্গলের গন্ধ ইত্যাদি—আমি মাঝিকে বল্লুম-এপারে হাওয়া পাওয়া যাবে না, ওপারে চল্। ওপারে উঁচু পাড় নাই; জলে স্থলে সমান—এমন কি ধানের ক্ষেতের উপর এক হাঁটু জল উঠেচে। মাঝি সেইখানেই নৌকো নিয়ে বাঁধ্লে। তখন আমাদের পিছনদিকের আকাশে একটু বিদ্যুৎ চিক্মিক্ করতে আরম্ভ করেচে। আমি বিছানায় ঢুকে জান্লার কাছে মুখ রেখে ক্ষেতের দিকে চেয়ে আছি এমন সময় রব ঊঠ্ল—ঝড় আস্চে। কাছি ফেল্, নোঙর ফেল্, এ কর, সে কর, করতে করতে এক প্রলয় ঝড় ছুটে এল। মাঝি থেকে থেকে বল্তে লাগ্ল—ভয় কোরোনা ভাই আল্লার নাম কর আল্লা মালেক। থেকে থেকে সকলে আল্লা আল্লা করতে লাগ্ল। আমাদের বোটের দুই পাশের পরদা বাতাসে আছাড় খেয়ে খেয়ে শব্দ করতে লাগ্ল, আমাদের বোটটা যেন একটা শিকলিবাঁধা পাখীর মত পাখা ঝাপ্টে ঝট্ পট্ ঝট্পট করছিল—ঝড়টা থেকে থেকে চীহি চীহি শব্দ করে একটা বিপর্য্যয় চিলের মত হঠাৎ এসে পড়ে বোটের ঝুঁটি ধরে ছোঁ মেরে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চায়—বোটটা অমনি সশব্দে ধড়ফড় করে ওঠে। অনেকক্ষণ বাদে বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে ঝড় থেমে গেল। আমি হাওয়া খেতে চেয়েছিলুম—হাওয়াটা কিছু বেশী খাইয়ে দিলে—একেবারে আশাতিরিক্ত। যেন কে ঠাট্টা করে বলে যাচ্ছিল—এইবার পেট ভরে হাওয়া খেয়ে নাও, তারপরে সাধ মিট্লে কিঞ্চিৎ জল খাওয়াব—তাতে এমনি পেট ভরবে যে ভবিষ্যতে আর কিছু খেতে হবে না। আমরা কি না প্রকৃতির নাতি সম্পর্ক, তাই তিনি মধ্যেমধ্যে এইরকম একটুআধটু তামাসা করে থাকেন। আমি ত পূর্ব্বেই বলেছি জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রূপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত—কারণ, যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে তেমন গ্রহণ করতে পারে না। এই মনে কর, দুপুর রাত্রে খাটে শুয়ে আছি, হঠাৎ পৃথিবীটা ধরে এমনি নাড়া দিলে যে কে কোথায় পালাবে পথ পায় না—মৎলবটা খুব নতুন রকমের এবং মজাটা খুব আকস্মিক তার আর সন্দেহ নেই—বড় বড় সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের অর্দ্ধেক রাত্রে উর্দ্ধশ্বাসে অসম্বৃত অবস্থায় বিছানার বাইরে দৌড় করানো কি কম কৌতুক! এবং দুটো একটা সদ্যনিদ্রোথ্থিত হতবুদ্ধি নিরীহ লোকের মাথার উপরে বাড়ির আস্ত ছাতটা ভেঙে আনা কি কম ঠাট্টা! হতভাগ্য লোকটা যেদিন ব্যাঙ্কে চেক্ লিখে রাজমিস্ত্রির বিল শোধ করছিল, রহস্যপ্রিয়া প্রকৃতি সেইদিন বসে বসে কত হেসেছিল।