সাজাদপুর,
২২শে জুন, ১৮৯১ ।

 আজকাল আমার এখানে এমন চমৎকার জ্যোৎস্না রাত্রি হয় সে আর কি বল্‌ব। অবশ্য যে ঠিকানায় এ চিঠি গিয়ে পৌঁছবে সেখানেও যে জ্যোৎস্নারাত্রি হয় না তা বলা আমার অভিপ্রায় নয়। স্বীকার করতেই হবে সেখানে সেই ময়দানের উপর, সেই গির্জ্জের চূড়ার উপর, সম্মুখের নিস্তব্ধ গাছপালার উপর ধীরে ধীরে জ্যোৎস্না আপনার নীরব অধিকার বিস্তার করে কিন্তু সেখানে জ্যোৎস্না ছাড়াও অন্য পাঁচটা বস্তু আছে—কিন্তু আমার এই নিস্তব্ধ রাত্রি ছাড়া আর কিছুই নেই। একলা বসে বসে আমি যে এর ভিতরে কি অনন্ত শান্তি এবং সৌন্দর্য্য দেখতে পাই সে আর ব্যক্ত করতে পারিনে। একদল আছে তারা ছট্‌ফট্ করে, জগতের সকল কথা জান্‌তে পারচিনে কেন—আর একদল ছট্‌ফটিয়ে মরে মনের সকল ভাব প্রকাশ করতে পারচিনে কেন—মাঝের থেকে জগতের কথা জগতেই থেকে যায় এবং অন্তরের কথা অন্তৱেই থাকে। মাথাটা জান্‌লার উপর রেখে দিই, বাতাস প্রকৃতির স্নেহহস্তের মত আস্তে আস্তে আমার চুলের মধ্যে আঙুল বুলিয়ে দেয়, জল ছল্‌ছল্‌ শব্দ করে বয়ে যায়, জ্যোৎস্না ঝিক্ ঝিক্ করতে থাকে এবং অনেক সময় “জলে নয়ন আপনি ভেসে যায়।” অনেক সময় মনের আন্তরিক অভিমান, একটু স্নেহের স্বর শুন্‌লেই অমনি অশ্রুজলে ফেটে পড়ে;—এই অপরিতৃপ্ত জীবনের জন্যে প্রকৃতির উপর আমাদের যে আজন্মকালের অভিমান আছে, যখনি প্রকৃতি স্নেহমধুর হয়ে ওঠে তখনি সেই অভিমান, অশ্রুজল হয়ে, নিঃশব্দে ঝরে পড়তে থাকে—তখন প্রকৃতি আরো বেশি করে আদর করে, এবং তার বুকের মধ্যে অধিকতর আবেগের সহিত মুখ লুকোই।