সাজাদপুর,
২৩শে জুন, ১৮৯১।

 আজকাল দুপুর বেলাটা বেশ লাগে। রৌদ্রে চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে থাকে— মনটা ভারি উড়ু উু করে, বই হাতে নিয়ে আর পড়তে ইচ্ছে করে না। তীরে যেখানে নৌকো বাঁধা আছে সেইখানথেকে একরকম ঘাসের গন্ধ এবং থেকে থেকে পৃথিবীর একটা গরম ভাপ্ গায়ের উপরে এসে লাগতে থাকে—মনে হয় এই জীবন্ত উত্তপ্ত ধরণী আমার খুব নিকটে থেকে নিশ্বাস ফেল্‌চে—বোধ করি আমারো নিশ্বাস তার গায়ে গিয়ে লাগ্‌চে। ছোট ছোট ধানের গাছগুলো বাতাসে ক্রমাগত কাঁপ্‌চে— পাঁতিহাস জলের মধ্যে নেবে ক্রমাগত মাথা ডুবচ্চে এবং চঞ্চু দিয়ে পিঠের পালক সাফ কর্‌চে। আর কোন শব্দ নেই, কেবল জলের বেগে বোটটা যখন ধীরে ধীরে বেঁকতে থাকে তখন কাছিটা এবং বোটের সিঁড়িটা এক রকম করুণ মৃদু শব্দ করতে থাকে। অনতিদূরে একটা খেয়াঘাট আছে। বটগাছের তলায় নানাবিধ লোক জড় হয়ে নৌকোর জন্যে অপেক্ষা কর্‌চে—নৌকো আসবামাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়চে—অনেকক্ষণ ধরে এই নৌকোপারাপার দেখ্‌তে বেশ লাগে। ওপারে হাট; তাই খেয়া নৌকায় এত ভীড়। কেউবা ঘাসের বোঝা, কেউবা একটা চুপ্‌ড়ি, কেউবা একটা বস্তা কাঁধে করে হাটে যাচ্চে এবং হাট থেকে ফিরে আস্‌চে—ছোট নদীটি এবং দুই পারের দুই ছোট গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় এই একটুখানি কাজকর্ম্ম, মনুষ্যজীবনের এই একটুখানি স্রোত, অতি ধীরে ধীরে চল্‌চে। আমি বসে বসে ভাব্‌ছিলুম, আমাদের দেশের মাঠ ঘাট আকাশ রোদ্দুরের মধ্যে এমন একটা সুগভীর বিষাদের ভাব কেন লেগে আছে? তার কারণ এই মনে হল আমাদের দেশে প্রকৃতিটা সব চেয়ে বেশি চোখে পড়ে—আকাশ মেঘমুক্ত, মাঠের সীমা নেই, রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ করচে, এর মধ্যে মানুষকে অতি সামান্য মনে হয়— মানুষ আস্‌চে এবং যাচ্চে—এই খেয়ানৌকার মত পারাপার হচ্চে— তাদের অল্প অল্প কলরব শোনা যায়, এই সংসারের হাটে ছোটখাট সুখদুঃখের চেষ্টার একটুখানি আনাগোনা দেখা যায়,—কিন্তু এই অনন্তপ্রসারিত প্রকান্ড উদাসীন প্রকৃতির মধ্যে সেই মৃদু গুঞ্জন, সেই একটু আধ্‌টু গীতধ্বনি, সেই নিশিদিন কাজকৰ্ম্ম কি সামান্য, কি ক্ষণস্থায়ী, কি নিস্ফল কাতরতাপূর্ণ মনে হয়। এই নিশ্চেষ্ট, নিস্তব্ধ, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্দেশ প্রকৃতির মধ্যে এমন একটি বৃহৎ সৌন্দৰ্য্যপূর্ণ নিৰ্ব্বিকার উদার শান্তি দেখ্‌তে পাওয়া যায় এবং তারি তুলনায় আপনার মধ্যে এমন একটা সততসচেষ্ট পীড়িত জর্জ্জরিত ক্ষুদ্র নিত্যনৈমিত্তিক অশান্তি দেখতে পাওয়া যায় যে ঐ অতিদূর নদীতীরের ছায়াময় নীল বনরেখার দিকে চেয়ে নিতান্ত উন্মনা হয়ে যেতে হয় । “ছায়াতে বসিয়া সারা দিনমান তরুমৰ্ম্মর পবনে” ইত্যাদি । যেখানে মেঘে কুয়াশায় বরফে অন্ধকারে প্রকৃতি আচ্ছন্ন সঙ্কুচিত, সেখানে মানুষের খুব কর্তৃত্ব— মানুষ সেখানে আপনার সকল ইচ্ছা সকল চেষ্টাকে চিরস্থায়ী মনে করে—আপনার সকল কাজকে চিহ্নিত করে রেখে দেয়—পষ্টারিটির দিকে তাকায়, কীৰ্ত্তিস্তম্ভ তৈরি করে, জীবনচরিত লেখে, এবং মৃতদেহের উপরেও পাষাণের চিরস্মরণগৃহ নিৰ্ম্মাণ করে—তারপরে অনেক চিহ্ন ভেঙে যায় এবং অনেক নাম বিস্মৃত হয় কিন্তু সময়াভাবে সেটা কারো খেয়ালে আসে না ।