ছিন্নপত্র (১৯১২)/২৮
বিকেলবেলায় আমি এখানকার গ্রামের ঘাটের উপরে বোট লাগাই। অনেকগুলো ছেলে মিলে খেলা করে, বসে বসে দেখি। কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে নিশিদিন যে পদাতিক সৈন্য লেগে থাকে তাদের জ্বালায় আর আমার মনে সুখ নেই। ছেলেদের খেলা তারা বেআদবী মনে করে; মাঝিরা যদি আপনাদের মধ্যে মন খুলে হাসি গল্প করে সেটা তারা রাজার প্রতি অসম্মান জ্ঞান করে; চাষারা যদি ঘাটে গরুকে জল খাওয়াতে নিয়ে আসে তারা তৎক্ষণাৎ লাঠি হাতে করে রাজমর্য্যাদা রক্ষা করতে ধাবিত হয়। অর্থাৎ রাজার চতুর্দ্দিকটা হাসিহীন খেলাহীন শব্দহীন জনহীন ভীষণ মরুভূমি করতে পারলে তাদের মনের মত রাজসম্ভ্রম রক্ষা হয়। কালও তারা ছেলেদের তাড়া করতে উদ্যত হয়েছিল, আমি আমার রাজমর্য্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে তাদের নিবারণ করলুম। ঘটনাটা হচ্চে এই—
ডাঙার উপর একটা মস্ত নৌকার মাস্তুল পড়ে ছিল— গোটা কতক বিবস্ত্র ক্ষুদে ছেলে মিলে অনেক বিবেচনার পর ঠাওরালে, যে যদি যথোচিত কলরবসহকারে সেইটেকে ঠেলে ঠেলে গড়ান যেতে পারে তাহলে খুব একটা নতুন এবং আমোদজনক খেলার সৃষ্টি হয়। যেমন মনে আসা, অমনি কার্য্যারম্ভ, “সাবাস্ জোয়ান্—হেঁইয়ো! মারো ঠেলা হেঁইয়ো!” মাস্তুল যেমনি একপাক ঘুরছে অমনি সকলের আনন্দে উচ্চহাস্য। কিন্তু এই ছেলেদের মধ্যে যে দুটিএকটি মেয়ে আছে, তাদের ভাব আরএকরকম। সঙ্গীঅভাবে ছেলেদের সঙ্গে মিশ্তে বাধ্য হয়েচে কিন্তু এই সকল শ্রমসাধ্য উৎকট খেলায় তাদের মনের যোগ নেই। একটি ছোট মেয়ে বিনাবাক্যব্যয়ে গম্ভীরপ্রশান্তভাবে সেই মাস্তুলটার উপর গিয়ে চেপে বস্ল। ছেলেদের এমন সাধের খেলা মাটি। দুইএকজন ভাব্লে এমনস্থলে হারমানাই ভাল; তফাতে গিয়ে তারা ম্লানমুখে সেই মেয়েটির অটল গাম্ভীর্য্য নিরীক্ষণ করতে লাগ্ল। ওদের মধ্যে একজন এসে পরীক্ষাচ্ছ্বলে মেয়েটাকে এক্টু এক্টু ঠেল্তে চেষ্টা করলে। কিন্তু সে নীরবে নিশ্চিন্ত মনে বিশ্রাম করতে লাগ্ল। সর্ব্বজ্যেষ্ঠ ছেলেটি এসে তাকে বিশ্রামের জন্যে অন্য স্থান নির্দ্দেশ করে দিলে, সে তাতে সতেজে মাথা নেড়ে কোলের উপর দুটি হাত জড় করে নড়েচড়ে আবার বেশ গুছিয়ে বস্ল—তখন সেই ছেলেটা শারীরিক যুক্তি প্রয়োগ করতে আরম্ভ করলে এবং অবিলম্বে কৃতকার্য্য হল। আবার অভ্রভেদী আনন্দধ্বনি উঠ্ল, পুনর্ব্বার মাস্তুল গড়াতে লাগ্ল—এমনকি, খানিকক্ষণ বাদে মেয়েটাও তার নারীগৌরব এবং সুমহৎ নিশ্চেষ্ট স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করে কৃত্রিম উৎসাহের সঙ্গে ছেলেদের এই অর্থহীন চপলতায় যোগ দিলে। কিন্তু বেশ বোঝা যাচ্ছিল সে মনে মনে বলছিল—ছেলেরা খেলা করতে জানে না, কেবল যতরাজ্যের ছেলেমানুষী। হাতের কাছে যদি একটা খোঁপাওয়ালা হল্দে রঙের মাটির বেনে পুতুল থাক্ত তাহলে কি সে আর এই অপরিণতবুদ্ধি নিতান্ত শিশুদের সঙ্গে মাস্তুল ঠেলার মত এমনএকটা বাজে খেলায় যোগ দিত! এমনসময় আরএকরকমের খেলা তাদের মনে এল, সেটাও খুব মজার। দুজন ছেলেতে মিলে একটা ছেলের হাত পা ধরে ঝুলিয়ে তাকে দোলা দেবে। এর ভিতরে খুব একটা রহস্য আছে সন্দেহ নেই— কারণ, ছেলেরা বেজায় উৎফুল্ল হয়ে উঠ্ল। কিন্তু মেয়েটার পক্ষে অসহ্য হল। সে অবজ্ঞাভরে ক্রীড়াক্ষেত্র ত্যাগ করে ঘরে চলে গেল। হঠাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘট্ল। যাকে দোলাচ্ছিল সে গেল পড়ে। সেই অভিমানে সে সঙ্গীদের ত্যাগ করে বহুদূরে গিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে তৃণশয্যায় শুয়ে পড়ল—ভাবে এই রকম জানালে— এই পাষাণহৃদয় জগৎসংসারের সঙ্গে সে আর কোন সম্পর্ক রাখ্বেনা, কেবল এক্লা চীৎ হয়ে শুয়ে আকাশের তারা গণনা করবে, মেঘের খেলা দেখে হাতে মাথা রেখে জীবন কাটিয়ে দেবে এবং “যাবত জীবন রবে কারো সঙ্গে খেলিব না।” তার এই রকম অকালে পরম বৈরাগ্য দেখে বড় ছেলেটা তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে কোলের উপর তার মাথাটা নিয়ে সামুনয়স্বরে অনুতাপ প্রকাশ করে বল্তে লাগ্ল, আয় না ভাই, ওঠ্ না ভাই লেগেছে ভাই! অনতিকাল পরেই দুই কুকুরশাবকের মত দুজনের হাতকাড়াকাড়ি খেলা বেধে গেল—এবং দুমিনিট না যেতে দেখি সেই ছেলে ফের দুল্তে আরম্ভ করেছে! এম্নি মানুষের প্রতিজ্ঞা! এম্নি তার মনের বল! এমনি তার বুদ্ধির স্থিরতা! খেলা ছেড়ে একবার দূরে গিয়ে চীৎ হয়ে শোয়, আবার ধরা দিয়ে হেসে হেসে মোহদোলায় দুল্তে থাকে। এ মানুষের মুক্তি কি করে হবে! এমন ক’জন ছেলে আছে যে খেলাঘর ছেড়ে মাথায় হাত দিয়ে কেবল চীৎ হয়ে পড়ে থাকে—সেই সব ভালছেলেদের জন্যে গোলোকধামে বাসা তৈরি হচ্চে।