ছিন্নপত্র (১৯১২)/২৯
সাজাদপুর,।
জুন, ১৮৯১।
কাল রাত্রে ভারি একটা অদ্ভূত স্বপ্ন দেখেছিলুম। সমস্ত কলকাতা সহরটা যেন মহা একটা ভীষণ অথচ আশ্চর্য্য ভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে—বাড়িঘর সমস্তই একটা অন্ধকার কালে কুয়াশার ভিতরথেকে দেখাযাচ্চে—এবং তার ভিতর তুমুল কি একটা কাণ্ড চল্চে। আমি একটা ভাড়াটে গাড়ি করে পার্কষ্ট্রীটের ভিতর দিয়ে যাচ্চি। যেতেযেতে দেখলুম সেণ্ট জেভিয়ার কলেজটা দেখতেদেখতে হুহু করে বেড়ে উঠ্চে—সেই অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে অসম্ভব উঁচু হয়ে উঠ্চে। তারপরে ক্রমে জানতে পারলুম একদল অদ্ভূত লোক এসেচে তারা টাকা পেলে কি এক কৌশলে এইরকম অপূর্ব্ব ব্যাপার করতে পারে। যোড়াসাঁকোর বাড়ি এসে দেখি সেখেনেও তারা এসেচে; বদ্ দেখ্তে, কতকটা মোঙ্গোলিয়ান্ ধাঁচের চেহারা—সরু গোঁপ, গোটা দশ বারো দাড়ি মুখের এদিকেওদিকে খোঁচাখোঁচা রকম বেরিয়েচে। তারা মানুষকেও বড় করে দিতে পারে। তাই আমাদের দেউড়িতে আমাদের বাড়ির সব মেয়েরা লম্বা হবার জন্যে উমেদার হয়েচেন—তারা এঁদের মাথায় কি একটা গুঁড়ো দিচ্চে আর এঁরা হুস করে লম্বা হয়ে উঠ্চেন। আমি কেবলি বল্চি, কি আশ্চর্য্য, এ যেন ঠিক স্বপ্নের মত মনে হচ্চে। তার পরে, কে একজন প্রস্তাব করলে আমাদের বাড়িটা উঁচু করে দিতে। তারা রাজি হয়ে বাড়ি কতকটা ভাঙতে আরম্ভ করলে, খানিকটা ভেঙেচুরে বলে, এইবার এত টাকা চাই নইলে বাড়িতে হাত দেবনা, কুঞ্জসরকার বল্লে সে কি হয়; কাজ না হয়ে গেলে কি করে টাকা দেওয়া যায়। বল্তেই তারা চটে উঠল—বাড়িটা সমস্তই একরকম বেঁকে চুরে বিশ্রী হয়ে গেল এবং মাঝেমাঝে দেখা গেল, আধখানা মানুষ দেয়ালের মধ্যে গাঁথা রয়েছে, আধখান বেরিয়ে। সমস্ত দেখেশুনে মনে হল এ সব সয়তানী কান্ড। বড়দাদাকে বল্লুম “বড়দা, দেখ্চেন ব্যাপারটা। আসুন একবার উপাসনা করা যাক্।” দালানে গিয়ে খুব একাগ্রমনে উপাসন করা গেল। বেরিয়ে এসে মনে করলুম ঈশ্বরের নাম করে তাদের ভর্ৎসনা করব—কিন্তু বুক ফেটে যেতে লাগ্ল তবু গলা দিয়ে কথা বেরোল না। তারপর কখন্ জেগে উঠ্লুম ঠিক মনে পড়চেনা। ভারি অদ্ভুত স্বপ্ন না? সমস্ত কল্কাতাসহরে সয়তানের প্রাদুর্ভাব; সবাই তার সাহায্যে বেড়ে ওঠার চেষ্টা করছে, একটা অন্ধকার নারকী কুজ্ঝটিকার মধ্যে সমস্ত সহরের ভয়ঙ্কর শ্রীবৃদ্ধি হচ্চে। কিন্তু ওর মধ্যে একটু পরিহাসও ছিল—এত দেশ থাক্তে জেসুইয়িট্দের ইস্কুলটার উপরেই সয়তানের এত অনুগ্রহ কেন?
তারপরে এখানকার স্কুলের মাষ্টারেরা দর্শনাভিলাষী হয়ে এসে উপস্থিত। তাঁরা কিছুতেই উঠ্তে চান না, অথচ আমার আবার তেমন কথা জোগায় না—পাঁচ মিনিট অন্তর দুইএক কথা জিজ্ঞাসা করি; তার এক আধটা উত্তর পাই, তার পরে বোকার মত বসে থাকি, কলম নাড়ি, মাথা চুল্কোই—জিজ্ঞাসা করি এবার এখানে শস্য কি রকম হয়েছে—স্কুলমাস্টাররা শস্যসম্বন্ধে কিছুই জানেন না—ছাত্রসম্বন্ধে যা কিছু জ্ঞাতব্য বিষয় তা আরম্ভেই হয়েগেছে; ফের আবার গোড়ার কথা পাড়লুম, জিজ্ঞাসা করলুম আপনাদের স্কুলে কজন ছাত্র? একজন বল্লেন আশি জন, আর একজন বল্লেন না একশ পচাত্তর জন। মনে করলুম দুজনের মধ্যে খুব একটা তর্ক বেধে যাবে, কিন্তু দেখ্লুম, তৎক্ষণাৎ মতের ঐক্য হয়ে গেল। তারপরে দেড় ঘণ্টা পরে কেন যে তাঁদের মনে পড়ল আজ তবে আসি তা ঠিক বোঝা শক্ত—আর এক ঘণ্টা পূর্ব্বেও মনে হতে পারত, আর বারো ঘণ্টা পরেও মনে হতে পারত। দেখা যাচ্চে এর ভিতরে কোন একটা নিয়ম নেই, অন্ধ দৈবঘটনা মাত্র।