ছিন্নপত্র (১৯১২)/৩৫
শিলাইদহ,
১লা অক্টোবর, ১৮৯১।
বেলায় উঠে দেখ্লুম চমৎকার রোদ্দুর উঠেছে এবং শরতের পরিপূর্ণ নদীর জল তল্ তল্ থৈ থৈ করচে। নদীর জল এবং তীর প্রায় সমতল— ধানের ক্ষেত সুন্দর সবুজ এবং গ্রামের গাছপালাগুলি বর্ষাবসানে সতেজ এবং নিবিড় হয়েউঠেছে। এমন সুন্দর লাগ্ল সে আর কি বল্ব। দুপুরবেলা খুব এক পস্লা বৃষ্টি হয়েগেল। তার পরে বিকেলে পদ্মার ধারে আমাদের নারকেল বনের মধ্যে সূর্য্যাস্ত হ’ল। আমি নদীর ধারে উঠে আস্তেআস্তে বেড়াচ্ছিলুম। আমার সাম্নের দিকে দূরে আমবাগানে সন্ধ্যার ছায়া পড়েআস্চে এবং আমার ফেরবার মুখে নারকেল গাছগুলির পিছনে আকাশ সোনায় সোনালী হয়ে উঠেছে। পৃথিবী যে কি আশ্চর্য সুন্দরী এবং কি প্রশস্তপ্রাণে এবং গভীরভাবে পরিপূর্ণতা এইখানে না এলে মনে পড়ে না। যখন সন্ধ্যাবেলা বোটের উপর চুপকরে বসেথাকি, জল স্তব্ধ থাকে, তীর আবছায়া হয়ে আসে, এবং আকাশের প্রান্তে সূর্যাস্তের দীপ্তি ক্রমেক্রমে ম্লান হয়েযায়, তখন আমার সর্ব্বাঙ্গে এবং সমস্ত মনের উপর নিস্তব্ধ নতনেত্র প্রকৃতির কি একটা বৃহৎ উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভবকরি! কি শান্তি, কি স্নেহ, কি মহত্ত্ব, কি অসীম করুণাপূর্ণ বিষাদ! এই লোকনিলয় শস্যক্ষেত্রথেকে ঐ নির্জ্জন নক্ষত্রলোকপর্য্যন্ত একটা স্তম্ভিত হৃদয়রাশিতে আকাশ কানায়কানার পরিপূর্ণ হয়েওঠে; আমি তার মধ্যে অবগাহনকরে অসীম মানসলোকে একলা বসেথাকি, কেবল মৌলবীটা পাশে দাঁড়িয়ে অবিশ্রাম বক্ বক্ করে আমাকে ব্যথিত করেতোলে।