শিলাইদহ,
অক্টোবর, ১৮৯১।

 আজ দিনটি বেশ হয়েছে। ঘাটে দুটি একটি করে নৌকো লাগ্‌চে—বিদেশথেকে প্রবাসীরা পুজোর ছুটিতে পোঁট্‌লাপুঁট্‌লি বাক্স ধামা বোঝাইকরে নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে সম্বৎসরপরে বাড়ি ফিরে আস্‌চে। দেখ্‌লুম একটি বাবু ঘাটের কাছাকাছি নৌকো আস্‌তেই পুরোণো কাপড় বদ্‌লে একটি নুতন কোঁচানো ধূতি পরলে, জামার উপর শাদা রেসমের একখানি চায়নাকোট্ গায়ে দিলে, আরএকখানি পাকানো চাদর বহুযত্নে কাঁধের উপর ঝুলিয়ে ছাতা ঘাড়েকরে গ্রামের অভিমুখে চল্ল। ধানের ক্ষেত থরথরকরে কাঁপ্‌চে—আকাশে শাদাশাদা মেঘের স্তূপ—তারি উপর আম এবং নারকেল গাছের মাথা উঠেচে— নারকেলের পাতা বাতাসে ঝুর্‌ঝুর্‌ করচে—চরের উপর দুটো একটা করে কাশ ফুটে উঠ্‌বার উপক্রমকরেচে— সবসুদ্ধ বেশ একটা সুখের দৃশ্য। বিদেশথেকে যে লোকটি এইমাত্র গ্রামে ফিরেএল, তার মনের ভাব, তার ঘরের লোকদের মিলনের আগ্রহ, এবং শরৎকালের এই আকাশ, এই পৃথিবী, সকাল বেলাকার এই ঝির্‌ঝিরে বাতাস, এবং গাছপালা তৃণগুল্ম নদীর তরঙ্গসকলের ভিতরকার একটি অবিশ্রাম সঘন কম্পন, সমস্ত মিশিয়ে বাতায়নবর্ত্তী এই একক যুবকটিকে সুখেদুঃখে একরকম অভিভূত করে ফেল্‌ছিল। পৃথিবীতে জান্‌লার ধারে এক্‌লা বসে চোখ মেলে’ দেখ্‌লেই মনে নতুন সাধ জন্মায়—নতুন সাধ ঠিক নয়, পুরোণো সাধ নানা নতুন মূর্ত্তি ধারণকরতে আরম্ভকরে। পর্শুদিন অমনি বোটের জান্‌লার কাছে চুপ করে বসেআছি—একটা জেলেডিঙিতে একজন মাঝি গান গাইতেগাইতে চলে গেল—খুব যে সুস্বর তা নয়। হঠাৎ মনে পড়েগেল বহুকাল হল ছেলেবেলায় বোটেকরে পদ্মায় আস্‌ছিলুম—একদিন রাত্তির প্রায় দুটোর সময় ঘুম ভেঙে যেতেই বোটের জান্‌লাটা তুলেধরে মুখবাড়িয়ে দেখ্‌লুম নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না হয়েছে, একটি ছোট্ট ডিঙিতে একজন ছোক্‌রা একলা দাঁড়বেয়ে চলেছে, এমনি মিষ্টি গলায় গানধরেছে—গান তার পূর্ব্বে তেমন মিষ্টি কখনো শুনিনি। হঠাৎ মনে হল, আবার যদি জীবনটা ঠিক সেইদিনথেকে ফিরে পাই। আর একবার পরীক্ষাকরে দেখাযায়—এবার তাকে আর শুষ্ক অপরিতৃপ্ত করে ফেলেরেখে দিইনে—কবির গান গলায় নিয়ে একটি ছিপ্‌ছিপে ডিঙিতে জোয়ারের বেলায় পৃথিবীতে ভেসেপড়ি, গান গাই এবং বশ করি এবং দেখেআসি পৃথিবীতে কোথায় কি আছে; আপনাকেও একবার জানান্‌ দিই, অন্যকেও একবার জানি; জীবনে যৌবনে উচ্ছ্বসিতহয়ে বাতাসের মত একবার হু হু করে বেড়িয়ে আসি, তারপরে ঘরে ফিরেএসে পরিপূর্ণ প্রফুল্ল বার্দ্ধক্যটা কবির মত কাটাই। খুব যে একটা উঁচু আইডিয়াল তা নয়। জগতের হিত করা এর চেয়ে ঢের বেশি বড় আইডিয়াল হতেপারে—কিন্তু আমি সবসুদ্ধ যেরকম লোক আমার ওটা মনেও উদয় হয় না। উপবাস করে, আকাশের দিকে তাকিয়ে অনিদ্র থেকে সর্ব্বদা মনেমনে বিতর্ককরে, পৃথিবীকে এবং মনুষ্যহৃদয়কে কথায়কথায় বঞ্চিতকরে স্বেচ্ছারচিত দুর্ভিক্ষে এই দুর্লভ জীবন ত্যাগকরতে চাইনে। পৃথিবী যে সৃষ্টিকর্ত্তার একটা ফাঁকি এবং সয়তানের একটা ফাঁদ তা না মনেকরে এ’কে বিশ্বাসকরে, ভালবেসে ভালবাসাপেয়ে মানুষের মত বেঁচে এবং মানুষের মত মরেগেলেই যথেষ্ট;—দেবতার মত হাওয়া হয়েযাবার চেষ্টাকরা আমার কাজ নয়।