শিলাইদহ,
অক্টোবর, ১৮৯১। ২৯ শে আশ্বিন।

 কাল সন্ধ্যার সময় নদীর ধারে একবার পশ্চিমদিকের সোনার সূর্য্যাস্ত এবং একবার পূবদিকের রুপোর চন্দ্রোদয়ের দিকে ফিরে গোঁফে তা দিতেদিতে পায়চারীকরে বেড়াচ্ছিলুম। রুগ্ন ছেলের দিকে মা যেমনকরে তাকায় প্রকৃতি সেইরকম সুগভীর স্তব্ধ এবং স্নিগ্ধ বিষাদের সঙ্গে আমার মুখের দিকে চেয়েছিল—নদীর জল আকাশের মত স্থির, এবং আমাদের দুটি বাঁধা নৌকো জলচরপাখীর মত মুখের উপর পাখা ঝেঁপে স্থিরভাবে ঘুমিয়েআছে এমন সময় মৌলবী এসে আমাকে ভীতকণ্ঠে চুপি চুপি খবর দিলে “কলকাতার ভজিয়া আয়ছে।” এক মুহূর্ত্তের মধ্যে কতরকম অসম্ভব আশঙ্কা যে মনে উদয় হল তা আর বল্‌তেপারিনে। যাহোক মনের চাঞ্চল্য দমনকরে গম্ভীর স্থিরভাবে আমার রাজচৌকিতে এসে বসে ভজিয়াকে ডেকে পাঠালুম। ভজিয়া যখন ঘরে প্রবেশকরেই কাঁদুনির সুর ধরে আমার পা জড়িয়েধরলে তখনি বুঝলুম দুর্ঘটনা যদি কারো হয়েথাকে ত সে ভজিয়ার। তার পরে তার সেই বাঁকা বাঙলার সঙ্গে নাকের সুর এবং চোখের জল মিশিয়ে বিস্তর অসংলগ্ন ঘটনা বলে যেতে লাগ্‌ল। বহু কষ্টে তার যা সার সংগ্রহকরা গেল সেটি হচ্চে এই—ভজিয়া এবং ভজিয়ার মায়ে প্রায়ই ঝগড়া বেধেথাকে—কিছুই আশ্চর্য্য নয়—কারণ দুজনেই আমাদের পশ্চিম আর্য্যাবর্ত্তের বীরাঙ্গনা, কেউ হৃদয়ের কোমলতার জন্যে প্রসিদ্ধ নয়। এর মধ্যে একদিন সন্ধ্যাবেলায় মায়ে ঝিয়ে মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি বেধেগিয়েছিল-স্নেহালাপ থেকে যে আলিঙ্গন তা নয়, গালাগালি থেকে মারামারি। সেই বাহুযুদ্ধে তার মায়েরই পতন হয়—এবং সে কিছু গুরুতর আহতও হয়েছিল। ভজিয়া বলে, তার মা তাকে একটা কাঁসার বাটি নিয়ে মস্তক লক্ষ্যকরে তাড়াকরে, সে আত্মরক্ষার চেষ্টাকরাতে দৈবাৎ তার বালাটা তার মায়ের মাথায় না কোথায় লেগে রক্তপাত হয়। যাহোক্ এইসব ব্যাপারে সেই মুহূর্ত্তেই তাকে তেতালা থেকে নিম্নলোকে নির্ব্বাসিতকরে দেওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা তিনচার দিন হয়েচে কিন্তু আমি কোন খবরই পাইনি—মাথার উপরে একেবারে হঠাৎ বিনা নোটিসে ভজিয়াঘাত।