শিলাইদহ,
অক্টোবর, ১৮৯১। ২রা কার্তিক।

 আমার বোধহয় কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে এলেই মানুষের নিজের স্থায়িত্ব এবং মহত্ত্বের উপর বিশ্বাস অনেকটা হ্রাস হয়ে আসে। এখানে মানুষ কম এবং পৃথিবীটাই বেশি—চারিদিকে এমন সব জিনিষ দেখাযায় যা আজ তৈরিকরে কাল মেরামতকরে পর্শু দিন বিক্রিকরে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্মমৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়েআছে, প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াতকরচে এবং চিরকাল অবিশ্রান্তভাবে প্রবাহিত হচ্চে। পাড়াগায়ে এলে আমি মানুষকে স্বতন্ত্র মানুষভাবে দেখিনে। যেমন নানা দেশদিয়ে নদী চলেচে, মানুষের স্রোতও তেম্‌নি কলরবসহকারে গাছপালা গ্রাম নগরের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চিরকালধরে চলেচে—এ আর ফুরোয় না। মেন্‌ মে কাম্ এণ্ড, মেন্‌ মে গো, বাট্, আই গো অন্ ফর্ এভার্‌—কথাটা ঠিক সঙ্গত নয়। মানুষও নানা শাখাপ্রশাখা নিয়ে নদীর মতই চলেচে-তার এক প্রান্ত জন্মশিখরে আরএক প্রান্ত মরণসাগরে, দুই দিকে দুই অন্ধকার রহস্য, মাঝখানে বিচিত্র লীলা এবং কর্ম্ম এবং কলধ্বনি—কোনকালে এর আর শেষ নেই। ওই শোন মাঠে চাষা গান গাচ্চে, জেলেডিঙি ভেসেচলেচে, বেলা যাচ্চে, রৌদ্র ক্রমেই বেড়ে উঠ্‌চে— ঘাটে কেউ স্নানকরচে কেউ জল নিয়ে যাচ্চে—এমনি করে এই শান্তিময়ী নদীর দুই তীরে গ্রামের মধ্যে গাছের ছায়ায় শতশত বৎসর গুন্‌গুন্‌ শব্দ করতেকরতে ছুটে চলেচে—এবং সকলের মধ্যে থেকে একটা করুণধ্বনি জেগে উঠ্‌চে, আই গো অন্ ফর্ এভার্‌। দুপুরবেলার নিস্তব্ধতার মধ্যে যখন কোন রাখাল দূরথেকে উর্দ্ধকণ্ঠে তার সঙ্গীকে ডাকদেয়, এবং একটা নৌকো ছপ্‌ছপ্ শব্দকরে ঘরের দিকে ফিরেযায়, এবং মেয়েরা ঘড়াদিয়ে জল ঠেলেদেয় তারি ছল্‌ ছল্‌ শব্দ ওঠে, তার সঙ্গে মধ্যাহ্ন‌ প্রকৃতির নানারকম অনির্দ্দিষ্ট ধ্বনি—দুই একটা পাখীর ডাক, মৌমাছির গুন্ গুন্ বাতাসে বোটটা আস্তেআস্তে বেঁকে যেতে থাকে তারই একরকম কাতর সুর—সবসুদ্ধ এমন একটা করুণ ঘুমপাড়ানী গান—যেন মা সমস্ত বেলা বসেবসে তার ব্যথিত ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ভুলিয়েরাখ্‌বার চেষ্টাকরচে—বল্‌চে, আর ভাবিস্‌নে, আর কাঁদিস্‌নে, আর কাড়াকাড়ি মারামারি করিস্‌নে, আর তর্কবিতর্ক রাখ্‌—একটুখানি ভুলেথাক্‌ একটুখানি ঘুমো; বলে তপ্ত কপালে আস্তে আস্তে করাঘাতকরচে।