ছিন্নপত্র (১৯১২)/৩৯
শিলাইদহ,
সোমবার, ৩রা কার্ত্তিক।
কোজাগর পূর্ণিমার দিন, নদীর ধারেধারে আস্তেআস্তে বেড়াচ্ছিলুম—আর, মনের মধ্যে স্বগত কথোপকথন চল্ছিল—ঠিক “কথোপকথন” বলাযায় না—বোধ হয় আমি এক্লাই বকেযাচ্ছিলুম আর আমার সেই কাল্পনিক সঙ্গীটি অগত্যা চুপচাপ করে শুনেযাচ্ছিল, নিজের হয়ে একটা জবাবদেওয়াও সে বেচারার যো ছিল না—আমি তার মুখে যদি একটা নিতান্ত অসঙ্গত কথাও বসিয়েদিতুম তাহলেও তার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু কি চমৎকার হয়েছিল কি আর বল্ব! কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে একটি রেখামাত্র ছিল না—ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষপ্রান্ত দেখাযাচ্চে সেখানথেকে আর এপর্য্যন্ত একটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ঝিক্করচে—একটি লোক নেই একটি নৌকো নেই, ওপারের নতুন চরে একটি গাছ নেই একটি তৃণ নেই—মনেহয় যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয়হচ্চে—জনশূন্য জগতের মাঝখানদিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহেচলেছে, মস্তএকটা পুরাতন গল্প এই পরিত্যক্তপৃথিবীর উপরে শেষহয়ে গেছে, আজ সেই সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই গল্পের “তেপান্তরের মাঠ” এবং “সাত সমুদ্র তেরো নদী” ম্লান জ্যোৎস্নায় ধূ ধূ করচে।
আমি যেন সেই মুমূর্ষু পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মত আস্তেআস্তে চল্ছিলুম। আরসকলে ছিল আর এক পারে, জীবনের পারে—সেখানে এই বৃটিশ গবর্মেণ্ট্, এবং ঊনবিংশ শতাব্দী এবং চা এবং চুরোট। কতদিনথেকে কত লোক আমার মত এইরকম একলা দাঁড়িয়ে অনুভবকরেচে এবং কত কবি প্রকাশকরতে চেষ্টাকরেচে, কিন্তু হে অনির্ব্বচনীয়, এ কি, এ কিসের জন্যে, এ কিসের উদ্বেগ, এই নিরুদ্দেশ নিরাকুলতার নাম কি, অর্থ কি— হৃদয়ের ঠিক মাঝখানটা বিদীর্ণকরে কবে সেই সুর বেরোবে যার দ্বারা এর সঙ্গীত ঠিক ব্যক্ত হবে!