ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪৩

 শিলাইদহ, 
৭ই এপ্রেল, ১৮৯২। 

 সকাল থেকে সুন্দর বাতাস দিচ্চে—কোন কাজ করতে ইচ্ছে করচে না। বোধ হয় এগারোটা কিম্বা সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে—কিন্তু এ পর্য্যন্ত লেখা পড়া কিম্বা কোন কাজে হাত দিইনি। সকাল থেকে একটি চৌকিতে স্থির হয়ে বসে আছি। মাথার মধ্যে কত টুকরো টুক্‌রো লাইন এবং কত অসমাপ্ত ভাব যাতায়াত করছে, কিন্তু সেগুলোকে একত্র করে বাঁধি কিম্বা পরিস্ফুট করে তুলি এমন শক্তি অনুভব করচিনে। সেই গানটা মনে পড়ছে “পায়েরিয়া বাজে, ঝনক ঝনক ঝন ঝন নন নন নন” সুন্দর সকালবেলায় মধুর বাতাসে নদীর মাঝখানে মাথার মধ্যে সেইরকম ঝন নন নূপুর বাজ্‌চে—কিন্তু সে কেবল এদিক ওদিক থেকে অন্তরালে—কেউ ধরা দিচ্চে না, দেখা দিচ্চে না। তাই চুপচাপ করে বসে আছি। নদীর জল অনেকটা শুকিয়ে এসেচে, কোথাও এক কোমরের বেশি জল আর প্রায় নেই—তাই বোটটাকে নদীর প্রায় মাঝখানে বেঁধে রাখা কিছুই শক্ত হয়নি। আমার ডানদিকের পারে চরের উপরে চাষারা চাষ করচে এবং মাঝে মাঝে গোরুকে জল খাইয়ে নিয়ে যাচ্ছে—আমার বামপারে শিলাইদহের নারকেল এবং আমবাগান, ঘাটে মেয়েরা কাপড় কাচ্‌চে, জল তুলচে, স্নান করচে এবং উচ্চৈস্বরে বাঙাল ভাষায় হাস্যালাপ করচে—যারা অল্পবয়সী মেয়ে তাদের জলক্রীড়া আর শেষ হয় না। একবার স্নান সেরে উপরে উঠ্‌চে আবার ঝুপ্‌ করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়চে—তাদের নিশ্চিন্ত উচ্চহাস্য শুন্‌তে বেশ লাগে। পুরুষরা গম্ভীরভাবে এসে গোটাকতক ডুব মেরে তাদের নিত্যকর্ম্ম সমাপ্ত করে চলে যায়— কিন্তু মেয়েদের যেন জলের সঙ্গে বেশি ভাব। পরস্পরের যেন একটা সাদৃশ্য এবং সখিত্ব আছে—জল এবং মেয়ে উভয়েই বেশ সহজে ছল্‌ ছল্‌ জ্বল্ জ্বল্ করতে থাকে, একটা বেশ সহজ গতি ছন্দ তরঙ্গ, দুঃখতাপে অল্পে অল্পে শুকিয়ে যেতে পারে কিন্তু আঘাতে একেবারে জন্মের মত দু’খানা হয়ে ভেঙে যায় না। সমস্ত কঠিন পৃথিবীকে সে বাহুবন্ধনে আলিঙ্গন করে আছে, পৃথিবী তার অন্তরের গভীর রহস্য বুঝতে পারে না; সে নিজে শস্য উৎপাদন করে না কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে না থাক্‌লে পৃথিবীতে একটি ঘাসও গজাতে পারত না। মেয়েকে পুরুষের সঙ্গে তুলনা করে টেনিসন্‌ বলেচেন, Water unto wine—আমার আজকার মনে হচ্চে জল unto স্থল। তাইজন্যে মেয়েতে ও জলেতে বেশ মিশখায়—অন্য অনেকরকম ভারবহন মেয়েকে শোভা পায় না, কিন্তু উৎসথেকে কুয়োথেকে ঘাটথেকে জল তুলে নিয়েযাওয়া কোনকালেই মেয়েদের পক্ষে অসঙ্গত মনে হয় না। গা ধোয় স্নানকরা, পুকুরের ঘাটে এককোমর জলে বসে পরস্পর গল্পকরা, এসমস্ত মেয়েদের পক্ষে কেমন শোভন। আমি দেখেছি মেয়েরা জল ভালবাসে কেননা উভয়ে স্বজাত। অবিশ্রাম সহজপ্রবাহ এবং কলধ্বনি জল এবং মেয়ে ছাড়া আর কারো নেই। ইচ্ছে করলে আরো অনেক সাদৃশ্য দেখান যেতে পারত, কিন্তু বেলাও বোধকরি অনেক হয়েচে, এবং একটা কথা ফেনিয়ে বেশি নেংড়ানো কিছু নয়।