ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪২

শিলাইদহ,
বৃহস্পতিবার, ৯ই জানুয়ারী,
১৮৯২।

 দুইএকদিনথেকে এখানকার প্রকৃতি শীত এবং বসন্তের মধ্যে ইতস্ততঃকরচে— সকালে হয়ত উত্তরেবাতাসে জলেস্থলে হী হী ধরিয়েদিয়ে গেল—সন্ধ্যাবেলায় শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নার দক্ষিণেবাতাসে চারিদিক হূ হূ করে উঠ্‌ল। বসন্ত অনেকটা এসে পৌঁচেছে বেশ বোঝাযাচ্চে। অনেকদিনপরে আজকাল ওপারের বাগানথেকে একটা পাপিয়া ডাক্‌তে আরম্ভকরেচে। মানুষের মনটাও কতকটা বিচলিতহয়ে উঠচে—আজকাল সন্ধ্যা হলে ওপারের গ্রামথেকে গানবাজনার শব্দ শুন্‌তেপাওয়া যায়—এর থেকে বোঝা যাচ্চে, লোকে দরজা জান্‌লা বন্ধকরে মুড়িশুড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়বার জন্যে তেমন উৎসুক নয়। আজ পূর্ণিমারাত—ঠিক আমার বাঁ-দিকের খোলা জান্‌লার উপরেই একটা মস্ত চাঁদ উঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে— বোধহয় দেখ্‌চে আমি চিঠিতে তারসম্বন্ধে কোন নিন্দে করচি কিনা—সে হয়ত মনে করে, তার জ্যোৎস্নার চেয়ে তার কলঙ্কের কথা নিয়েই পৃথিবীর লোকে বেশি কানাকানি করে। নিস্তব্ধ চরে একটা টিটি পাখী ডাক্‌চে—নদী স্থির—নৌকো নেই, জলের উপর স্থির ছায়া ফেলে’ ওপারের ঘনীভূত বন স্তম্ভিত হয়ে রয়েচে—ঘুমন্ত চোখ খোলা থাক্‌লে যেমন দেখতে হয়, এই প্রকাণ্ড পূর্ণিমার আকাশ সেইরকম ঈষৎ ঝাপ্‌সা দেখাচ্চে। কাল সন্ধ্যা থেকে আবার ক্রমেক্রমে অন্ধকারের সূত্রপাত হবে, কাল কাছারী সেরে এই ছোট নদীটি পার হবার সময় দেখ্‌তে পাব আমার সঙ্গে আমার এই প্রবাসের প্রণয়িনীর একটুখানি বিচ্ছেদ হয়েচে, কাল যে আমার কাছে আপনার রহস্যময় অপার হৃদয় উদ্ঘাটন করে দিয়েছিল আজ তার মনে যেন একটু সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে, যেন তার মনেহচ্চে একেবারে এতখানি আত্মপ্রকাশ কি ভাল হয়েছিল, তাই হৃদয় আবার একটু একটু করে বন্ধ করচে। বাস্তবিক বিদেশে বিজন অবস্থায় প্রকৃতি বড় কাছাকাছির জিনিষ আমি সত্যসত্য দু’তিনদিন ধরে মাঝে মাঝে ভেবেচি, পূর্ণিমার পরদিন থেকে আমি আর এ জ্যোৎস্না পাব না—আমি যেন বিদেশ থেকে আরো একটু বিদেশে চলে যাব, কাজকর্ম্মের পরে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় যে একটি শান্তিময় পরিচিত সৌন্দর্য্য আমার জন্যে নদীতীরে অপেক্ষা করে থাক্‌ত সে আর থাক্‌বে না—অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে বোটে ফিরে আস্‌তে হবে।

 কিন্তু আজ পূর্ণিমা, এ বৎসরকার বসন্তের এই প্রথম পূর্ণিমা, এর কথাটা লিখে রেখে দিলুম—হয়ত অনেকদিন পরে এই নিস্তব্ধ রাত্রিটি মনে পড়বে—ঐ টি ট পাখীর ডাকসুব্ধ এবং ওপারের ঐ বাঁধা নৌকোয় যে আলোটি জল্‌চে সেটিসুব্ধ; এই একটুখানি উজ্জ্বল নদীর রেখা, ঐ একটুখানি অন্ধকার বনের একটা পোঁচ্‌, এবং ঐ নির্লিপ্ত উদাসীন পাণ্ডুবর্ণ আকাশ।