ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪১

শিলাইদহ,
সোমবার, ৬ই জানুয়ারী,
১৮৯২।

 সন্ধ্যা হয়ে গেছে। গরমের সময় যখন বোটে ছিলুম, এই সময়টা বোটের জান্‌লার কাছে বসে আলো নিবিয়ে দিয়ে চুপচাপ পড়েথাক্‌তুম, নদীর শব্দে, সন্ধ্যার বাতাসে, নক্ষত্রভরা আকাশের নিস্তব্ধতায় মনের সমস্ত কল্পনা মধুর আকার ধরে আমাকে ঘিরে বস্‌ত অনেক রাতপর্য্যন্ত একপ্রকার নিবিড় নির্জ্জন আনন্দে কেটেযেত। শীতকালের সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত প্রকৃতিকে বাইরে ফেলে জান্‌লাদরজা বন্ধ করে বোটের এই ক্ষুদ্র কাষ্ঠময় গহ্বরের মধ্যে একটি বাতি জ্বেলে মনটাকে তেমন দৌড় দিতেপারিনে— যেন নিজের সঙ্গে নিজেকে বড় বেশি ঘেঁসাঘেঁসি ঠাসাঠাসি করে থাকতেহয়। এরকম অবস্থায় আপনার মনটিকে নিয়েথাকা বড় শক্ত।

 সাহিত্যের মধ্যে দুটিমাত্র গল্পের বই এনেছিলুম, কিন্তু এমনি আমার পোড়া কপাল, আজ বিদায়নেবার সময় সাহেবের মেম সেই দুটি বই ধারনিয়ে গেছেন, কবে শোধ করবেন তার কোন ঠিকানা নেই। সেই দুটো হাতে তুলেনিয়ে সলজ্জ কাকুতির ভাবে আরম্ভকরলেন “মিষ্টার টাগোর, বূড ইয়ু”—কথাটা শেষ করতে না করতে আমি খুব সজোরে ঘাড়নেড়ে বল্লুম “সার্টেন্‌লি!” এতে কতটা দূর কি বোঝায় ঠিক বল্‌তে পারিনে। আসলে, তাঁরা তখন বিদায়নিচ্ছিলেন সেই উৎসাহে আমি আমার অর্দ্ধেক রাজত্ব দিয়েফেলতে পারতুম (যে পেত তার যে খুব বেশি লাভহত তা নয়।) যাহোক্ তারা আজ গেছে—আমার এই দুটোদিন একেবারে ঘুলিয়েদিয়ে গেছে—আবার থিতিয়েনিতে দুদিন যাবে—মেজাজটা এমনি খারাপ হয়েআছে যে ভয়েভয়ে আছি পাছে কাউকে অন্যায় অকারণে তাড়নাকরে উঠি—এত বেশি সাবধানে আছি যে সহজ অবস্থায় যখন একজনকে ধমক দিতুম এখন তাকে খুব নরমনরমকরে বল্‌চি—মেজাজ বিগড়েগেলে অনেকসময় আমার এইরকম উল্টোরকম ব্যাপার হয়—সে সময়ে ছেলেরা কাছে থাক্‌লে ভয়হয় পাছে তাদের লঘুদোষে গুরুদণ্ড দিই, এইজন্যে তাদের দণ্ডই দিইনে—খুব দৃঢ় করে সহিষ্ণুতা অবলম্বনকরে থাকি।