ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪৯
১৬ই জ্যৈষ্ঠ;
১৮৯২।
এখানে রাত্রে কোন গির্জ্জের ঘড়িতে ঘণ্টা বাজে না—এবং কাছাকাছি কোন লোকালয় না থাকাতে পাখীরা গান বন্ধ করবামাত্রই সন্ধ্যার পর থেকে একেবারে পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতা আরম্ভ হয়। প্রথম রাত্রি এবং অর্দ্ধরাত্রে বিশেষ কোন প্রভেদ নেই। কলকাতায় অনিদ্রার রাত্রি মস্ত একটা অন্ধকার নদীর মত, খুব ধীরে ধীরে চল্তে থাকে, বিছানায় চক্ষু মেলে চিৎ হয়ে পড়ে তার গতিশব্দ মনে মনে গণনা করা যেতে পারে; এখানকার রাত্রিটা যেন একটা প্রকাণ্ড নিস্তরঙ্গ হ্রদের মত—আগাগোড়া সমান থম্ থম্ করচে কোথাও কিছু গতি নেই। যতই এপাশ ফিরি এবং যতই ওপাশ ফিরি একটা মস্ত যেন অনিদ্রার গুমট্ করে ছিল, তার মধ্যে প্রবাহের লেশমাত্র পাওয়া যায় না। আজ সকালে কিছু বিলম্বে শয্যাত্যাগ করে আমার নীচেকার ঘরের তাকিয়া ঠেসান্ দিয়ে বুকের উপর শ্লেট্ রেখে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে সকালের বাতাস এবং পাখীর ডাকের মধ্যে একটি কবিতা লিখ্তে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম। বেশ জমে এসেছিল—মুখ সহাস্য, চক্ষু ঈষৎ মুদ্রিত, মাথা ঘন ঘন আন্দোলিত এবং গুন্ গুন্ আবৃত্তি উত্তরোত্তর পরিস্ফুট হয়ে উঠ্ছিল—এমন সময় একখানি চিঠি, একখানি সাধনা, একখানি সাধনার প্রুফ এবং একখানি Monist কাগজ পাওয়া গেল। চিঠিখানি পড়লুম এবং সাধনার পাতাগুলোর মধ্যে চোখ দুটোকে একবার সবেগে ঘোড়দৌড় করিয়ে নিয়েএলুম। তার পরে পুনশ্চ শিরশ্চালন করে অস্ফুট গুঞ্জনস্বরে কবিত্বে প্রবৃত্তহলুম। শেষ করে ফেলে তবে অন্য কথা। একটি কবিতা লিখেফেল্লে যেমন আনন্দ হয় হাজার গদ্য লিখ্লেও তেমন হয় না কেন তাই ভাব্চি। কবিতায় মনের ভাব বেশ একটি সম্পূর্ণতা লাভ করে, বেশ যেন হাতে করে তুলে নেবার মত। আর, গদ্য যেন এক বস্তা আল্গা জিনিষ—একটি জায়গা ধরলে সমস্তটি অম্নি স্বচ্ছন্দে উঠে আসে না— একেবারে একটা বোঝাবিশেষ। রোজ রোজ যদি একটি করে কবিতা লিখে শেষ করতে পারি তাহলে জীবনটা বেশ একরকম আনন্দে কেটে যায়—কিন্তু এতদিন ধরে সাধনা করে আস্চি ওজিনিষটা এখনো তেমন পোষ মানেনি—প্রতিদিন লাগাম পরাতে দেবে তেমন পক্ষীরাজ ঘোড়াটি নয়! আর্টের একটা প্রধান আনন্দ হচ্চে স্বাধীনতার আনন্দ—বেশ আপনাকে অনেক দূরে নিয়ে যাওয়া যায় তার পরে আবার এই ভবকারাগারের মধ্যে ফিরে এসেও অনেকক্ষণ কানের মধ্যে একটা ঝঙ্কার, মনের মধ্যে একটা স্ফুর্ত্তি লেগে থাকে। এই ছোট ছোট কবিতাগুলো আপ্নাআপ্নি এসে পড়চে বলে আর নাটকে হাত দিতে পারচিনে। নইলে দুটো তিনটে ভাবী নাটকের উমেদার মাঝেমাঝে দরজা ঠেলাঠেলি করচে। শীতকাল ছাড়া বোধহয় সেগুলোতে হাত দেওয়া হয়ে উঠ্বে না। চিত্রাঙ্গদা ছাড়া আমার আর সব নাটকই শীতকালে লেখা। সে সময়ে গীতিকাব্যের আবেগ অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে—অনেকটা ধীরেসুস্থে নাটক লেখা যায়।