ছিন্নপত্র (১৯১২)/৪৮
১২ই জ্যৈষ্ঠ;
১৮৯২।
পূর্ব্বেই লিখেছি অপরাহ্নে আমি আপন মনে একাকী ছাতের উপর বেড়াই; কাল সন্ধ্যাবেলায় আমার দুই বন্ধুকে দুই পার্শ্বে নিয়ে অঘোরকে আমার পথপ্রদর্শক করে তাঁদের এখানকার প্রাকৃতিক শোভা সন্দর্শনকরানো আমার কর্ত্তব্য মনে করে বেরিয়ে পড়া গেল। তখন সূর্য্য অস্ত গেছে কিন্তু অন্ধকার হয়নি। একেবারে দিগন্তের প্রান্তে যেখানে গাছের সার নীলবর্ণ হয়ে দেখা যাচ্চে, তারি উপরেই ঠিক একটি রেখামাত্র খুব গাঢ় নীল মেঘ উঠে খুব চমৎকার দেখ্তে হয়েচে—আমি তারি মধ্যে একটুখানি কবিত্ব করে বল্লুম, ঠিক যেন নীল চোখের পাতার উপরে নীল সুর্ম্মা লাগিয়েছে। সঙ্গীরা কেউ কেউ শুন্তে পেলেনা, কেউ কেউ বুঝ্তে পারলেনা—কেউ কেউ সংক্ষেপে বল্লে—হাঁ, দিব্যি দেখ্তে হয়েচে। তার পর থেকে দ্বিতীয়বার কবিত্ব করতে আমার উৎসাহ হল না। প্রায় মাইলখানেক গিয়ে একটা বাঁধের ধারে একসার তালবন এবং তালবনের কাছে একটি মেঠো ঝরনার মত আছে—সেইটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখ্চি এমন সময়ে দেখি উত্তরে সেই নীল মেঘ অত্যন্ত প্রগাঢ় এবং স্ফীত হয়ে চলে আস্চে এবং মধ্যে মধ্যে বিদ্যুদ্দন্ত বিকাশ করছে। আমাদের সকলেরই মত হল এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ঘরের মধ্যে বসে দেখাই সর্ব্বাপেক্ষা নিরাপদ, বাড়িমুখে যেমন ফিরেচি অম্নি প্রকাণ্ড মাঠের উপর দীর্ঘ পদক্ষেপ করতে করতে সরোষগর্জ্জনে একটা ঝড় আমাদের ঘাড়ের উপর এসে পড়ল। আমরা যখন প্রকৃতিসুন্দরীর চোখের সুর্ম্মার বাহার নিয়ে তারিফ করছিলুম তখন তিলমাত্র আশঙ্কা করিনি যে, তিনি রোষাবিষ্টা গৃহিণীর মত এত বড় একটা প্রকাণ্ড চপেটাঘাত নিয়ে আমাদের উপর ছুটে আস্বেন। ধূলোয় এমনি অন্ধকার হয়ে এল যে পাঁচ হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। বাতাসের বেগ ক্রমেই বাড়তে লাগল—কাঁকরগুলো বায়ুতাড়িত হয়ে ছিটে গুলির মত আমাদের বিঁধতে লাগ্ল—মনে হল বাতাস পিছন থেকে ঘাড় ধরে আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে— ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পিট্ পিট্ করে মুখের উপর সবেগে আঘাত করতে লাগ্ল। দৌড়্ দৌড়্। মাঠ সমান নয়। এক এক জায়গায় আবার খোয়াইয়ের ভিতর নাব্তে হয়, সেখানে সহজ অবস্থাতেই চলা শক্ত, এই ঝড়ের বেগে চলা আরো মুস্কিল। পথের মধ্যে আবার পায়ে কাঁটাসুদ্ধ একটা শুক্নো ডাল বিঁধে গেল—সেটা ছাড়াতে গিয়ে বাতাস আবার পিছন থেকে ঠেলা দিয়ে মুখ থুবড়ে ফেলবার চেষ্টা করে। বাড়ির যখন প্রায় কাছাকাছি এসেচি, তখন দেখি, তিন চারটে চাকর মহা সোর্গোল্ করে দ্বিতীয় আর একটা ঝড়ের মত আমাদের উপরে এসে পড়ল। কেউ হাত ধরে, কেউ আহা উহু বলে, কেউ পথদেখাতে চায়, কেউ আবার মনে করে বাবু বাতাসে উড়ে যাবেন বলে’ পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরে; এই সমস্ত অনুচরদের দৌরাত্ম্য কাটিয়ে কুটিয়ে এলোমেলো চুলে, ধূলিমলিন দেহে, সিক্ত বস্ত্রে, হাঁপিয়ে বাড়িতে এসেত পড়লুম। যাহোক্, একটা খুব শিক্ষালাভ করেছি— হয়ত কোন্দিন্ কোন্ কাব্যে কিম্বা উপন্যাসে বর্ণনা করতে বস্তুম একজন নায়ক মাঠের মধ্যে দিয়ে ভীষণ ঝড়বৃষ্টি ভেঙে নায়িকার মধুর মুখচ্ছবি স্মরণ ক’রে অকাতরে চলে যাচ্চে—কিন্তু এখন আর এরকম মিথ্যে কথা লিখ্তে পারব না; ঝড়ের সময় কারো মধুর মুখ মনে রাখা অসম্ভব—কি করলে চোখে কাঁকর ঢুক্বেনা সেই চিন্তাই সর্ব্বাপেক্ষা প্রবল হয়ে ওঠে। আমার আবার চোখে eye-glass ছিল, সেটা বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে, কিছুতেই রাখ্তে পারিনে। এক হাতে চষমা ধরে আর এক হাতে ধুতির কোঁচা সাম্লে পথের কাঁটাগাছ এবং গর্ত্ত বাঁচিয়ে চল্চি। যদি এখানকার কোপাই নদীর ধারে আমার কোন প্রণয়িনীর বাড়ি থাক্ত, আমার চষমা এবং কোঁচা সাম্লাতুম, না, তার স্মৃতি সাম্লাতুম! বাড়িতে ফিরে এসে কাল অনেকক্ষণ ভাব্লুম—বৈষ্ণব কবিরা গভীর রাত্রে ঝড়ের সময় রাধিকার অকাতর অভিসারসম্বন্ধে অনেক ভাল ভাল মিষ্টি কবিতা লিখেচেন—কিন্তু একটা কথা ভাবেননি এরকম ঝড়ে কৃষ্ণের কাছে তিনি কি মূর্ত্তি নিয়ে উপস্থিত হতেন? চুলগুলোর অবস্থা যে কিরকম হত সেত বেশ বোঝা যাচ্চে। বেশবিন্যাসেরই বা কিরকম দশা! ধূলাতে লিপ্ত হয়ে, তার উপর বৃষ্টির জলে কাদা জমিয়ে কুঞ্জবনে কিরকম অপরূপ মূর্ত্তি করে গিয়েই দাঁড়াতেন! এসব কথা কিন্তু বৈষ্ণব কবিদের লেখা পড়বার সময় মনে হয় না—কেবল মানসচক্ষে ছবির মত দেখ্তে পাওয়া যায় একজন সুন্দরী শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রে বিকশিত কদম্ববনের ছায়া দিয়ে যমুনার তীরপথে প্রেমের আকর্ষণে ঝড়বৃষ্টির মাঝে আত্মবিহ্বল হয়ে স্বপ্নগতার মত চলেচেন; পাছে শোনা যায় বলে পায়ের নূপুর বেঁধে রেখেচেন, পাছে দেখা যায় বলে নীলাম্বরী কাপড় পরেচেন, কিন্তু পাছে ভিজে যান বলে ছাতা নেন্নি, পাছে পড়ে যান্ বলে বাতি আনা আবশ্যক বোধ করেন নি। হায়, আবশ্যক জিনিষগুলো আবশ্যকের সময় এত বেশি দরকার, অথচ কবিত্বের বেলায় এত উপেক্ষিত! আবশ্যকের শতলক্ষ দাসত্ববন্ধন থেকে আমাদের মুক্তি দেবার জন্যে কবিতা মিথ্যে ভাণ করচে। ছাতা জুতো জামাযোড়া চিরকাল থাক্বে। বরঞ্চ শোনা যায় সভ্যতার উন্নতি সহকারে কাব্য ক্রমে লোপ পাবে কিন্তু ছাতা জুতোর নতুন নতুন পেটেণ্ট্ বেরোতে থাক্বে।