শিলাইদহ, 
২রা আষাঢ়, 
১২৯৯। 

 কাল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমত আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েগেছে। দিনেরবেলাটা খুব গরম হয়ে বিকেলের দিকে ভারি ঘনঘটা মেঘ করে এল।

 কাল ভাবলুম, বর্ষার প্রথম দিনটা, আজ বরঞ্চ ভেজাও ভাল তবু অন্ধকূপের মধ্যে দিনযাপন করবনা। জীবনে ৯৩ সাল আর দ্বিতীয়বার আস্‌বেনা—ভেবে দেখ্‌তে গেলে পরমায়ুর মধ্যে আষাঢ়ের প্রথম দিন আর ক’বারই বা আস্‌বে—সবগুলো কুড়িয়ে যদি ত্রিশটা দিন হয় তাহ’লেও খুব দীর্ঘজীবন বলতে হবে। মেঘদূত লেখার পর থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিনটা একটা বিশেষ চিহ্নিত দিন হয়ে গেছে—নিদেন আমার পক্ষে। আমি প্রায়ই একএক সময়ে ভাবি, এই যে আমার জীবনে প্রত্যহ একটি একটি করে দিন আস্‌চে, কোনটি সূর্য্যোদয় সূর্যাস্তে রাঙা, কোনটি ঘনঘোর মেঘে স্নিগ্ধশীতল, কোনটি পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় শাদা ফুলের মত প্রফুল্ল, এগুলি কি আমার কম সৌভাগ্য! এবং এরা কি কম মূল্যবান! হাজার বৎসর পূর্ব্বে কালিদাস সেই যে আষাঢ়ের প্রথম দিনকে অভ্যর্থনা করেছিলেন—আমার জীবনেও প্রতি বৎসরে সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশ-যোড়া ঐশ্বর্য্য নিয়ে উদয় হয়—সেই প্রাচীন উজ্জয়িনীর প্রাচীন কবির সেই বহু-বহুকালের শত শত সুখদুঃখবিরহমিলনময় নরনারীদের আষাঢ়স্য প্রথম দিবসঃ! সেই অতি পুরাতন আষাঢ়ের প্রথম মহাদিন আমার জীবনে প্রতিবৎসর একটি একটি করে কমে যাচ্চে, অবশেষে এক সময় আস্‌বে, যখন এই কালিদাসের দিন, এই মেঘদূতের দিন, এই ভারতবর্ষের বর্ষার চিরকালীন প্রথম দিন, আমার অদৃষ্টে আর একটিও অবশিষ্ট থাক্‌বে না। একথা ভাল করে ভাব্‌লে পৃথিবীর দিকে আবার ভাল করে চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্য্যোদয়কে সজ্ঞানভাবে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্য্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মত বিদায় দিই। আমি যদি সাধু প্রকৃতির লোক হতুম তাহলে হয়ত মনে করতুম জীবন নশ্বর অতএব প্রতিদিন বৃথা ব্যয় না করে সৎকার্য্যে এবং হরিনামে যাপন করি। কিন্তু আমার সে প্রকৃতি নয় —তাই আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এমন সুন্দর দিনরাত্রিগুলি আমার জীবন থেকে প্রতিদিন চলে যাচ্ছে—এর সমস্তটা গ্রহণ করতে পারচিনে। এই সমস্ত রং, এই আলো এবং ছায়া, এই আকাশব্যাপী নিঃশব্দ সমারোহ, এই দ্যুলোকভূলোকের মাঝখানের সমস্ত শূন্যপরিপূর্ণ করা শান্তি এবং সৌন্দর্য্য, এর জন্যে কি কম আয়োজনটা চল্‌চে! কত বড় উৎসবের ক্ষেত্রটা! আর আমাদের ভিতরে ভাল করে তার সাড়া পাওয়াই যায় না! জগৎ থেকে এতই তফাতে আমরা বাস করি! লক্ষ লক্ষ যোজন দূর থেকে লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে অনন্ত অন্ধকারের পথে যাত্রা করে একটি তারার আলো এই পৃথিবীতে এসে পৌঁছয় আর আমাদের অন্তরে এসে প্রবেশ করতে পারে না, সে যেন আরো লক্ষযোজন দূরে! রঙীন্‌ সকাল এবং রঙীন্‌ সন্ধ্যাগুলি দিগ্বধূদের ছিন্ন কণ্ঠহার থেকে এক একটি মাণিকের মত সমুদ্রের জলে খসে খসে পড়ে যাচ্চে আমাদের মনের মধ্যে একটাও এসে পড়ে না। সেই বিলেত যাবার পথে লোহিত সমুদ্রের স্থির জলের উপরে যে একটি অলৌকিক সূর্য্যাস্ত দেখেছিলুম, সে কোথায় গেছে! কিন্তু ভাগ্যিস্ আমি দেখেছিলুম, আমার জীবনে ভাগ্যিস্ সেই একটি সন্ধ্যা উপেক্ষিত হয়ে ব্যর্থ হয়ে যায়নি— অনস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটি অত্যাশ্চর্য্য সূর্য্যাস্ত আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কোন কবি দেখেনি। আমার জীবনে তার রং রয়ে গেছে। এমন এক একটি দিন এক একটি সম্পত্তির মত। আমার সেই পেনেটির বাগানের গুটিকতক দিন, তেতালার ছাতের গুটিকতক রাত্রি, পশ্চিম ও দক্ষিণের বারান্দার গুটিকতক বর্ষা, চন্দননগরের গঙ্গার গুটিকতক সন্ধ্যা, দার্জ্জিলিঙে সিঞ্চল শিখরের একটি সূর্য্যাস্ত ও চন্দ্রোদয় এইরকম কতকগুলি উজ্জ্বল সুন্দর ক্ষণ-খণ্ড আমার যেন ফাইল করা রয়েছে। ছেলেবেলার বসন্তের জ্যোৎস্নারাত্রে যখন ছাতে পড়ে থাক্‌তুম তখন জ্যোৎস্না যেন মদের শুভ্র ফেনার মত একেবারে উপ্‌চে পড়ে নেশায় আমাকে ডুবিয়ে দিত। যে পৃথিবীতে এসে পড়েছি এখানকার মানুষগুলো সব অদ্ভুত জীব—এরা কেবলই দিনরাত্রি নিয়ম এবং দেয়াল গাঁথচে, পাছে দুটো চোখে কিছু দেখতে পায় এই জন্যে বহু যত্নে পর্দ্দা টাঙিয়ে দিচ্চে। বাস্তবিক পৃথিবীর জীবগুলো ভারি অদ্ভুত! এরা যে ফুলের গাছে এক একটি ঘ্যাটাটোপ পরিয়ে রাখেনি, চাঁদের নীচে চাঁদোয়া খাটায়নি সেই আশ্চর্য্য! এই স্বেচ্ছাঅন্ধগুলো বন্ধ পাল্কীর মধ্যে চড়ে পৃথিবীর ভিতর দিয়ে কি দেখে চলে যাচ্চে। যদি বাসনা এবং সাধনা-অনুরূপ পরকাল থাকে তাহলে এবার আমি এই ওয়াড়-পরানোপৃথিবী থেকে বেরিয়ে গিয়ে যেন এক উদার উন্মুক্ত সৌন্দর্য্যের আনন্দলোকে গিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারি। যারা সৌন্দর্য্যের মধ্যে সত্যি সত্যি নিমগ্ন হতে অক্ষম তারাই সৌন্দর্য্যকে কেবলমাত্র ইন্দ্রিয়ের ধন বলে অবজ্ঞা করে —কিন্তু এর মধ্যে যে অনির্ব্বচনীয় গভীরতা আছে, তার আস্বাদ যারা পেয়েচে তারা জানে সৌন্দর্য্য ইন্দ্রিয়ের চূড়ান্ত শক্তিরও অতীত—কেবল চক্ষু কর্ণ দূরে থাক্‌, সমস্ত হৃদয় নিয়ে প্রবেশ করলেও ব্যাকুলতার শেষ পাওয়া যায় না।

 আমি ভদ্রলোক সেজে সহরের বড় রাস্তায় আনাগোনা করচি, পরিপাটী ভদ্রলোকদের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথাবার্ত্তা কয়ে জীবন মিথ্যে কাটিয়ে দিচ্চি! আমি অন্তরে অসভ্য অভদ্র—আমার জন্যে কোথাও কি একটা ভারি সুন্দর অরাজকতা নেই, কতকগুলো ক্ষ্যাপী লোকের আনন্দমেলা নেই। কিন্তু আমি কি এ সমস্ত বকচি—কাব্যের নায়কেরা এইরকম সব কথা বলে—কনভেন্‌শ্যানালিটির উপরে তিন-চার পাতযোড়া স্বগত উক্তি প্রয়োগ করে—আপনাকে সমস্ত মানবসমাজের চেয়ে বড় মনে করে। বাস্তবিক এ সব কথা বল্‌তে লজ্জা করে। এর মধ্যে যে সত্যটা আছে সে বহুকালথেকে ক্রমাগত কথাচাপা পড়ে আস্‌চে। পৃথিবীতে সবাই ভারি কথা কয়—তার মধ্যে আমি একজন অগ্রগণ্য—হঠাৎ এতক্ষণে সে বিষয়ে চেতন হল।

 পুঃ—আসল যে কথাটা বল্‌তে গিয়েছিলুম—সেটা বলে নিই—ভয় নেই, আবার চার পাতা জুড়বেনা—কথাটা হচ্চে—পয়লা আষাঢ়ের দিন বিকেলে খুব মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে। বাস্‌।