শিলাইদহ, 
১৬ই জুন, 
১৮৯২। 

 যতই একলা আপনমনে নদীর উপরে কিম্বা পাড়াগাঁয়ে কোন খোলা জায়গায় থাকা যায়, ততই প্রতিদিন পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়, সহজভাবে আপনার জীবনের প্রাত্যহিক কাজ করে যাওয়ার চেয়ে সুন্দর এবং মহৎ আর কিছু হতে পারে না। মাঠের তৃণ থেকে আকাশের তারা পর্য্যন্ত তাই করচে; কেউ গায়ের জোরে আপনার সীমাকে অত্যন্ত বেশি অতিক্রম করবার জন্যে চেষ্টা করচেনা বলেই প্রকৃতির মধ্যে এমন গভীর শান্তি এবং অপার সৌন্দর্য্য—অথচ প্রত্যেকে যেটুকু করচে সেটুকু বড় সামান্য নয়—ঘাস আপনার চূড়ান্ত শক্তি প্রয়োগ করে’ তবে ঘাসরূপে টি’কে থাক্‌তে পারে, তার শিকড়ের শেষ প্রান্তটুকু পর্য্যন্ত দিয়ে তাকে রসাকর্ষণ করতে হয়, সে যে নিজের শক্তি লঙ্ঘন করে বটগাছ হবার নিষ্ফল চেষ্টা করচেনা এইজন্যই পৃথিবী এমন সুন্দর শ্যামল হয়ে রয়েছে। বাস্তবিক, বড় বড় উদ্যোগ এবং লম্বা-চৌড়া কথার দ্বারা নয় কিন্তু প্রাত্যহিক ছোট ছোট কর্ত্তব্য-সমাধাদ্বারাই মানুষের সমাজে যথাসম্ভব শোভা এবং শান্তি আছে। কবিত্বই বল আর বীরত্বই বল কোনটাই আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু একটি অতি ক্ষুদ্র কর্ত্তব্যের মধ্যেও তৃপ্তি এবং সম্পূর্ণতা আছে। বসে বসে হাঁস্‌ফাঁস্ করা, কল্পনা করা, কোন অবস্থাকেই আপনার যোগ্য মনে না করা, এবং ইতিমধ্যে সম্মুখ দিয়ে সময়কে চলে যেতে দেওয়া, এর চেয়ে হেয় আর কিছু হতে পারে না। যখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করা যায় নিজের সাধ্যায়ত্ত সমস্ত কর্ত্তব্য সত্যের সঙ্গে, বলের সঙ্গে, হৃদয়ের সঙ্গে সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে পালন করে যাব, এবং যখন বিশ্বাস হয় তা করতে পারব, তখন সমস্ত জীবন আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, ছোটখাট দুঃখবেদনা একেবারে দূর হয়ে যায়। অবশ্য, আমার জীবনের প্রতিদিন এবং প্রত্যেক মুহূর্ত্ত আমার সম্মুখে এখন প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নেই, তাই হয়ত দূর থেকে হঠাৎ একটা কাল্পনিক আশার উচ্ছ্বাসে স্ফীত হয়ে উঠ্‌চি, সমস্ত খুঁটিনাটি খিটিমিটি সঙ্কট এবং সংঘর্ষ বাদ দিয়ে ভাবী জীবনের একটা মোটামুটি চিত্র অঙ্কিত করে এতটা ভরসা পাচ্চি, কিন্তু তা ঠিক নয়।