ছিন্নপত্র (১৯১২)/৫৭
২২শে জুন,
১৮৯২।
আজ খুব ভোরে বিছানার শুয়ে শুয়ে শুন্ছিলুম ঘাটে মেয়েরা উলু দিচ্ছে। শুনে মনটা কেমন ঈষৎ বিকল হয়ে গেল—অথচ তার কারণ পাওয়া শক্ত। বোধ হয় এই রকমের একটা আনন্দ ধ্বনিতে হঠাৎ অনুভব করা যায় পৃথিবীতে একটা বৃহৎ কর্ম্মপ্রবাহ চল্চে যার অধিকাংশের সঙ্গেই আমার যোগ নেই—পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ আমার কেউ নয় অথচ তাদের কত কাজকর্ম্ম সুখদুঃখ উৎসব আনন্দ চল্চে। কি বৃহৎ পৃথিবী! কি বিপুল মানবসংসার! কত সুদূর থেকে জীবনের ধ্বনি প্রবাহিত হয়ে আসে— সম্পূর্ণ অপরিচিত ঘরের একটুখানি বার্ত্তা পাওয়া যায়। মানুষ যখন বুঝতে পারে আমার কাছে আমি যত বড়ই হই আমাকে দিয়ে সমস্ত বিশ্ব পরিপূর্ণ করতে পারিনে— অধিকাংশ জগৎই আমার অজ্ঞাত অজ্ঞেয় অনাত্মীয় আমাহীন—তখন এই প্রকাণ্ড ঢিলে জগতের মধ্যে আপনাকে অত্যন্ত খাটো এবং একরকম পরিত্যক্ত এবং প্রান্তবর্ত্তী বলে মনে হয়—তখনি মনের মধ্যে এই রকমের একটা ব্যাপ্ত বিষাদের উদয় হয়। তা ছাড়া এই উলুধ্বনিতে নিজের অতীত ভবিষ্যৎ সমস্ত জীবনটা একটি অতি সুদীর্ঘ পথের মত চখের সমুখে উদয় হল এবং তারি এক একটি সুদূর ছায়াময় প্রান্ত থেকে এই উলুধ্বনি কানে এসে পৌঁছতে লাগল। এই রকম ভাবেত আজ দিনটা আরম্ভ করেছি। এখনি সদরনায়েব আমলাবর্গ এবং প্রজারা উপস্থিত হলে এই উলুধ্বনির প্রতিধ্বনিটুকু পাড়া ছেড়ে পালাবে—অতি ক্ষীণ ভূতভবিষ্যৎকে দুই কনুইদিয়ে ঠেলে ফেলে জোয়ান বর্ত্তমান নিজমূর্ত্তিধরে সেলাম ঠুকে এসে দাঁড়াবে।