ছিন্নপত্র (১৯১২)/৬৮
কটক
ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩।
আমি ত বলি যতদিন না আমরা একটা কিছু করে তুল্তে পারব ততদিন আমাদের অজ্ঞাতবাস ভাল! কেননা আমরা যখন সত্যই অবমাননার যোগ্য তখন কিসের দোহাই দিয়ে পরের কাছে আত্মসম্মান রক্ষা করব? পৃথিবীর মধ্যে যখন আমাদের একটা কোনো প্রতিষ্ঠাভূমি হবে, পৃথিবীর কাজে যখন আমাদের একটা কোনো হাত থাকবে, তখন আমরা ওদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা কইতে পারব। ততদিন লুকিয়ে থেকে চুপ মেরে আপনার কাজ করে যাওয়াই ভাল। দেশের লোকের ঠিক এর উল্টো ধারণা। যা কিছু ভিতরকার কাজ, যা গোপনে থেকে করতে হবে সে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করে, যেটা নিতান্ত অস্থায়ী আস্ফালন এবং আড়ম্বরমাত্র সেইটেতেই তাদের যত ঝোঁক। আমাদের এ বড় হতভাগা দেশ। এখানে মনের মধ্যে কাজ করবার বল রাখা বড় শক্ত। যথার্থ সাহায্য করবার লোক কেউ নেই। যার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে প্রাণ সঞ্চয় করা যায় এমন মানুষ দশবিশ ক্রোশের মধ্যে একটি পাওয়া যায় না। কেউ চিন্তা করে না, অনুভব করে না, কাজ করে না; বৃহৎ কার্য্যের, যথার্থ জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা কারো নেই, বেশ একটি পরিণত মনুষ্যত্ব কোথাও পাওয়া যায় না। মানুষগুলো যেন উপছায়ার মত ঘুরে বেড়াচ্চে। খাচ্চেদাচ্চে, আপিস যাচ্চে, ঘুমচ্চে, তামাক টান্চে আর নিতান্ত নির্ব্বোধের মত বক্র বক্র বক্চে। যখন ভাবের কথা বলে তখন সেণ্টিমেণ্টাল্ হয়ে পড়ে, আর যখন যুক্তির কথা পাড়ে তখন ছেলেমানুষী করে। যথার্থ মানুষের সংস্রব পাবার জন্যে মানুষের মনে ভারি একটা তৃষ্ণা থাকে। কিন্তু সত্যকার রক্তমাংসের শক্তসমর্থ মানুষ ত নেই—সমস্ত উপছায়া, পৃথিবীর সঙ্গে অসংলগ্নভাবে বাষ্পের মত ভাস্চে।