পুরী,
১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৩।

 কারো কারো মন ফোটোগ্রাফের wet plate-এর মত; যে ছবিটা ওঠে সেটাকে তখনি ফুটিয়ে কাগজে না ছাপিয়ে নিলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মন সেই জাতের। যখন যে কোনো ছবি দেখি অমনি মনে করি এটা চিঠিতে ভাল করে লিখ্‌তে হবে। কটক থেকে পুরী পর্য্যন্ত এলুম, এই ভ্রমণের কত কি বর্ণনা করবার আছে তার ঠিক নেই। যেদিন যা দেখ্‌চি সেইদিনই সেইগুলো লেখবার যদি সময় পেতুম তাহলে ছবি বেশ ফুটে উঠ্‌তে পারত—কিন্তু মাঝে দুই একদিন গোলেমালে কেটে গেল—ইতিমধ্যে ছবির খুঁটিনাটি রেখাগুলি অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। তার একটা প্রধান কারণ, পুরীতে এসে পৌঁছে সাম্‌নে অহর্নিশি সমুদ্র দেখছি, সেই আমার সমস্ত মন হরণ করেছে, আমাদের দীর্ঘ ভ্রমণপথের দিকে পশ্চাৎ ফিরে চাইবার আর অবসর পাওয়া যাচ্চে না।

 শনিবার মধ্যাহ্নে আহারাদি করে বলু আমি বি—বাবু, একটি ভাড়াটে ফিট্‌ন্‌ গাড়িতে আমাদের কম্বল বিছানা পেতে তিনটি পিঠের কাছে তিন বালিশ রেখে কোচবাক্সে একটি চাপরাশি চড়িয়ে যাত্রা আরম্ভ করে দিলুম।

 কাঠযুড়ি পেরিয়ে আমাদের পথ। সেখানে গাড়ি থেকে নেবে আমাদের পাল্কিতে উঠ্‌তে হল। ধূসর বালুকা ধূ ধূ করচে। ইংরেজিতে এ’কে যে নদীর বিছানা বলে— বিছানাই বটে। সকালবেলাকার পরিত্যক্ত বিছানার মত—নদীর স্রোত যেখানে যেমন পাশ ফিরেছিল, যেখানে যেমন তার ভার দিয়েছিল, তার বালুশয্যায় সেখানে তেমনি উঁচু নীচু হয়ে আছে—সেই বিশৃঙ্খল শয়ন কেউ আর যত্ন করে হাত দিয়ে সমান করে বিছিয়ে রাখেনি। এই বিস্তীর্ণ বালির ওপারে একটি প্রান্তে একটুখানি শীর্ণ স্ফটিকস্বচ্ছ জল ক্ষীণ স্রোতে বয়ে চলে যাচ্চে। কালিদাসের মেঘদূতে বিরহিণীর বর্ণনায় আছে যে, যক্ষপত্নী বিরহণয়নের একটি প্রান্তে লীন হয়ে আছে— যেন পূর্ব্বদিকের শেষ সীমায় কৃষ্ণপক্ষের কৃশতম চাঁদটুকুর মত। বর্ষাশেষের এই নদীটুকু দেখে বিরহিণীর যেন আর একটি উপমা পাওয়া গেল।

 কটক থেকে পুরী পর্য্যন্ত পথটি খুব ভাল। পথ উচ্চে, তার দুইধারে নিম্নক্ষেত্র। বড় বড় গাছে ছায়াময়। অধিকাংশ আমগাছ। এই সময়ে সমস্ত আমগাছে মুকুল ধরেছে, গন্ধে পথ আকুল হয়ে আছে। আমি অশ্বত্থ বট নারিকেল এবং খেজুর গাছে ঘেরা এক একটি গ্রাম দেখা যাচ্চে। কোথাও বা স্বল্পজলা নদীর তীরে ছাপরওয়ালা গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে; গোলপাতার ছাউনির নীচে মেঠাইয়ের দোকান বসেছে; পথের ধারে গাছের তলায় এবং শ্রেণীবদ্ধ কুঁড়ে ঘরের মধ্যে যাত্রীরা খাওয়াদাওয়া করচে; ভিক্ষুকের দল নতুন যাত্রী ও গাড়ি পাল্কি দেখবামাত্র বিচিত্র কণ্ঠে ও ভাষায় আর্ত্তনাদ করতে আরম্ভ করেছে।

 যত পুরীর নিকটবর্ত্তী হচ্চি তত পথের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যা বেশি দেখ্‌তে পাচ্চি। ঢাকা গরুর গাড়ি সারি সারি চলেছে। রাস্তার ধারে, গাছের তলায়, পুকুরের পাড়ে লোক শুয়ে আছে, রাঁধচে, জটলা করে রয়েছে। মাঝে মাঝে মন্দির, পান্থশালা, বড় বড় পুষ্করিণী। পথের ডানদিকে একটা খুব মস্ত বিলের মত—তার ওপারে পশ্চিমে গাছের মাথার উপর জগন্নাথের মন্দিরচূড়া দেখা যাচ্চে। হঠাৎ এক জায়গায় গাছপালার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েই সুবিস্তীর্ণ বালির তীর এবং ঘন নীল সমুদ্রের রেখা দেখ্‌তে পাওয়া গেল।