ছিন্নপত্র (১৯১২)/৯০
সাজাদপুর,
৭ই জুলাই, ১৮৯৩।
ছোটখাট গ্রাম, ভাঙাচোরা ঘাট, টিনের ছাতওয়ালা বাজার, বাঁখারির বেড়া দেওয়া গোলাঘর, বাঁশঝাড়, আম কাঁঠাল খেজুর সিমুল কলা আকন্দ ভেরেণ্ডা ওল কচু লতাগুল্ম তৃণের সমষ্টিবদ্ধ ঝোপঝাড় জঙ্গল, ঘাটেবাঁধা মাস্তুলতোলা বৃহদাকার নৌকোর দল, নিমগ্নপ্রায় ধান এবং অর্দ্ধমগ্ন পাটের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ক্রমাগত এঁকে বেঁকে কাল সন্ধ্যের সময় সাজাদপুরে এসে পৌঁচেছি। এখন কিছুদিনের মত এইখানেই স্থায়ী হওয়া গেল। অনেকদিন বোটে থাকার পর সাজাদপুরের বাড়িটা বেশ লাগে ভাল—একটা যেন নূতন স্বাধীনতা পাওয়া যায়—যতটা খুসি নড়বার চড়বার এবং শরীর প্রসারণ করবার জায়গা পাওয়া মানুষের মানসিক সুখের যে একটা প্রধান অঙ্গ সেটা হঠাৎ আবিষ্কার করা যায়। আজ প্রাতে মাঝে মাঝে বেশ একটুখানি রৌদ্র দেখা দিচ্চে, বাতাসটি চঞ্চলবেগে বচ্চে, ঝাউ এবং লিচুগাছ ক্রমাগত সরসর মরমর, করে দুল্চে, নানাজাতির পাখী নানা ভাষা নানা সুরে ডেকে ডেকে প্রাতঃকালের আরণ্য মজলিষ সর্গরম করে তুলেছে। আমি আমাদের দোতলার এই সঙ্গীহীন প্রশস্ত নির্জ্জন আলোকিত উন্মুক্ত ঘরের মধ্যে বসে জানালা থেকে খালের উপরকার নৌকাশ্রেণী, ওপারের তরুমধ্যগত গ্রাম এবং ওপারের অনতিদূরবর্ত্তী লোকালয়ের মৃদু কর্ম্মপ্রবাহ নিরীক্ষণ করে বেশ একটুখানি মনের আনন্দে আছি। পাড়াগাঁয়ের কর্ম্মস্রোত খুব বেশি তীব্রও নয়, অথচ নিতান্ত নিশ্চেষ্ট নির্জ্জীবও নয়। কাজ এবং বিশ্রাম দুই যেন পাশাপাশি মিলিত হয়ে হাতধরাধরি করে চলেচে। খেয়ানৌকো পারাপার করচে, পান্থরা ছাতা হাতে করে খালের ধারের রাস্তা দিয়ে চলেছে, মেয়েরা ধুচুনি ডুবিয়ে চাল ধুচ্চে, চাষারা আঁটিবাধা পাট মাথায় করে হাটে আস্চে—দুটো লোক একটা গাছের গুঁড়ি মাটিতে ফেলে কুড়ুল নিয়ে ঠক্ ঠক্ শব্দে কাঠ চেলা করচে, একটা ছুতোর অশথ গাছের তলার জেলেডিঙি উল্টে ফেলে বাটারি হাতে মেরামত করচে, গ্রামের কুকুরটা খালের ধারে ধারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্চে, গুটিকতক গরু বর্ষার ঘাস অপর্য্যাপ্ত পরিমাণে আহারপূর্ব্বক অলসভাবে রৌদ্রে মাটির উপর পড়ে কান এবং লেজ নেড়ে মাছি তাড়াচ্চে, এবং কাক এসে তাদের মেরুদণ্ডের উপর বসে যখন বড় বেশি বিরক্ত করচে তখন একবার পিঠের দিকে মাথাটা নেড়ে আপত্তি জানাচ্চে। এখানকার এই দুই একটা একঘেয়ে ঠক্ ঠক্ ঠুক্ ঠাক্ শব্দ, উলঙ্গ ছেলেমেয়েদের খেলার কল্লোল, রাখালের করুণ উচ্চস্বরে গান, দাঁড়ের ঝুপ্ ঝাপ ধ্বনি, কলুর ঘানির তীক্ষ্ণকাতর নিখাদস্বর, সমস্ত কর্ম্মকোলাহল একত্র মিলে এই পাখীর ডাক এবং পাতার শব্দের সঙ্গে কিছুমাত্র অসামঞ্জস্য ঘটাচ্চে না—সমস্তটাই যেন একটা শান্তিময় স্বপ্নময় করুণামাখা একটা বড় সঙ্গীতের অন্তর্গত—খুব বিস্তৃত বৃহৎ অথচ সংযত মাত্রায় বাঁধা। আমার মাথার মধ্যে সূর্য্যের আলোক এবং এই সমস্ত শব্দ একেবারে যেন কানায় কানায় ভরে এসেছে অতএব চিঠি বন্ধ করে খানিকক্ষণ পড়ে থাকা যাক্।