ছিন্নপত্র (১৯১২)/৯৫
পতিসার,
২৬শে শ্রাবণ, ১৩৯৩।
আমি অনেকদিন থেকে ভেবে দেখেছি পুরুষরা কিছু খাপছাড়া আর মেয়েরা বেশ সুসম্পূর্ণ। মেয়েদের কথাবার্ত্তা বেশভূষা, চালচলন, আচারব্যবহার এবং জীবনের কর্ত্তব্যের মধ্যে একটি অখণ্ড সামঞ্জস্য আছে। তার প্রধান কারণ হচ্চে যুগযুগান্তর থেকে প্রকৃতি তাদের কর্ত্তব্য নিজে নির্দ্দিষ্ট করে দিয়ে তাদের আগাগোড়া সেই ভাবে সেই উদ্দেশ্যে গঠিত করে দিয়েছে। এ পর্য্যন্ত কোনো পরিবর্ত্তন কোনো রাষ্ট্রবিপ্লব সভ্যতার কোনো ভাঙন-গড়নে তাদের সেই ঐক্য থেকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়নি—তারা বরাবর সেবা করেছে, ভাল বেসেছে, আদর করেছে, আর কিছু করেনি। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ভাষায় ভঙ্গীতে সেই কাজের নৈপুণ্য এবং সৌন্দর্য্য যেন মিশে এক হয়ে গেছে—তাদের স্বভাব এবং তাদের কাজ যেন পুষ্প এবং পুষ্পের গন্ধের মত সম্মিলিত হয়ে গেছে—তাদের মধ্যে সেই জন্যে কোনো বিরোধ কোনো ইতস্ততঃ নেই। পুরুষের চরিত্রের মধ্যে বিস্তর উঁচু নীচু, তারা যে নানাকার্য্যে নানাশক্তি নানাপরিবর্ত্তনের ভিতর দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে তাদের অঙ্গে এবং স্বভাবে তার যেন চিহ্ণ রয়ে গেছে। কোথাও কিছু নেই কপালটা হয়ত বৃহৎ উঁচু হয়ে উঠ্ল, মাঝের থেকে হয়ত নাকটা এমনি ঠেলে উঠ্ল যে, তাকে কার সাধ্য দাবিয়ে রাখে—চোয়াল দুটো হয়ত সুষমার কোনো নিয়ম মান্লেনা। যদি চিরকাল পুরুষ একভাবে চালিত, এককার্য্যে শিক্ষিত হয়ে আস্ত তা হলে তাদেরও মুখে এবং স্বভাবে একটা সামঞ্জস্য দাঁড়িয়ে যেত; একটা ছাঁচ বহুকাল থেকে তৈরি হয়ে যেত;—তাহলে তাদের আর বল প্রকাশ করে বহুচিন্তা করে কাজ করতে হত না, সকল কাজ সুন্দরভাবে সহজে সম্পন্ন হত; তাহলে তাদের একটা সহজ নীতিও দাঁড়িয়ে যেত—অর্থাৎ বহুযুগ থেকে অবিচ্ছেদে যে কাজ করে আস্চে সেই কাজের কাছে তাদের মন বশ মান্ত, সেই বহুযুগের অভ্যন্ত কর্ত্তব্য থেকে কোনো সামান্য শক্তি তাদের বিক্ষিপ্ত করতে পারত না। স্ত্রীলোককে প্রকৃতি মা করে দিয়ে তাকে একেবারে ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে—পুরুষের সেরকম কোনো স্বাভাবিক আদিম বন্ধন নেই, সেইজন্যে একটি ধ্রুবকেন্দ্র আশ্রয়ে পুরুষ সর্ব্বতোভাবে তৈরি হয়ে যায়নি —সে চিরকাল ধরে কেবলি বিক্ষিপ্ত হয়ে হয়ে এসেছে—তার শতমুখী উচ্ছৃঙ্খল প্রবৃত্তি তাকে একটি সুন্দর সমগ্রতায় গড়ে তোলেনি। আমি সেদিনকার চিঠিতে বন্ধনকে সৌন্দর্য্যের কারণ বলে অনেকখানি লিখেছিলুম মনে আছে—মেয়েরা সেইরকম একটি স্বাভাবিক ছন্দের বন্ধনে সম্পূর্ণ সুন্দর হয়ে তৈরি হয়ে এসেছে—আর পুরুষরা গদ্যের মত বন্ধনহীন এবং সৌন্দর্য্যহীন—তাদের আগাগোড়ার মধ্যে কোনো একটি “ছাঁদ নেই।” মেয়েদের সঙ্গে যে লোকে চিরকাল সঙ্গীতের কবিতার, লতার, ফুলের, নদীর তুলনা দিয়ে এসেছে এবং কখনো পুরুষের সঙ্গে দেবার কথা তাদের মনেও উদয় হয়নি তার কারণই এই। প্রকৃতির সমস্ত সুন্দর জিনিষ যেমন সুসম্বন্ধ সুসম্পুর্ণ সুসংহত সুসংযত মেয়েরাও সেইরকম; তাদের মধ্যে কোনো দ্বিধা কোনো চিন্তা কোনো মন এসে তাদের ছন্দোভঙ্গ করে দিচ্চে না, কোনো তর্ক এসে তাদের মিল নষ্ট করে দিচ্চে না।