পতিসার,
১৩ই আগষ্ট, ১৮৯৩।

 এবার এই বিলের পথ দিয়ে কালিগ্রামে আস্‌তে আস্‌তে আমার মাথায় একটি ভাব বেশ পরিষ্কাররূপে ফুটে উঠেছে। কথাটা নতুন নয় অনেকদিন থেকে জানি কিন্তু তবু একএকবার পুরোনো কথাও নতুন করে অনুভব করা যায়। দুই দিকে দুই তীর দিয়ে সীমাবদ্ধ না থাক্‌লে জলস্রোতের তেমন শোভা থাকেনা—অনির্দ্দিষ্ট অনিয়ন্ত্রিত বিল একঘেয়ে শোভাশূন্য। ভাষার পক্ষে ছন্দের বাধন ঐ তীরের কাজ করে। ভাষাকে একটি বিশেষ আকার এবং বিশেষ শোভা দেয়—তার একটি সুন্দর চেহারা ফুটে ওঠে। তীরবদ্ধ নদীগুলির যেমন একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব আছে—তাদের যেমন এক একটি স্বতন্ত্র লোকের মত মনে হয় ছন্দের দ্বারা কবিতা সেইরূপ এক একটি মূর্ত্তিমান অস্তিত্বের মত দাঁড়িয়ে যায়। গদ্যের সেইরকম সুন্দর সুনির্দ্দিষ্ট স্বাতন্ত্র্য নেই—সে একটা বৃহৎ বিশেষত্ববিহীন বিলের মত। আবার তটের দ্বারা আবদ্ধ হওয়াতেই নদীর মধ্যে একটা বেগ আছে একটা গতি আছে—কিন্তু প্রবাহহীন বিল কেবল বিস্তৃতভাবে দিগ্‌বিদিক্ গ্রাস করে পড়ে থাকে। ভাষার মধ্যেও যদি একটা আবেগ একটা গতি দেবার প্রয়োজন হয় তবে তাকে ছন্দের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে বেঁধে দিতে হয়—নইলে সে কেবল ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে কিন্তু সমস্ত বল নিয়ে একদিকে ধাবিত হতে পারে না। বিলের জলকে পল্লিগ্রামের লোকেরা বলে বোবা জল—তার কোনো ভাষা নেই, আত্মপ্রকাশ নেই। তটবদ্ধ নদীর মধ্যে সর্ব্বদা একটা কলধ্বনি শোনা যায়; ছন্দের মধ্যে বেঁধে দিলে কথাগুলোও সেইরকম পরস্পরের প্রতি আঘাত সংঘাত করে একটা সঙ্গীতের সৃষ্টি করতে থাকে—সেই জন্যে ছন্দের ভাষা বোবা ভাষা নয়, তার মুখে সর্ব্বাদাই কলগান। বাঁধনের মধ্যে থাকাতেই গতির সৌন্দর্য্য, ধ্বনির সৌন্দর্য্য এবং আকারের সৌন্দর্য্য। বাঁধনের মধ্যে থাকাতে যেমন সৌন্দর্য্য তেমনি শক্তি। কবিতা যে স্বভাবতই ধীরে ধীরে একটি ছন্দের মধ্যে ধরা দিয়ে আপনাকে পরিস্ফুট করে তুলেছে ওটা একটি কৃত্রিম অভ্যাসজাত সুখ দেবার জন্যে নয়—ওর একটি গভীর স্বাভাবিক সুখ আছে। অনেক মূর্খ মনে করে কবিতার ছন্দোবদ্ধ কেবল একটা বাহাদুরী করা; ওতে কেবল সাধারণ লোকের বিস্ময় উৎপাদন করে সুখ দেয়—ও কেবল ভাষার ব্যায়াম মাত্র। কিন্তু সে ভারি ভুল। কবিতার ছন্দ যে নিয়মে উৎপন্ন হয়েছে, বিশ্বজগতের সমস্ত সৌন্দর্য্যই সেই নিয়মে সৃষ্ট হয়েছে। একটি সুনির্দ্দিষ্ট বন্ধনের মধ্যে দিয়ে বেগে প্রবাহিত হয়ে মনের মধ্যে আঘাত করে বলেই সৌন্দর্য্যের এমন অনিবার্য্য শক্তি। আর সুষমার বন্ধন ছাড়িয়ে গেলেই সব একাকার হয়ে যায় তার আর আঘাত করবার শক্তি থাকে না। বিল ছাড়িয়ে যেমনি নদীতে এবং নদী ছাড়িয়ে যেম্‌নি বিলে গিয়ে পড়ছিলুম অমনি আমার মনে এই তত্ত্বটি দেদীপ্যমান হয়ে জেগে উঠ্‌ছিল।