ছিন্নপত্র (১৯১২)/৯৩
পতিসর,
১১ই আগষ্ট ১৮৯৩
অনেকগুলো বড় বড় বিলের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছে। এই বিলগুলো ভারি অদ্ভুত—কোনো আকার আয়তন নেই, জলেস্থলে একাকার—পৃথিবী সমুদ্রগর্ভ থেকে নতুন জেগে উঠ্বার সময় যেমন ছিল। কোথাও কিছু কিনারা নেই—খানিকটা জল খানিকটা মগ্নপ্রায় ধানক্ষেতের মাথা, খানিকটা শেওলা এবং জলজ উদ্ভিদ ভাস্চে—পানকৌড়ি সাঁতার দিচ্চে—জাল ফেলবার জন্যে বড় বড় বাঁশ পোতা, তারি উপর কটা রঙের বড় বড় চিল বসে আছে—ভারি একাকার একঘেয়েরকমের দৃশ্য। দ্বীপের মত অতিদূরে গ্রামের রেখা দেখা যাচ্চে—যেতে যেতে হঠাৎ আবার খানিকটা নদী, দুধারে গ্রাম, পাটের ক্ষেত এবং বাঁশের ঝাড়, আবার কখন যে সেটা বিস্তৃত বিলের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্চে বোঝবার যো নেই।
ঠিক সূর্য্যাস্তের কাছাকাছি সময় যখন একটি গ্রাম পেরিয়ে আসছিলুম একটা লম্বা নৌকোয় অনেকগুলো ছোক্রা ঝপ্ ঝপ্ করে দাঁড় ফেলছিল এবং সেই তালে গান গাচ্ছিল—
“যোবতী, ক্যান্ বা কর মন ভারী?
পাবনা থাক্যে আন্যে দেব ট্যাকা দামের মোটরি।”
স্থানীয় কবিটি যে ভাব অবলম্বন করে সঙ্গীত রচনা করেচেন আমরাও ওভাবের ঢের লিখেছি কিন্তু ইতরবিশেষ আছে।—আমাদের যুবতী মন ভারী করলে তৎক্ষণাৎ জীবনটা কিম্বা নন্দনকানন থেকে পারিজাতটা এনে দিতে প্রস্তুত হই—কিন্তু এ অঞ্চলের লোক খুব সুখে আছে বল্তে হবে, অল্প ত্যাগস্বীকারেই যুবতীর মন পায়। মোটরি জিনিষটি কি তা বলা আমার সাধ্য নয়, কিন্তু তার দামটাও নাকি পার্শ্বেই উল্লেখ করা আছে তাতেই বোঝা যাচ্চে খুব বেশি দুর্ম্মূল্য নয়, এবং নিতান্ত অগম্য স্থান থেকেও আনতে হয় না। গানটা শুনে বেশ মজার লাগ্ল—যুবতীর মন ভারি হলে জগতে যে আন্দোলন উপস্থিত হয় এই বিলের প্রান্তেও তার একটা সংবাদ পাওয়া গেল। এ গানটি কেবল অস্থানেই হাস্যজনক কিন্তু দেশকালপাত্রবিশেষে এর যথেষ্ট সৌন্দর্য্য আছে—আমার অজ্ঞাতনামা গ্রাম্য কবিভ্রাতার রচনাগুলিও এই গ্রামের লোকের সুখদুঃখের পক্ষে নিতান্ত আবশ্যক—আমার গানগুলি সেখানে কম হাস্যজনক নয়।