ছিন্নপত্র (১৯১২)/৯২
সাজাদপুর,
৩০শে আষাঢ়, ১৮৯৩।
আজকাল কবিতা লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপননিষিদ্ধ সুখসম্ভোগের মত হয়ে পড়েচে—এদিকে আগামী মাসের সাধনার জন্যে একটি লাইন লেখা হয়নি, ওদিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া আসচে, অনতিদূরে আশ্বিনকার্ত্তিকের যুগল সাধনা রিক্ত হস্তে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করচে, আর আমি আমার কবিতার অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্চি। রোজ মনে করি আজ একটা দিন বৈত নয়—এমনি করে কত দিন কেটে গেল। আমি বাস্তবিক ভেবে পাইনে কোন্টা আমার আসল কাজ। এক এক সময় মনে হয় আমি ছোট ছোট গল্প অনেক লিখ্তে পারি এবং মন্দ লিখ্তে পারিনে—লেখ্বার সময় সুখও পাওয়া যায়। এক এক সময় মনে হয় আমার মাথায় এমন অনেকগুলো ভাবের উদয় হয় যা ঠিক কবিতায় ব্যক্ত করবার যোগ্য নয় সেগুলো ডায়ারি প্রভৃতি নানা আকারে প্রকাশ করে রেখে দেওয়া ভাল, বোধ হয় তাতে ফলও আছে আনন্দও আছে। এক এক সময় সামাজিক বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের লোকের সঙ্গে ঝগড়া করা খুব দরকার, যখন আর কেউ করচেনা তখন কাজেই আমাকে এই অপ্রিয় কর্ত্তব্যটা গ্রহণ করতে হয়—আবার এবং এক সময় মনে হয় দূর হোকগে ছাই, পৃথিবী আপনার চরকায় আপনি তেল দেবে এখন,—মিল করে ছন্দ গেঁথে ছোট ছোট কবিতা লেখাটা আমার বেশ আসে, সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে আপনার মনে আপনার কোণে সেই কাজই করা যাক্! মদগর্ব্বিতা যুবতী যেমন তার অনেকগুলি প্রণয়ীকে নিয়ে কোনটিকেই হাতছাড়া করতে চায়না, আমার কতকটা যেন সেই দশা হয়েচে। মিউজ্দের মধ্যে আমি কোনোটিকেই নিরাশ করতে চাইনে—কিন্তু তাতে কাজ অত্যন্ত বেড়ে যায় এবং হয়ত “দীর্ঘ দৌড়ে” কোনটিই পরিপূর্ণভাবে আমার আয়ত্ত হয়না। সাহিত্যবিভাগেও কর্ত্তব্যবুদ্ধির অধিকার আছে কিন্তু অন্য বিভাগের কর্ত্তব্যবুদ্ধির সঙ্গে তার একটু প্রভেদ আছে। কোন্টাতে পৃথিবীর সব চেয়ে উপকার হবে সাহিত্যকর্ত্তব্যজ্ঞানে সে কথা ভাববার দরকার নেই কিন্তু কোন্টা আমি সব চেয়ে ভাল করতে পারি সেইটেই হচ্চে বিচার্য্য। বোধ হয় জীবনের সকল বিভাগেই তাই। আমার বুদ্ধিতে যতটা আসে তাতেত বোধ হয় কবিতাতেই আমার সকলের চেয়ে বেশি অধিকার। কিন্তু আমার ক্ষুধানল বিশ্বরাজ্য ও মনোরাজ্যের সর্ব্বত্রই আপনার জ্বলন্ত শিখা প্রসারিত করতে চায়। যখন গান তৈরি করতে আরম্ভ করি তখন মনে হয় এই কাজেই যদি লেগে থাকা যায় তাহলেত মন্দ হয় না—আবার যখন একটা কিছু অভিনয়ে প্রবৃত্ত হওয়া যায় তখন এম্নি নেশা চেপে যায় যে মনে হয় যে, চাই কি, এটাতেও একজন মানুষ আপনার জীবন নিয়োগ করতে পারে। আবার যখন “বাল্য-বিবাহ” কিম্বা “শিক্ষার হেরফের” নিয়ে পড়া যায় তখন মনে হয় এই হচ্চে জীবনের সর্ব্বোচ্চ কাজ। আবার লজ্জার মাথা খেয়ে সত্যিকথা যদি বল্তে হয় তবে এটা স্বীকার করতে হয় যে, ঐ চিত্রবিদ্যা বলে একটা বিদ্যা আছে তার প্রতিও আমি সর্ব্বদা হতাশ প্রণয়ের লুব্ধ দৃষ্টিপাত করে থাকি—কিন্তু আর পাবার আশা নেই, সাধনা করবার বয়স চলে গেছে। অন্যান্য বিদ্যার মত তাঁকেও সহজে পাবার যো নেই—তাঁর একেবারে ধনুকভাঙা পণ—তুলি টেনে টেনে একেবারে হয়রান্ না হলে তাঁর প্রসন্নতা লাভ করা যায় না। একলা কবিতাটিকে নিয়ে থাকাই আমার পক্ষে সব চেয়ে সুবিধে—বোধ হয় যেন উনিই আমাকে সবচেয়ে বেশি ধরা দিয়েছেন—আমার ছেলেবেলাকার আমার বহুকালের অনুরাগিনী সঙ্গিনী।
নীরব কবিসম্বন্ধে যে প্রশ্ন উঠেছে সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই যে, সরব এবং নীরবের মধ্যে অনুভূতির পরিমাণ সমান থাক্তে পারে কিন্তু আসল কবিত্ব জিনিষটি স্বতন্ত্র। কেবল ভাবার ক্ষমতা বলে’ নয়, গঠন করবার শক্তি। একটা অলক্ষিত অচেতন নৈপুণ্য বলে ভাবগুলি কবির হাতে বিচিত্র আকার ধারণ করে। সেই সৃজনক্ষমতাই কবিত্বের মূল। ভাষা, ভাব এবং অনুভাব তার সরঞ্জামমাত্র। কারো বা ভাষা আছে কারো বা অনুভাব আছে, কারো বা ভাষা এবং অনুভাব দুই আছে, কিন্তু আর একটি ব্যক্তি আছে যার ভাষা অনুভাব এবং সৃজনীশক্তি আছে, এই শেষোক্ত লোকটিকে কবি নাম দেওয়া যেতে পারে। প্রথমোক্ত তিনটি লোক নীরবও হতে পারেন সরবও হতে পারেন, কিন্তু তাঁরা কবি নন। তাঁদের মধ্যে কাউকে কাউকে ভাবুক বল্লেই ঠিক বিশেষণটা প্রয়োগ করা হয়। তাঁরাও জগতে অত্যন্ত দুর্লভ এবং কবির ভূষিত চিত্ত সর্ব্বদাই তাঁদের জন্যে ব্যাকুল হয়ে আছে।
উপরে এই ভূমিকার পরে আমার সেই “জাল-ফেলা” কবিতাটার ব্যাখ্যা একটু সহজ হবে। লেখাটা চোখের সামনে থাক্লে তার মানে নিজে একটু ভাল করে বুঝে বোঝাবার চেষ্টা করতে পারতুম—তবু একটা ঝাপসারকমের ভাব মনে আছে। মনে কর একজন ব্যক্তি তার জীবনের প্রভাতকালে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সূর্য্যোদয় দেখছিল; সে সমুদ্রটা তার আপনার মন কিম্বা ঐ বাহিরের বিশ্ব কিম্বা উভয়ের সীমানামধ্যবর্ত্তী একটি ভাবের পারাবার, সে কথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। যাই হোক সেই অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যময় অগাধ সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে লোকটার মনে হল এই রহস্যপাথারের মধ্যে জাল ফেলে দেখা যাক্না কি পাওয়া যায়। এই বলেত সে ঘুরিয়ে জাল ফেল্লে। নানারকমের অপরূপ জিনিষ উঠ্তে লাগ্ল—কোনটা বা হাসির মত শুভ্র কোনটা বা অশ্রুর মত উজ্জ্বল, কোনটা বা লজ্জার মত রাঙা। মনের উৎসাহে সে সমস্ত দিন ধরে ঐ কাজই কেবল করলে—গভীর তলদেশে যে সকল সুন্দর রহস্য ছিল সেইগুলিকে তীরে এনে রাশীকৃত করে তুল্লে। এম্নি করে জীবনের সমস্ত দিনটি যাপন করলে। সন্ধ্যার সময় মনে করলে এবারকার মত যথেষ্ট হয়েছে এখন এইগুলি নিয়ে তাকে দিয়ে আসা যাক্গে। কাকে যে সে কথাটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি—হয়ত তার প্রেয়সীকে, হয়ত তার স্বদেশকে। কিন্তু যাকে দেবে সেত এ সমস্ত অপূর্ব্ব জিনিষ কখনো দেখেনি। সে ভাবলে এগুলো কি, এর আবশ্যকতাই বা কি, এতে কি অভাব দূর হবে, দোকানদারের কাছে যাচিয়ে দেখ্লে এর কতই বা মূল্য হতে পারবে! এক কথায়, এ বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম্মনীতি, তত্ত্বজ্ঞান প্রভৃতি কিছুই নয় এ কেবল কতকগুলো রঙীন্ ভাবমাত্র, তারও যে কোন্টার কি নাম কি বিবরণ তারও ভাল পরিচয় পাওয়া যায় না। ফলতঃ সমস্ত দিনের জালফেলা অগাধ সমুদ্রের এই রত্নগুলি যাকে দেওয়া গেল সে বল্লে এ আবার কি? জেলেরও মনে তখন অনুতাপ হল, সত্যি বটে, এ ত বিশেষ কিছু নয়, আমি কেবল জাল ফেলেছি আর তুলেছি; আমিত হাটেও যাইনি পয়সা কড়িও খরচ করিনি এর জন্যেত আমাকে কাউকে এক পয়সা খাজনা কিম্বা মাশুল দিতে হয়নি! সে তখন কিঞ্চিৎ বিষণ্ণমুখে লজ্জিতভাবে সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে ঘরের দ্বারে বসে বসে একে একে রাস্তায় ফেলে দিলে। তার পর দিন সকাল বেলায় পথিকরা এসে সেই বহুমূল্য জিনিষগুলি দেশে বিদেশে আপন আপন ঘরে নিয়ে গেল। বোধ হচ্চে এই কবিতাটি যিনি লিখেছেন তিনি মনে করচেন, তাঁর গৃহকার্য্যনিরতা অন্তঃপুরবাসিনী জন্মভূমি, তাঁর সমসাময়িক পাঠকমণ্ডলী, তাঁর কবিতাগুলির ঠিক ভাবগ্রহ করতে পারবেনা, তার যে কতখানি মূল্য সে তাদের জ্ঞানগোচর নয়, অতএব এখনকার মত এ সমস্ত পথেই ফেলে দেওয়া যাচ্চে, তোমরাও অবহেলা কর আমিও অবহেলা করি কিন্তু এরাত্রি যখন পোহাবে তখন “পষ্টারিটি” এসে এগুলি কুড়িয়ে নিয়ে দেশে বিদেশে চলে যাবে। কিন্তু তাতে ঐ জেলে লোকটার মনের আক্ষেপ কি মিটবে?—যাইহোক্, “পষ্টারিটি” যে অভিসারিণী রমণীর মত দীর্ঘরাত্রি ধরে ধীরে ধীরে কবির দিকে অগ্রসর হচ্চে এবং হয়ত নিশিশেষে এসে উপস্থিত হতেও পারে এ সুখকল্পনাটুকু কবিকে ভোগ করতে দিতে কারো বোধহয় আপত্তি না হতেও পারে।—সেই মন্দিরের কবিতার ঠিক অর্থটা কি ভাল মনে পড়চেনা। বোধহয় সেটা সত্যিকার মন্দির সম্বন্ধে। অর্থাৎ যখন কোণে বসে বসে কতকগুলো কৃত্রিম কল্পনার দ্বারা আপনার দেবতাকে আচ্ছন্ন করে নিজের মনটাকেও একটা অস্বাভাবিক সুতীব্র অবস্থায় নিয়ে যাওয়া গেছে এমন সময় যদি হঠাৎ একটা সংশয়বজ্র পড়ে, সেই সমস্ত সুদীর্ঘকালের কৃত্রিম প্রাচীর ভেঙে যায় তখন হঠাৎ প্রকৃতির শোভা, সূর্য্যের আলোক এবং বিশ্বজনের কল্লোলগান এসে তন্ত্রমন্ত্র ধূপধুনার স্থান অধিকার করে এবং তখন দেখতে পাই সেই যথার্থ আরাধনা এবং তাতেই দেবতার তুষ্টি।