ছিন্নমুকুল/ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দলিত কলি

 সন্ধ্যার অন্ধকারে নদীতীবে সিঁড়ির উপর বসিয়া কনকের আবার জলে ডুবিতে ইচ্ছা হইতেছিল। বালিকা সোপান প্রান্তের ক্ষুদ্র গাছগাছড়ার ডাল ভাঙ্গিয়া ক্ষুদ্রতর আকারে জলে ফেলিয়া দিতে দিতে পীড়িত হৃদয়ে ভাবিতেছিল—“সেও একদিন এই ক্ষুদ্র তৃণের মত ভাসিয়া গিয়াছিল—কেন তাহার মত অভাগিনীকে হিরণকুমার তখন বাঁচাইলেন! কেন হিরণকুমার তুমি বাঁচাইয়াছিলে? বাচাইলেই বা কি করিয়া বলিব? যে প্রাণ দিয়াছিলে তাহা তো আপনিই আবার কাড়িয়া লইয়াছ, কেবল যন্ত্রণা বই কনকের জন্য ত আর কিছুই রাখ নাই। এরূপ জ্বলন্ত আগুনে পোড়া অপেক্ষা কি জলে ডুবিয়া মরা ভাল ছিল না? না,না, বাঁচাইয়াছিলে বেশ করিয়াছ নহিলে এত যাতনা কে সহিত? নহিলে—নহিলে এত সুখই বা কে ভোগ করিত? নহিলে হিরণকুমার, তোমাকে দেখিবার সুখ, ভালবাসিবার সুখ কোথায় পাইতাম? এর পর এখন আজীবন কষ্ট পাই, সেও ভাল।”

 কনকের চিন্তা সহসা ভঙ্গ হইল; দেখিল নিকটে হিরণকুমার দণ্ডায়মান। সেই দুঃখের সময়, সেই যাতনা-পীড়িত মনের অবস্থায় সহসা হিরণকুমারকে দেখিতে পাইয়া বালিকার মনের ভাব কিরূপ হইল, বালিকা কিরূপ শান্তি পাইল, তাহা বলিবার নহে। নিমেষে যেন মন্ত্রবলে তাহার সকল দুঃখ দূর হইল! কিন্তু সেই এক সময়েই তাহার মনে আসিল, “কিন্তু এ দেখা কতক্ষণের? মুহূর্ত্ত মধ্যে হিরণকুমার চলিয়া যাইবেন, আর কখনও সম্ভবতঃ তাঁহাকে দেখিতে পাইবে না! যে জন আপনার হইতেও আপনার তাহাকে চিরকালের মত পর করিতে হইবে, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎও দূষণীয় বলিয়া গণ্য হইবে!” গভীর দুঃখে মর্ম্মস্থল হইতে তাহার দীর্ঘনিশ্বাস উঠিল। হিরণকুমারও ঠিক এইরূপই ভাবিতেছিলেন! তাঁহার হৃদয়েও এইরূপ দুঃখের তরঙ্গ বহিতেছিল! তিনিও দীর্ঘনিশ্বাস সহকারে কনকের মনের কথার প্রতিধ্বনি তুলিয়া কহিলেন, “সতাই কি আমাদের এ শেষ দেখা? শেষ বিদায়? যে আমার জীবনের চেয়েও আপনার তার সঙ্গে দেখা করতে আসাও কি আমার এখন অন্যায় কাজ?

 হিরণকুমার থামিলেন, কনক নীরবে অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিল। তিনি সবলে নিশ্বাস গ্রহণ করিয়া আবার বলিলেন “কনক, আমার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে উচিত অনুচিত জ্ঞান এখন নেই। আমার ব্যবহারে তোমার পাছে কোন কষ্টের কারণ ঘটে এই কেবল আমার এক মাত্র ভয়, এক মাত্র ভাবনা। চিরকাল পুড়ে মরি সেও স্বীকার কিন্তু তোমার ছায়াকেও আমা থেকে তিলমাত্র অমঙ্গল যেন স্পর্শ না করে। আমি এখনি চলে যাব, একটিবার শুধু তোমার নিজের মুখে আমার শেষ ভাগ্য শুনতে এসেছি। কনক, আমাদের কি সত্যই আর কোন আশা নেই? তোমার দাদা কেন এ বিবাহে অসম্মত?”

 কনক অশ্রু মুছিয়া বিকম্পিত স্বরে কহিল, “তিনি তোমাকে শত্রু মনে করেন?”

 হি। আমাকে শত্রু মনে করেন, আমি তাঁর কি করেছি?এ ভুল বিশ্বাস কি কোন রকমে ঘোচান যায় না?

 কনক নীরজার কাছে এ সম্বন্ধে যাহা কিছু শুনিয়াছিল তাহাই সংক্ষেপে বলিয়া বলিল, “তিনি যে তোমার উপর প্রসন্ন হবেন তা ত মনে হয় না। বিশেষ তাঁর যখন একান্ত ইচ্ছা আমার যামিনীনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়।”

 হিরণকুমার উন্মত্তের মত বলিলেন “কনক— সত্যিই কি তবে তুমি আর আমার হবে না? আমার এত আশা এত আকাঙ্ক্ষা সব মিথ্যা! তুমি অন্যের—

 কনক অটল স্বরে কহিল “না আমি অন্যের নই, দাদার অমতে আমি কাজ করতে পারব না, কিন্তু দাদার সহস্র অত্যাচারেও আমি অন্যকে আত্মসমর্পণ করব না।”

 কাহারও আর কথা কহিবার শক্তি রহিল না, দুজনে কেহ কাহাকেও স্পর্শ না করিয়া দুজনে কেহ কাহারও সহিত বাক্যালাপ না করিয়া দূরে দূরে দুজনের মুখের দিকে চাহিয়া দুজনের হৃদয় স্পন্দন এক বলিয়া অনুভব করিতে লাগিলেন। হিরণকুমার বলিলেন “কনক, আমরা মনে মনে দু’জনকে দু’জনে ভালবাসি, হৃদয়ে হৃদয়ে আমাদের বিবাহ হ'য়ে গেছে, কনক, তোমার দাদার মতের বিরুদ্ধে কি আমাদের বিবাহ হয় না?”  কনক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া নীরবে ঘাড় নাড়িয়া জানাইল—“না।”

 হিরণকুমার ভগ্ন হৃদয়ে বলিলেন,

 “তুমি আমার মত আমাকে পেতে ব্যগ্র নও বলেই ওরূপ বলছ, আমার মত ভালবাস না বলেই ওরূপ বলছ। তোমাকে না পেলে আমার চির জীবনের সুখ বিনষ্ট হবে জেনেও, তোমার দাদার একটু মনঃক্ষোভের ভয়ে তুমি আমাকে বলিদান দিতেও প্রস্তুত। কনক আমি যদি তোমার ভাই হতুম তা হ'লে এই স্বর্গীয় ভালবাসা আমার হ’ত!”

 হিরণের প্রত্যেক কথা গুলি তাহার হৃদয়ে বিদ্ধ হইল। কনক হিরণকে তেমন ভাল বাসে না, কেমন করিয়া হিরণকুমার এ কথা বলিলেন! কনকের কাহার জন্য তবে এত কষ্ট? কাহার জন্য এত জ্বালা? কাহাকে হৃদয় দিয়াছে বলিয়া ভ্রাতার কথায় অসম্মত, ভ্রাতার সহিত এরূপ মনোবিচ্ছেদ! ভ্রাতার অমতে কেবল কনক বিবাহ করিতে চাহে না বলিয়াই কি হিরণের এইরূপ মনে করা ঠিক! তাঁহার সহিত বিবাহ না হইলে যে কনক চিরকাল জীবন্তে মরিয়া থাকিবে হিরণকুমারের কি এই জ্ঞানটুকুও নাই? কিন্তু কনকের যতই কষ্ট হউক না, কর্ত্তব্যের বিপরীত কাজ কি করিয়া করিবে? ভ্রাতৃস্নেহ হইতে কনকের প্রণয় যতই বলবৎ হউক না, ভ্রাতার অমতে কাজ করিয়া ভ্রাতাকে কষ্ট দিবে কি করিয়া? হিরণ কেন এইটুকু বুঝিলেন না?

 হিরণ তুমি বড় নিষ্ঠুর! বালিকার এই দগ্ধ হৃদয়ে আরও জ্বালা দিলে। কনক যদি দেখাইতে পারিত তো দেখিতে, তুমি তাহাকে যত ভালবাস তাহা হইতেও সে তোমাকে অধিক ভালবাসে কি না। কিন্তু কনক বালিকা, কথা কহিতে জানে না, প্রকাশে অক্ষম, তাই তুমি আজ ও কথা বলিয়া তাহাকে যাতনা দিতে পারিলে!

 হিরণ আবার বলিলেন, “তবে কনক, আমি যাই, আজ অবধি সকল সুখে বিসর্জন দিতে যাই, তোমার জন্যই সকল জলাঞ্জলি দিব। আর আমার সংসারে কাজ কি; অর্থে কাজ কি? তোমাকেই যদি না পাই তবে আমার আর কিসে কাজ? আমি ধন সম্পদের আকাঙ্ক্ষী নহি, আমি পদমর্য্যাদার জন্যও লালায়িত নই। তোমাকে ভালবেসে কল্পনায় জীবনের মরুভূমেও যে নন্দনকানন সৃজন করেছিলুম, তুমিই স্বহস্তে যদি তাতে দাবানল জ্বাললে, তাহলে আমার এই শূন্য, উদ্দেশ্য-হীন জীবনে প্রয়োজন কি? আমি সংসার ছাড়ব, দেশে দেশে বনে বনে সন্ন্যাসী-বেশে ভ্রমণ করব, তাতে যদি তোমাকে ভুলতে পারি তো ভুলব, নইলে তোমারই মূর্ত্তি আজীবন ধ্যান করে কাটাব। তুমি অভাগাকে ভুলে যাও, আমার ভাবনা তোমাকে তিলমাত্রও যেন ব্যথা না দেয়। বিদায় তবে বিদায়, আর কখনো এ অভাগাকে দেখতে পাবে না।”

 হিরণের অর্দ্ধেক কথাও কনকের কর্ণে প্রবেশ করিল না, কনক তখন আপনাতে আপনি ছিল না। যখন কনকের চমক ভাঙ্গিল, যখন বালিকা কনকের আজ কথা ফুটিল, যখন সে বলিতে গেল, “হিরণকুমার আমার নিজের কষ্ট আজীবন সইতে পারি, কিন্তু তোমার কষ্ট কি করে সহ্য করব? তোমার কনক তোমার জন্য সমস্ত বিসর্জ্জন দিতে প্রস্তুত।” তখন মস্তক তুলিয়া কনক দেখিল, পার্শ্বে সেই আজন্মপরিচিত পথ ঘাট ও রক্ষাবলী, সম্মুখে সেই অনন্ত-কালপ্রবাহিনী গঙ্গা, কিন্তু হিরণকুমার আর এখানে নাই। কনকের হৃদয় ভাঙ্গিয়া গেল, বোধ হইল তাহার চরণতলে পৃথিবীর কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত যেন গহ্বর হইয়া গিয়াছে, কনক শূন্য অবলম্বন করিয়া রহিয়াছে। অজস্র অশ্রুধারা কনকের কপোল বাহিয়া পড়িতে লাগিল। হৃদয়ের অভ্যন্তর হইতে মর্ম্মভেদী কষ্টে অশ্রুধারা উথলিয়া উঠিল। কাঁদিতে কাঁদিতে কনক দ্রুতপদে ঘাট হইতে উঠিয়া খানিক দূর আসিল, কিন্তু সে বেশী দূর নহে। মর্ম্মাহত ক্ষুদ্র বালিকা আর কত পারিবে? তীরে একটী গাছতলায় আসিয়া আশ্রয় জন্য একটী শাখা ধরিল, ক্রমে হস্ত পদ শিথিল হইয়া বৃক্ষতলে মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িল।