ছিন্নমুকুল/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দেশানুরাগ

 নীরজা চলিয়া গেল, সন্ন্যাসীর সহিত সাক্ষাৎ হওয়ার কথা আর তাহাকে প্রমোদের বলা হইল না। যামিনীনাথকে বলিলেন, “ভাই, অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা করিতে পারি নি। আজ অসময়ে দেখে আশ্চর্য্য হয়ো না, বড় বিপদে পড়ে পরামর্শ নিতে এসেছি।”

 যামিনী ব্যগ্রতা দেখাইয়া বলিলেন, “কি কি, বিপদটা কি?”

 প্র। আজ হঠাৎ নীরজার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ।

 যামিনী। নীরজার পিতা! তিনি এখানে এসেছেন?

 প্র। হ্যাঁ, কিন্তু নীরজা এখানে তাত আমি জানতেম না, তাতে বড়ই ক্ষতি হয়েছে।

 নীরজাকে প্রমোদ দেখিতে পাইয়াছেন দেখিয়া যামিনীনাথ হাসিয়া এই কথার মধ্যে বলিলেন, “দেখ ভাই প্রমোদ, নীরজাকে নিয়ে মহা ব্যাপার হয়েছিল, সে অনেক কথা। সে সব তোমাকে বলবার জন্যে আমি খুবই ব্যগ্র হ’য়ে আছি। কবে এলাহাবাদ থেকে এসেছ সে খবরটাও কি দিতে নেই?”

 প্র। কেমন ঘটে ওঠে নি, অন্যায় হয়েছে স্বীকার করি। আমি নীরজার মুখে সে সব ব্যাপার এই মাত্র সবিশেষ শুনলেম, কি ভয়ানক। যামিনি, তুমি না বাঁচালে নীরজার কি দুর্দ্দশা হোত মনে করতেও—”

 যা। এখন ভালয় ভালায় তার বাপের হাতে তাকে দিতে পারলে হয়। এখানে যে সন্ন্যাসী এসেছেন ভালই হয়েছে। আমি যে কত চিঠিই তাঁকে লিখেছি ঠিক নেই, কাজে ব্যস্ত না থাকলে, নিজে গিয়ে এতদিন নীরজাকে কানপুরে রেখে পর্য্যন্ত আসতেম। যাক, তার পর সন্ন্যাসী তোমাকে কি বল্লেন?”

 প্রমােদের সহিত সন্ন্যাসীর যে কথা হইয়াছিল প্রমােদ সংক্ষেপে সে সকল বলিয়া কহিলেন “সন্ন্যাসী আমাকে কোন মতে বিশ্বাস করিলেন না, আমার মনে হচ্ছে দস্যুদের বৃত্তান্ত শুনলেও আমাকেই দোষী ভাববেন।”—

 যামিনীনাথ হাসিয়া বলিলেন “তুমি নির্দ্দোষী, তােমার ভয় কি, আমি আছি, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।”

 প্রমােদ বলি, “সন্ন্যাসী যদি নালিস করেন বিচারে যে আমি নির্দ্দোষ হব সে বিষয়ে আমার সন্দেহ নাই, সেজন্য ভাবি না। কিন্তু বিচারে নির্দ্দোষ হলেও পাছে সন্ন্যাসীর চক্ষে অপরাধী থাকি, আমার ভাবনা কেবল তাই। যা হ’ক সেত পরের কথা—নীরজা যে এখানে—এ খবর এখন তাঁকে কি করে দেওয়া যায়, তিনি কোথায় থাকেন তাত কিছুই জানি না।”

 যা। “তোমার কিছুমাত্র ভাবনা নেই, সন্ন্যাসী যখন এখানে এসেছেন আমি সন্ধান করে তাঁকে বার কবব এখন।”

 প্র। “কিন্তু—”

 প্রমোদকে কথা শেষ করিতে না দিয়াই যামিনী আবার বলিলেন “না না এর ভিতর “কিন্তু” কিছুই নেই। কি আশ্চর্য্য, কি ছেলেমানুষ! আজ কতদিন পরে দেখা, কোথায় আমরা একটু আমোদ প্রমোদ, গল্প স্বল্প করব, না তোমার ভাই এইসব মিথ্যা ভাবনা!

 প্র। কে জানে, ভাই আমার মন থেকে এ ভাবনাটা কোন মতেই যাচ্ছে না।*

 যা। “না, ভাই, তা হবে না আমোদ প্রমোদে তোমার আজ ও মিথ্যা ভাবনা তাড়াতেই হবে, চল আজ থিয়েটারে যাওয়া যাক। আজ থিয়েটারে পদ্মাবতী অভিনয় হবে জান?”

 প্রমোদ প্রথমে অনেক ওজর-আপত্তি করিয়া শেষে বলিলেন “এত রাত্রে থিয়েটারে যাব? সে যে অনেক দূব?”

 যা। “না, না, এই ভবানীপুরেই আজ একটা থিয়েটার করছে, চল যাওয়া যাক, সেতো কাছেই। তুমি অবশ্য খেয়ে আসনি, এইখানেই এস এক সঙ্গে খাই।”

 প্রমোদ অস্বীকৃত হইয়া বলিলেন “আমি খেয়ে এসেছি।” যামিনী তখন বলিলেন “তবে আমি খেয়ে আসি, তুমি বস, এসে একত্রে থিয়েটারে যাব।”

 প্রমোদের থিয়েটারে যাইতে বড় একটা ইচ্ছা ছিল না, প্রথমতঃ তাঁহার এখন থিয়েটারে যাইবার মতন মনের অবস্থাই নহে, তাহার পর আবার কয়েক মাস পূর্ব্বে যামিনীর সহিত থিয়েটার সার্কাস ইত্যাদি দেখিতে গিয়া তিনি একরূপ রিক্তহস্ত,—সেই জন্য তিনি প্রথমে দুই একবার ওজর করিলেন, কিন্তু যামিনী যখন তবুও তাঁহার পিঠ চাপড়াইয়া জোর করিয়া বলেন “তা কি হয়, চল যাওয়া যাক, আমি শীঘ্রই খেয়ে আসছি”—

 তখন আর প্রমোদ তাঁহার কথা অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না। যামিনী খাইয়া আসিবার পর তাঁরা দু’জনে থিয়েটার দেখিতে চলিলেন।

 যামিনীর মাথার তখন বড় একটা ঠিক ছিল না, বাড়ী হইতে দুই এক পাত্র তরল উত্তেজনায় উত্তেজিত হইয়া আসিয়াছিলেন। থিয়েটার গৃহে প্রবেশ করিবার সময় একজন কনেষ্টবলের গাত্রে গাত্র ঠেকায় তিনি অপমান বোধ করিয়া নিরপরাধ কষ্টেবলকে এক ঘুসি বসাইয়া দিলেন,

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, যামিনীনাথ বড় দেশানুরাগী। ভালই হৌক মন্দই হৌক বিদেশীয় অনুকরণের নামমাত্রেই জ্বলিয়া উঠেন, অথচ সুবিধার অনুরােধে ইংরাজী প্রথায় গৃহ সাজাইতে, বিলাসের অনুরােধে ইংরাজী বুট ট্রাউজার্‌স্ ও কোট পরিতে এবং সভ্যতার অনুরোধে হাতের পরিবর্ত্তে কাঁটা চামচ ব্যবহার করিতে কুণ্ঠিত হন না। বন্ধুদের অনুরােধে বিলাতী মদ্যের প্রতিও তাহার ঘৃণা ছাড়িতে হইয়াছিল।

বিদেশীয় অনুকরণের প্রতি তাঁহার যেমন ঘৃণা, ভারত-গৌরব-লােপকারী বিদেশীয়গণের প্রতিও তাঁহার তেমনি জাতক্রোধ; ভারতের অস্তমিত গৌরবদিন ফিরাইবার জন্য তিনি প্রাণপণ করিয়াছিলেন, এমন কি অনেক সময় স্কুলের ছাত্রদিগকে সমবেত করিয়া আর্য্যগরিমার পুনরুদ্দীপন বিষয়ে বক্তৃতাও দিতেন, গভর্ণমেণ্টকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া তিনি তাহাদের গালি দিয়া সংবাদপত্রে কয়েকবার লিখিয়াও ছিলেন, কিন্তু সেই গালি পড়িলে সহসা অনেকেরই তাহা প্রশংসা বলিয়া ভ্রম হইত। যাহা হউক, স্কুলের ছাত্রগণের প্রায় সকলেরই তাঁহার প্রতি অটল ভক্তি, দেশানুরাগী বলিয়া অনেকেরই নিকট তাঁহার বিলক্ষণ মান। প্রমোদও যামিনীকে বড় ভাল লোক বলিয়া মনে করিতেন। প্রমোদের মদে ঘৃণা ছিল, সুতরাং তাঁহার সাক্ষাতে পারতপক্ষে তিনি মদ খাইতেন না। যখন বা খাইতেন, তখন এমনি ভাণ করিতেন যেন নিতান্ত দায়ে পড়িয়া বন্ধুদের অনুরোধে কিম্বা শরীরের অনুরোধে তাহা খাইতে হইতেছে। যাই হোক, আজ দেশানুরাগের আতিশয্য বশতঃ যবনগাত্রে গাত্র স্পর্শ হইবামাত্র তাঁহার দেশানুরাগ দ্বিগুণ জলিয়া উঠিল, সেই দুরাচার যবনদিগের কথা স্মৃতিপথে উদিত হওয়াতে তাঁহার আর্য্যরক্ত ফেনিত হইয়া উঠিল, তিনি আর থাকিতে পারিলেন না। তাহাকে মারিয়া আজ মরিতে হয় সেও স্বীকার, আজ তাহাকে মারিয়া, ভারতবর্ষের শত সহস্র লোককে দৃষ্টান্ত দেখাইবেন, ভারতের পূর্ব্বদিন আজ তিনিই ফিরাইয়া আনিবেন মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া তাহাকে এক ঘুসী বসাইয়া দিলেন। কনেষ্টবলটিও ছাড়িয়া কথা কহিল না,যামিনীনাথের ঘুসী শুদসুদ্ধ ফিরাইয়া দিল। ক্রমে সেই কোলাহলে সেখানে লোক জমিতে লাগিল, প্রমোদ একটু অগ্রসর হইয়া থিয়েটার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিলেন গোল শুনিয়া তিনিও বাহিরে আসিয়া বন্ধুর দুর্দ্দশা দেখিয়া, সক্রোধে কনষ্টেবলের উপর পড়িলেন। মার খাইয়া যামিনীর ও নেশা ছুটিয়াছিল, এখন সাহায্য পাইয়া তিনিও ছাড়িলেন না, বিস্তর ইংরাজী কথা বলিতে বলিতে কনষ্টেবলকে বিশিষ্ট রূপে আহত করিয়া দুই বন্ধুতে সরিয়া দাঁড়াইলেন। কনষ্টেবল তাঁহাদের চিনিত, পর দিন সে তাঁহাদের নামে নালিশ করিল। নালিস নিয়া প্রমোদ বড় একটা দমিয়া গেলেন না, কেবল কনষ্টেবলের উপর আরও একটু বেশী মাত্রায় চটিলেন। ভাবিলেন, সে নালিস না করিয়া যদি পুরস্কার প্রার্থনা করিত তো তাহার পক্ষেই ভাল হইত, কিছু পাইয়া যাইত, নালিস করিয়া আর একবার মার খাইবার সূত্রপাত করিল মাত্র। প্রমোদের কেবল একটি বিষয়ে একটু মুস্কিল লাগিল। মোকদ্দমাতে তো উকিল ব্যারিষ্টার দিতে হইবে, এবং তা ছাড়া অন্যান্য খরচও তো আছে, কিম্বা যদি কি জানি মন্দটাই হয়, যদি দশ বিশ টাকা দণ্ডই লাগে, আগে হইতে ত এ সকল ব্যয়ের যোগাড় করা চাই। অর্থাভাবই তাঁহার প্রধান চিন্তার বিষয় হইয়া দাঁড়াইল। অন্ততঃ দুই শত টাকা এজন্য হাতে রাখা আবশ্যক বিবেচনা করিলেন। কিন্তু অত টাকা প্রমোদ কোথায় পান? কনকের কাছে অগত্যা তাহা চাহিয়া পাঠাইলেন। যামিনীর নিকট ধার চাহিতে তিনি লজ্জায় কোন মতে পারিয়া উঠিলেন না। আর ধার করিলে ও তো তাহা শীঘ্র শোধ করিতে হইবে। এ বিপদে কনক ছাড়া আর কে তাঁহাকে রক্ষা করে!