ছেলে-ভুল/পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গমন করিবার পর দুইটী বিষয় আমার মনে উদিত হইল।
১ম। বালকটীকে পরিত্যাগ করিয়া তাহার পিতামাতা গমন করিলে পর, যদি সেই বালক জাহাজের কোন দুশ্চরিত্র খালাসি বা আরোহীগণের মধ্যে কোন অসচ্চরিত্র লোকের নয়নগোচর হইয়া থাকে, তাহা হইলে অর্থলোভে তাহাকে বিনষ্ট করিয়া অনায়াসেই তাহার দেহ সে গঙ্গাগর্ভে নিক্ষেপ করিতে পারে। যদি আমার এই অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে বালকের অনুসন্ধান ত দূরের কথা, অলঙ্কারগুলিরও অনুসন্ধান হওয়া নিতান্ত সহজ হইবে না।
২য়। উলুবেড়িয়া ও কলিকাতার মধ্যবর্ত্তী কোন স্থানে কোন আরোহী যদি সেই বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে বালক ও তাহার অলঙ্কারের কিছু না কিছু সন্ধান হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। এরূপ অবস্থায় সেই পন্থাই অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া এক্ষণে আমার কর্ত্তব্য।
মনে মনে এইরূপ অনুমান করিয়া, আমি চাঁদপালঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে একখানি ডিঙ্গি ভাড়া করিয়া প্রথমে মেটিয়াব্রুজে এবং পরিশেষে বজবজে গিয়া সেই বালক সম্বন্ধে সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু সেই দুই স্থানে সেই বালকের কোনরূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, রাজগঞ্জ ও অপরাপর কয়েকস্থানে গমন করিলাম। সেই সকল স্থানেও বালকের কোন রূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, তিন চারিদিবস পরে নিতান্ত ক্ষুণ্ণ মনে কলিকাতায় প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম। আমার ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী ও বালকের পিতামাতা প্রভৃতি সকলেই জানিতে পারিলেন যে, আমার দ্বারা সেই বালকের অনুসন্ধান হইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। তথাপি আমি যে সেই বালকের অনুসন্ধান একবারে পরিত্যাগ করিলাম, তাহাও নহে।
যে কামরার ভিতর বালকটীকে ভ্রম-ক্রমে পরিত্যাগ করিয়া আসা হইয়াছিল, তাহার পার্শ্ববর্তী কামরার ভিতরে আরও একজন ভদ্রলোক তাঁহার পরিবারকে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ কথার একটু আভাস পাঠকগণ ইতিপূর্ব্বে পাইয়াছেন। আর ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহারা কলিকাতা পর্য্যন্ত আগমন করেন নাই। কলিকাতার বন্দরে জাহাজ আসিবার পূর্ব্বেই অপর কোন স্থানে তাঁহারা অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। সবিশেষ কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এক সপ্তাহকাল পরে আমি সেই ভদ্র পরিবারের অনুসন্ধান পাইলাম, এবং তাঁহাদিগের গ্রাম পর্য্যন্ত গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, তাঁহারা সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা অবগত নহেন, বা তাঁহারা সেই বালককে তাঁহাদিগের সঙ্গে আনেন নাই। সুতরাং নিতান্ত নিরাশ হইয়া আমাকে সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হইল। ক্রমে সেই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া আমি অন্য কার্য্যে নিযুক্ত হইলাম। বালকের পিতামাতাও ক্রমে আপনাপন হৃদয় হইতে তাঁহাদিগের সেই সন্তানের মায়া পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।
এই ঘটনার প্রায় একমাস পরে একখানি নোটের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাকে রাজগঞ্জে গমন করিতে হয়। যে মোকদ্দমা সম্বন্ধে আমি নোটের অনুসন্ধান করিতে গিয়াছিলাম, সেই মোকদ্দমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদান করা আমি তত আবশ্যক মনে করি না। কারণ, এরূপ মোকদ্দমা সম্বন্ধে একটী ঘটনা ডিটেক্টিভ পুলিস দ্বিতীয় কাণ্ড পুস্তকে আমি প্রকাশ করি, ইহাও ঠিক সেইরূপ ঘটনা। সেইরূপ উপায়ে জুয়াচোরগণ জুয়াচুরি করিয়া কুমারটুলির জনৈক দোকানদারের নিকট হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট গ্রহণ করে; কিন্তু সেই দিবস করেন্সি আফিস খোলা না থাকায়, তাহারা সেই নোট করেন্সি আফিসে বদলাইয়া লইবার অবকাশ পায় নাই। পরদিবস প্রাতঃকালেই প্রতারিত ব্যক্তি জানিতে পারে যে, সে জুয়াচোরগণ কর্ত্তৃক প্রতারিত হইয়াছে। সুতরাং প্রথমেই সে করেন্সি আফিসে গিয়া সেই নোটের নম্বর প্রদান করে, এবং সেই স্থানে এইরূপ লিখাইয়া আইসে যে, তাহার গৃহ হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট চুরি গিয়াছে।
এদিকে জুয়াচোরগণ যখন জানিতে পারে যে, করেন্সি অফিসে সেই নোট ভাঙ্গাইতে গেলে তাহারা ধৃত হইবে, তখন তাহারা করেন্সি আফিসে নোট ভাঙ্গাইবার আশা পরিত্যাগ করিয়া অপর আর এক উপায় অবলম্বন করে। শালিখার কোন ধান্যের আড়তে গমন করিয়া তাহারা পাঁচশত টাকা মূল্যের ধান্য খরিদ করে। তাহার মূল্যস্বরূপ উহারা সেই পাঁচশত টাকার নোট প্রদান করে। ধান্যের মহাজন সেই নোট অপরকে প্রদান করেন, সে পুনরায় উহা আর এক ব্যক্তিকে প্রদান করেন। এইরূপে ক্রমে সেই নোট বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আসিয়া উপস্থিত হয়। বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হইতে সেই নোট করেন্সি আফিসে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। করেন্সি অফিসের হস্তে সেই নোট গিয়া উপস্থিত হইলে, তাঁহারা জানিতে পারেন, সেই নোট পূর্ব্বে অপহৃত হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহারা পুলিসে এই সংবাদ প্রদান করেন, এবং সেই সময় হইতে ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হইলে, আমি ইহার সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারি। কিন্তু কোন্ কোন্ ব্যক্তি যে ধান্য খরিদ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, অত টাকার ধান্য যে কোথায় গেল, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। পরে জানিতে পারিলাম, পূর্ব্ব-কথিত আড়তদারের আড়ত হইতে ধান্য সকল প্রথমতঃ বাহির করিয়া একখানি নৌকা মেটিয়াব্রুজের নিকট লইয়া গিয়া, অপর দুইখানি পান্সিতে সেই সকল ধান্য পাল্টাইয়া লওয়া হয়, এবং সেই স্থান হইতে বড় নৌকাখানিকে বিদায় করিয়া দেওয়া হয়। জুয়াচোরগণ সেই ধান্যগুলি সেই ছোট নৌকা দুইখানিতে করিয়া রাজগঞ্জের বাজারে লইয়া যায়। সেই স্থানে সেই সকল ধান্য অল্প মূল্যে বিক্রয় পূর্ব্বক যতদূর সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।
আমিও সন্ধানে সন্ধানে ক্রমে রাজগঞ্জের বাজারে গিয়া উপস্থিত হই, এবং সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া, এই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারি। যে সকল ব্যক্তি সেই ধান্য ক্রয় করিয়াছিল, তাহাদিগের অনেককে খুঁজিয়া বাহির করিয়া, পরিশেষে জুয়াচোরগণের অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। এই অনুসন্ধান উপলক্ষে পাঁচ সাতদিবস আমাকে রাজগঞ্জের বাজারে অবস্থিতি করিতে হয়।