ছেলে-ভুল/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।


 রাজগঞ্জের বাজারের মধ্যে একটী দোকানে আমার বাসা। অবশ্য সেই সময়ে অনেকেই অবগত নহেন যে, আমি পুলিসকর্ম্মচারী। কারণ, সেই সময় পুলিসের পরিচ্ছদাদি কিছুই আমার সহিত ছিল না, বা আমিও পুলিসকর্ম্মচারী বলিয়া কাহারও নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলাম না।

 একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি সেই দোকানে বসিয়া আছি, এমন সময় একটী স্ত্রীলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং সেই দোকান হইতে কিছু দ্রব্যাদি খরিদ করিবার মানসে সেই স্থানে উপবেশন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আর একটী স্ত্রীলোেক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল ও পূর্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকটীকে দেখিয়া তাহার নিকট আসিয়া উপবেশন করিল, এবং উভয়ে নানারূপ গল্প করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদিগের কথাবার্ত্তার ভাবে অনুমান হইল, উহারা উভয়েই নিকটবর্ত্তী কোন গ্রামে বাস করে, এবং দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত উভয়েই, সেই বাজারে আগমন করিয়াছে।

 উভয়ের মধ্যে সেই স্থানে নানারূপ গল্প আরম্ভ হইল। নিজের কথা, সংসারের কথা, গ্রামের কথা প্রভৃতি কত কথার যে অবতারণা ও আলোচনা হইল, তাহার সংখ্যা নাই। সেই সকল কথাবার্ত্তার বিবরণ এই স্থানে লিপিবদ্ধ করা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আমার আবশ্যক যে দুই চারিটী কথা আমি জানিতে পারিলাম, তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদত্ত হইতেছে মাত্র।

 ১ম স্ত্রীলোক। কেমন ভাই উহার মা বাপ, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এরূপ শিশুসন্তানের নিমিত্ত কেহ এক বার অনুসন্ধানও করিল না।

 ২য় স্ত্রীলোেক। আমিও তাই দেখিতেছি; কিন্তু ভাই বালকটীর চেহারা দেখিয়া বোধ হয়, সে যেন কোন বড় ঘরের সন্তান।

 ১ম স্ত্রীলোক। চেহারা সেইরূপই বটে।

 ২য় স্ত্রীলোেক। আচ্ছা ভাই। ও কিরূপে সেই বালকটী পাইল?

 ১ম স্ত্রীলোক। তাহা ঠিক করিয়া সে কিছু বলে না। কখন বলে, সে রাস্তায় পড়িয়াছিল, সেইখানে উহাকে পাইয়াছে; কখন বলে, উহার মা বাপ নিতান্ত দরিদ্র বলিয়া, তাহাকে প্রতিপালন করিতে অসমর্থ, তাই তাহারা উহাকে অর্পণ করিয়া উহার নিকট হইতে কিছু অর্থ গ্রহণ করিয়াছে; কখন বলে, সে তাহার কোন আত্মীয়ের পুত্র, উহাকে প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত সেই আত্মীয় তাহাকে প্রদান করিয়াছে। এইরূপে উহার মনে যখন যেরূপ কথার উদয় হইতেছে, তখনই সে সেইরূপ বলিতেছে। প্রকৃত কথা যে কি, তাহা কিন্তু কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারা যাইতেছে না।

 ২য় স্ত্রীলোক। আমরা যতদূর অবগত আছি, তাহাতে জানি যে, উহার এরূপ কোন আত্মীয় নাই যে, সে তাহার পুত্রের প্রতিপালনের ভার উহার উপর ন্যস্ত করিতে পারে, বা উহার এরূপ সঙ্গতিও নাই যে, তাহার দ্বারা সে এই বালকটীকে ক্রয় করিয়া লইয়া নিজে উহাকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়।

 ১ম স্ত্রীলোক। আমারও বিশ্বাস তাহাই। আমিও ভাই ইহার কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমার মনে জাহাজে পরিত্যক্ত সেই বালকের কথা উদয় হইল। আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “হ্যাঁ গা! তোমরা কোন্ বালকের কথা বলিতেছ?”

 ১ম স্ত্রীলোক। আমাদিগের গ্রামের একটী স্ত্রীলোক একটী বালক পাইয়াছে, তাহারই কথা বলিতেছি।

 আমি। যে বালকটী পাইয়াছে, তাহার নাম কি গা?

 ১ম স্ত্রীলোক। তাহার নাম সোনা।

 আমি। সোনা সেই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছে, তাহা কিছু বলিতে পার কি?

 ১ম স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আপনি সেই বালকটীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?

 আমি। আমার একটী বালক হারাইয়া গিয়াছে, তাই আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।

 ১ম স্ত্রীলোক। আপনার বালকটী কোথা হইতে হারাইয়া গিয়াছে?

 আমি। সে আমার সহিত এই স্থানেই আসিয়াছিল, সেই সময় গোলমালে যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। অনেক স্থানে আমি তাহার অনুসন্ধান করিয়াছি, কিন্তু এ পর্য্যন্ত তাহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। এখন তোমাদের কথা শুনিয়া মনে আশা হইতেছে। তোমাদিগের সন্ধান মতে আমি যদি সেই বালকটীকে পাইতে পারি, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে একশত টাকা পারিতোষিক দিতে প্রস্তুত আছি।

 ২য় স্ত্রীলোক। সেই বালকটীকে যদি আমরা দেখাইয়া দিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগকে একশত টাকা আপনি প্রদান করিবেন?

 আমি। সেই বালকটী যদি তোমরা আমাকে দেখাইয়া দেও, তাহা হইলেই যে আমি একশত টাকা প্রদান করিব, তাহা নহে। সেই বালকটা যদি আমার হয়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ আমি তোমাদিগকে একশত টাকা প্রদান করিব।

 ১ম স্ত্রীলোক। আর যদি সেই বালকটী আপনার না হয়, তাহা হইলে আমরা কি কিছুই পাইব না?

 আমি। তোমরা যে একবারেই কিছু পাইবে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। যদি সেই বালকটী আমার হয়, তাহা হইলে তোমাদিগকে একশত টাকা নিশ্চয়ই প্রান করিব। আর যদি সেই বালকটী আমার না-ও হয়, তাহা হইলেও সেই বালকটীকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাদিগকে পাঁচ টাকা করিয়া প্রদান করিতেছি।

 এই বলিয়া আমি উভয় স্ত্রীলোকের হস্তে পাঁচ টাকা প্রদান করিলাম। বিনা-পরিশ্রমে পাঁচ টাকা পাইয়া তাহারা অতিশয় সন্তুষ্ট হইল ও কহিল, “আপনি সেই বালকটীকে দেখিবার নিমিত্ত কোন্ সময় গমন করিবেন?”

 আমি। যখন বলিবে, আমি সেই সময়ই গমন করিব। এখনই আমি তোমাদিগের সহিত গমন করিতে প্রস্তুত আছি।

 স্ত্রীলোকদ্বয়। সে-ই উত্তম; আপনি এখনই আমাদিগের সহিত আগমন করুন। আমরা এখনই সেই বালকটীকে, এবং যে সেই বালকটীকে আনিয়াছে, তাহাকে, দেখাইয়া দিতেছি।

 স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথা শুনিয়া আমি আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি করিলাম না। কেবলমাত্র একটী লোক সমভিব্যাহারে তাহাদিগের সহিত তখনই প্রস্থান করিলাম।

 বাজার হইতে বহির্গত হইয়া একটী ময়দান দেখিলাম। সেই ময়দানের মধ্য দিয়া এক ক্রোশ পথ গমন করিবার পর, একখানি গ্রাম দেখিতে পাইলাম। সেই গ্রাম অতিক্রম করিয়া অপর আর একখানি গ্রামে উপস্থিত হইলে সেই স্ত্রীলোকদ্বয় আমাকে কহিল, “এই গ্রামেই সেই স্ত্রীলোকের বাস।” আরও কহিল, “আপনারা এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা গিয়া দেখিয়া আসি, সেই স্ত্রীলোকটী এখন বাড়ীতে আছে কি না, এবং সেই বালকটীই বা এখন কোথায়।” তাহাদিগের প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম, উহারা উভয়েই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। অতি অল্পক্ষণ পরেই উহাদিগের একজন প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া কহিল, “আসুন মহাশয়! আমার সহিত আসুন, সেই স্ত্রীলোকটী এবং বালকটী এখন বাড়ীতেই আছে। আমি তাহাদিগকে স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি, ও আমার সমভিব্যাহারী সেই স্ত্রীলোকটীকে আমি সেই স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি।”

 আমি তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহার নির্দ্দেশমত তাহার সহিত গমন করিলাম। কিয়দ্দূর গিয়া সে আমাকে একখানি সামান্য খড়ের ঘর দেখাইয়া দিয়া কহিল, “ইহাই সেই স্ত্রীলোকটীর বাড়ী, এবং এই বাড়ীতে সেই বালকটীও আছে। আপনি এখন এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেই সেই বালকটীকে দেখিতে পাইবেন। তখন আপনি জানিতে পারিবেন যে, সেই বালকটী আপনার কি না।”

 সেই স্ত্রীলোকটীর কথা শুনিয়া আমি আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোেক একটী বালককে ক্রোড়ে করিয়া তাহার ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছে। তাহার সম্মুখে, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকদ্বয় গমন করিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে অপর স্ত্রীলোকটী বসিয়া তাহার সহিত গল্প করিতেছে।

 আমি ও আমার সমভিব্যাহারী লোকটী একবারে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে, আমাদিগকে দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটী যেন একটু ভীত হইল।

 আমি দেখিলাম, যে বালকটী উহার নিকট রহিয়াছে, তাহার আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই সেই জাহাজে-ভুল-ক্রমে পরিত্যক্ত বালকের সদৃশ। এক কথায় আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, এই বালকটীই কলিকাতার সেই বড়লোকটীর পুত্র।

 সেই স্ত্রীলোক কোন কথা বলিতে না বলিতেই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বালকটীকে তুমি কোথায় পাইলে?”

 স্ত্রীলোক। ইটি আমার পুত্র।

 আমি। তোমার নিজের সন্তান?

 স্ত্রীলোক। না, আমার নিজের সন্তান নহে; আমার ভগিনীর সন্তান। কিন্তু যখন আমি উহাকে প্রতিপালন করিতেছি, তখন আমারই সন্তান নয় ত কি?

 আমি। আমি ওসকল মিথ্যা কথা শুনিতে চাহি না। তুমি জান আমি কে? তোমাকে আমি পূর্ব্বেই সতর্ক করিয়া দিতেছি, তুমি মিথ্যা কথা কহিও না। মিথ্যা বলিলে তোমার সবিশেষরূপ অনিষ্ট ভিন্ন কখনই ইষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। আমি পূর্ব্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, তাহার পর তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। প্রকৃত কথা না বলিলে, আমি তোমাকে ধরিয়া লইয়া যাইব।

 স্ত্রীলোক। আপনি কে?

 আমি। আমি পুলিস-কর্ম্মচারী। তুমি এই বালকটীকে অপহরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছ। তোমার নামে বালক-চুরির নালিশ হইয়াছে, তাই আমি তাহার অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছি, এবং মাল, আসামী, উভয়ই পাইয়াছি। এখন তুমি আমার নিকট প্রকৃত কথা বলিবে কি?

 স্ত্রীলোক। আমি প্রকৃতই বলিতেছি, আমি এই বালককে চুরি করিয়া আনি নাই।

 আমি। যদি চুরি করিয়া না আনিলে, তাহা হইলে তুমি ইহাকে পাইলে কোথায়?

 স্ত্রীলোক। কোন স্থানে পড়িয়াছিল, দেখিয়া আমি উহাকে উঠাইয়া আনিয়া যত্নে প্রতিপালন করিতেছি। আমি চুরি করিয়া আনিব কেন?

 আমি। যদি তুমি ইহাকে অপহরণ করিয়া আন নাই, তাহা হইলে ইহার পিতামাতার নিকট তুমি ইহাকে লইয়া যাও নাই কেন?

 স্ত্রীলোক। আমি জানি না উহার পিতামাতা কে?

 আমি। থানায় গিয়া ইহাকে জমা দেও নাই কেন?

 স্ত্রীলোক। বালক পাইলে যে থানায় গিয়া জমা দিতে হয়, তাহা আমি জানি না। আমি মনে করিয়াছিলাম, যাহার বালক, সে আসিয়া লইয়া যাইবে।

 আমি। এই বালকটী পড়িয়াছিল, আর তুমি যে ইহাকে পাইয়াছ, এই কথা কাহাকেও বলিয়াছ?

 স্ত্রীলোক। না।

 আমি। কেন বল নাই?

 স্ত্রীলোক। ভয়ে বলি নাই।

 আমি। তুমি এই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছিলে?

 স্ত্রীলোক। যে স্থানে পাইয়াছিলাম, সেই স্থানের নাম আমি অবগত নহি। আমার সহিত চলুন, আমি দেখাইয়া দিব।

 আমি। কোন্ স্থানে পড়িয়াছিল?

 স্ত্রীলোক। একটী ময়দানের মধ্যে।

 আমি। মিথ্যা কথা। তুমি ইহাকে ময়দানের মধ্যে পাইয়াছ, তাহা আর কে অবগত আছে?

 স্ত্রীলোক। আর কেহই জানে না।

 আমি। এখন আর মিথ্যা কথা বলিও না। কোন একখানি জাহাজের মধ্য হইতে তুমি ইহাকে উঠাইয়া আনিয়াছ, আর এখন মিথ্যা করিয়া বলিতেছ, একটী ময়দানে এ পড়িয়াছিল।

 স্ত্রীলোক। না, আমি জাহাজ হইতে আনি নাই। আমি জাহাজে কি করিতে যাইব?

 আমি। ইহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, সেই সকল অলঙ্কার কোথায়?

 স্ত্রীলোক। ইহার অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না।

 আমি। আমি তোমাকে এখনও সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, তুমি এখনও প্রকৃত কথা বল। অলঙ্কারের সহিত তুমি ইহাকে জাহাজ হইতে আনিয়াছ কি না?

স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আমি ইহাকে জাহাজ হইতে আনি নাই।

 আমি। আমি এখনই তোমার ঘর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিব। তোমার ঘর হইতে যদি কোন অলঙ্কার বাহির হয়, তাহা হইলে তুমি জানিও যে, কোনরূপেই তোমার নিষ্কৃতি নাই।

 স্ত্রীলোক। অনায়াসেই আপনি আমার ঘর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে পারেন।

 স্ত্রীলোকের শেষ কথাটী শুনিয়া আমার মনে একটু সন্দেহ হইল। একবার ভাবিলাম, হয় ত প্রকৃতই এ অলঙ্কারের সহিত জাহাজ হইতে এই বালকটীকে আনয়ন করে নাই। অপর কোন ব্যক্তি জাহাজ হইতে ইহাকে আনিয়া উহার অঙ্গ হইতে অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়া ইহাকে কোন স্থানে নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। পরিশেষে এই স্ত্রীলোকটী ইহাকে সেই অবস্থায় দেখিতে পাইয়া উঠাইয়া আনিয়াছে।

 মনে মনে এইরূপ একবার ভাবিলাম সত্য; কিন্তু উহার কথায় আমি একবারে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। উহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার ঘর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।

 সেই স্ত্রীলোকটী যখন দেখিল যে, আমি উহার ঘর অনুসন্ধান করিতে কোনরূপেই নিবৃত্ত হইলাম না, তখন সে আমার দুইখানি পা জড়াইয়া ধরিয়া কঁদিতে কাঁদিতে কহিল, “আমি প্রকৃত কথা বলিতেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর মিথ্যা কথা বলিব না, আমি জাহাজ হইতে ইহাকে আনয়ন করিয়াছি।”

 আমি। অলঙ্কারগুলি?

 স্ত্রীলোক। আমার ঘরে আছে।

 আমি। বাহির করিয়া আন।

 আমার কথা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোকটী আপন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও মৃত্তিকা নির্ম্মিত একটী পুরাতন হাঁড়ির মধ্য হইতে কতকগুলি মূল্যবান্ অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। সেই বালকের অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার একটী তালিকা তাহার পিতা পূর্ব্বেই আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন, এবং তালিকার নকল আমার পকেট বহিতে লেখা ছিল। তাহার সহিত আমি গহনাগুলি মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, কেবলমাত্র একখানি ছোট গহনা ব্যতীত আর সমস্ত গুলিই উহাতে আছে। সেই গহনাখানির কথা জিজ্ঞাসা করায়, সে কহিল, “ওই গহনাখানি উহার অঙ্গে ছিল না, আমি উহা পাই নাই। যখন আমি সমস্ত গহনাই বাহির করিয়া দিতে পারিলাম, তখন সেই সামান্য গহনাখানি লইয়া আমি কি করিব?”

 সেই স্ত্রীলোকের এ কথা কিন্তু আমি বিশ্বাস করিলাম না। আমার মনে সন্দেহ হইল, সেই ছোট গহনাখানি সে কোথায় বিক্রয় করিয়া তাহার দ্বারা নিজের ও বালকের আহারের খরচের সংস্থান করিতেছে। সুতরাং সেই সামান্য একখানি গহনার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া আর সবিশেষ পীড়াপীড়ি করিলাম না। গহনাগুলি ও বালকটীকে সঙ্গে লইয়া আমি পূর্ব্ব-কথিত সেই বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে দুইটী স্ত্রীলোকের নিকট হইতে আমি এই সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, যাইবার সময় তাহাদিগকে বলিয়া গেলাম যে, তৎপরদিবস বৈকালে তাহারা যেন আমার সহিত সেই বাজারে সাক্ষাৎ করে। সেই সময় তাহাদিগের প্রাপ্য পারিতোষিকের টাকা তাহাদিগকে প্রদান করিব। উহারা আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও সেই স্থান হইতে বালক, অলঙ্কার প্রভৃতি লইয়া বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বাজারে পৌঁহুছিয়া সেই বালকের পিতা সেই বড় মানুষটীকে তথায় আনিবার নিমিত্ত দ্রুতগতি একটী লোক পাঠাইয়া দিলাম।

 পরদিবস অতি প্রত্যুষেই বালকের পিতা লোজনের সহিত তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং বালকটীকে দেখিয়াই ক্রন্দন করিয়া ফেলিলেন। পূর্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকদ্বয়কে আমি যে পারিতোষিক প্রদান করিতে স্বীকার করিয়াছিলাম, তাহা তাঁহার নিকট বলিবামাত্র তিনি সেই টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পূর্ব্বদিনের কথা ও বৈকালে সেই স্ত্রীলোকদ্বয় আগমন করিলে, আমি সেই অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিলাম। বালকের পিতা উভয়কে আরও পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিলেন, এবং যে স্ত্রীলোকটীর নিকট হইতে বালকটী ও গহনাগুলি পাওয়া গিয়াছিল, তাহার পারিতোষিক স্বরূপ তিনি দুইশত টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। কিন্তু আমি কহিলাম, এই স্ত্রীলোকটী যে অপরাধ করিয়াছে, তাহার নিমিত্ত ইহার দণ্ড হইবে, কি ইহাকে পারিতোষিক প্রদান করা যাইবে? উত্তরে তিনি কহিলেন, “ও যে অপরাধ করিয়াছে, আইনে তাহার দণ্ড থাকিলে, উহার দণ্ড হওয়া উচিত; কিন্তু আমার পুত্রটীকে যে জীবিত অবস্থায় রাখিয়া এ পর্য্যন্ত উহাকে খাওয়াইয়াছে, পরাইয়াছে, তাহার নিমিত্ত উহাকে দুইশত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিতেছি।”

তাঁহার নিকট হইতে আমি সেই দুইশত টাকা গ্রহণ করিলাম সত্য; কিন্তু এরূপ অবস্থায় আমার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ ব্যতীত আমি তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিতে সাহসী হইলাম না।

 যে একখানি সামান্য অলঙ্কার পাওয়া গেল না, বালকের পিতামাতা, চাকর-চাকরাণী প্রভৃতি কেহই স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, যে সময় ভুল-ক্রমে বালকটীকে পরিত্যাগ করা হইয়াছিল, সেই সময় সেই অলঙ্কারখানি তাহার অঙ্গে ছিল কি না?

 কিরূপে সেই স্ত্রীলোকটী বালককে পাইল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, কোন কার্য্য উপলক্ষে দুই তিনদিবস পূর্বে সে উলুবেড়িয়ায় গমন করিয়াছিল। সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার সময় যে জাহাজ হইতে বড়লোকটী সপরিবারে উলুবেড়িয়ায় অবতরণ করেন, সে উলুবেড়িয়া হইতে সেই জাহাজে উঠিয়া আপনার গ্রামে আগমন করিতেছিল। জাহাজে উঠিয়া যে কামরায় ওই বালকটী ছিল, সে সেই দিকে গমন করে, এবং দেখিতে পায়, সেই কামরায় একখানি বেঞ্চের উপর ওই বালকটী অলঙ্কার-ভূষিত হইয়া নিদ্রিত রহিয়াছে। বালকটীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, কিয়ৎক্ষণ সে সেই স্থানে অপেক্ষা করে; কিন্তু সেই স্থানে উহার কোন লোকজনকে দেখিতে না পাইয়া, ভুল-ক্রমে কেহ তাহাকে ফেলিয়া গিয়াছে, এই ভাবিয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে লইয়া যায়।

 বালক, বালকের পিতা, অলঙ্কার ও সেই স্ত্রীলোকটীকে লইয়া আমি কলিকাতায় আসিলাম, এবং আমার সর্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাকে সকল কথা বলিলাম। সেই স্ত্রীলোকের উপর মোকদ্দমা চালান যাইতে পারে, আইনে এরূপ কোন বিধান না পাওয়ায়, তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল, এবং বালকের পিতার ইচ্ছানুযায়ী প্রদত্ত পূর্ব্ব-কথিত দুইশত টাকাও তাহাকে প্রদান করা হইল। সে হাসিতে হাসিতে আপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিল।

 বলা বাহুল্য যে, এই বালকের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমিও আমার সমস্ত খরচ-পত্রাদি ও উপযুক্ত পরিতোষিক যথাসময়ে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম।

সম্পূর্ণ।


★ অগ্রহায়ণ মাসের সংখ্যা,

“রাণী না খুনি?”

(অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস

করিবার চূড়ান্ত ফল!)

যন্ত্রস্থ।