ছোট্ট রামায়ণ/আদিকাণ্ড

আদিকাণ্ড

সরযূ নদীর তীরে অযোধ্যা নগর,
দেবতার পুরী হেন পরম সুন্দর।
সোনা মণি মুকুতায় করে ঝলমল,
ছায়া লয়ে খেলে তার সরযূর জল।
বড় ভালো দশরথ সে দেশের রাজা,
দুঃখী জনে দেন সুখ, শঠে দেন সাজা।
রানী তাঁর তিনজন, পরীর মতন,
দেবতা সেবায় সদা কৌশল্যার মন।
কৈকেয়ী রূপসী বড়, থাকেন আদরে,
সুমিত্রা সরলা তাঁর মুখে মধু ঝরে।

ছেলে নাই, আহা তাই ব্যথা বড় মনে,
কত পূজা করে রাজা আনি মুনিগণে।
আসিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ মুনিমহাশয়,
শিঙ নেড়ে কথা কন, দেখে লাগে ভয়।
ভারি যজ্ঞ করিলেন সেই মুনিবর,
‘পুত্রেষ্টি’ তাহার নাম, দেখিতে সুন্দর।
আগুনে ঢালিয়া ঘৃত, যত মুনিগণে
সুগভীর সুরে মন্ত্র পড়েন সঘনে।
সে আগুন হতে তায়, পায়স লইয়া,
লালবেশে দেবদূত আসিল উঠিয়া।

কালো মুখে হাসি, তাহে ঘোর দাড়ি জট,
লাল চোখ পাকাইয়া তাকায় বিকট।
রাজারে পায়স দিয়া কহিল সেজন,
‘রানীদের দাও গিয়া করিতে সেবন।’
এতেক বলিয়া দূত গেল মিলাইয়া,
সুখে খান রানীগণ পায়স বাটিয়া।

তাহার পরে বছর গেলে,
রাজার হল চারিটি ছেলে।
আদরে তুলে নিলেন বুকে,
সুখের হাসি ফুটিল মুখে।
বাজনা বাজে মধুর স্বরে,
শঙ্খ বাজে ঠাকুরঘরে।
কাঙাল হাসে কতই পেয়ে,
নড়িতে নারে মিঠাই খেয়ে।


মুনি রাখিলেন নাম, বড় ছেলে হল রাম,
মাতা হন কৌশল্যা যাহার,
কৈকেয়ী রানীর ঘরে জনমে যে তাহার পরে
ভরত হইল নাম তার।
লক্ষণ শত্রুঘ্ন আর, দুই ছেলে সুমিত্রার,
দুই ভাই ছোট সকলের,
চারিটি চাঁদের মতো  চারি ভাই বাড়ে যত
দেখে চোখ জুড়ায় লোকের।

স্নেহে মিলে চারি ভাই,  খেলা করে এক ঠাঁই,
হয়ে সবে এক প্রাণ মন,
লেখাপড়া যত হয়,  সকল শিখিয়া লয়,
যাহা কিছু জানে গুরুজন।
তীর খেলা কত মতো, শিখিল তা, কব কত?
মহাবীর হল চারি ভাই,
যারে ধরে একবার,  আকাশ পাতালে তার
পালাবার নাহি রহে ঠাঁই।


একদিন রাজা  আছেন বসিয়া
সিংহাসনে আপনার,
বিশ্বামিত্র মুনি  এমন সময়ে
এলেন সভায় তাঁর।
রাজা কন, ‘প্রভু,  কিসের লাগিয়া,
আসিলেন মোর পাশ?’
মুনি কন, ‘হায়  দুষ্ট নিশাচর
সকল করিল নাশ।
লুকায়ে আসিয়া  রকত ঢালিয়া
মোর যজ্ঞ করে মাটি,
দিন কয় তরে  দেহ গো রামেরে,
রাক্ষস দিবে সে কাটি।’
ত্রাসে দশরথ  কহেন কাঁপিয়া
‘তাও কি কখনো হয়?

রাক্ষসের মুখে  কেমনে বাছারে
পাঠাইব মহাশয়!’
শুনিয়া অমনি  উঠিলেন মুনি
বিষম রোষেতে জ্বলি;
হয় সর্বনাশ দেন বুঝি শাপ
না জানি কি কথা বলি!
ভয়ে সভাজনে  কহে, ‘মহারাজ!
দেহ দেহ রামে আনি,
ভালো হবে তার,  মুনির কৃপায়,
না হবে কোনোই হানি।’
শুনিয়া তখনি  রাম লক্ষ্মণেরে
দেন রাজা আনাইয়া।
মহা খুশি হয়ে  যান মুনি তায়
দুইটি ভাইকে নিয়া।


রণবেশে দুই ভাই সাজি তারপর,
মুনির সহিত যান লয়ে ধনু শর।
গুরুজন খান চুমো তাঁদের মাথায়,
দেবতার নাম লয়ে করেন বিদায়।
পথে রাম শিখিলেন সরযূর তটে
দুই বিদ্যা অদ্ভুত মুনির নিকটে।
এক তার ‘বলা’, তাহে যায় রোগ ভয়,
‘অতিবলা’ আর, তাতে হয় রণে জয়।
দুইদিন পরে তাঁরা হন গঙ্গা পার,

তারপরে ঘন বন, বড় অন্ধকার।
রামেরে বলেন মুনি, ‘হেথায়, রে ধন,
তাড়কা রাক্ষসী থাকে বিকট বদন।
রক্তখাকী হতভাগী ভারি বল ধরে,
লোকজন মেরে বন করেছে নগরে;
এই পথে যেই যায়, তারে খায় গিলে,
আপদে মারহ বাপ দুই ভাই মিলে।’

মরিবে রাক্ষসী বুড়ি, রক্ষা নাই তার,
তখনি দিলেন রাম ধনুকে টঙ্কার।
‘টং-টং’ রবে তার রুষি ভয়ঙ্কর,
দাঁত কড়মড়ি বুড়ি কাঁপে থর-থর।
‘হাঁই-মাঁই-কাঁই’ করি ধাঁই-ধাঁই ধায়,
হুড়মুড়ি ঝোপঝাড় চুরমারি পায়।
গরজি-গরজি বুড়ি ছোটে, যেন ঝড়,
শ্বাস বয় ঘোরতর ঘড়র-ঘড়র।
কান যেন কুলো তার, দাঁত যেন মূলো,
জ্বলজ্বল দুই চোখে জ্বলে যেন চুলো।
হাঁ করেছে দশ গজ, তাহে জিভ খান,
লকলকে চকচকে দেখে ওড়ে প্রাণ।
বিষম ধূলার ঘোরে দোহারে ঘেরিয়া,
পাথর চুড়িয়া বুড়ি মারে চেঁচাইয়া।
কোনো ডর নাহি পায় তাহে দুই ভাই,
ডাক শুনি লাখ বাণ মারে সাঁই-সাঁই।
দেখা দিল বুড়ি তাই ফাঁপর হইয়া,

পাহাড় বেরুল যেন দাঁত খিঁচাইয়া।
হাত নাক কান কাটি, বুকে হানি বাণ,
দুজনে তখন তার বধিল পরান।
মুনির মুখেতে হাসি ধরে নাকো আর
‘বেঁচে থাক’ ‘বেঁচে থাক’ বলে বারবার।
মহা-মহা শেল শূল দেন কত রামে,
দেবতা অসুর কাঁদি ভাগে যার নামে।
যতনে তখন লয়ে ভাই দুইজনে,
ফিরিয়া গেলেন মুনি নিজ তপোবনে।
যজ্ঞ করে মুনিগণ বসিয়া সেথায়,
রাক্ষস আসিয়া দেয় রক্ত ঢালি তায়।
তারপর পাঁচদিন মিলি দুইজনে,
পাহারা দিলেন সেথা বড়ই যতনে।
যজ্ঞের আগুন যেই জ্বলিল তখন,
মেঘের উপরে হল ভীষণ গর্জন।
তাহা শুনি দুই ভাই দেখেন চাহিয়া,
রাক্ষস খিঁচায় দাঁত আকাশ ছাইয়া।
জালাপানা মুখ আর ঝাঁটপানা চুল,
কানে আঙ্গুটির গোছা, হাতে শেল শূল।
মেঘের আড়ালে থাকি মারে উঁকি-ঝুঁকি
পচা রক্ত ঢালি দেয় বারবার শুঁকি।
দুইটা পালের গোদা, বিষম বিকট,
মারীচ, সুবাহু নাম, অতি বড় শঠ।
মানব নামেতে বাণ জুড়িয়া ধনুকে,
ছুড়িয়া মারেন রাম মারীচের বুকে।

সেই বাণ খাইয়া বেটা, ঘোরে বন্-বন্,
সাগরে পড়িল গিয়া হয়ে অচেতন।
অগ্নিবাণ খেয়ে গেল সুবাহু মরিয়া,
বায়ুবাণে আরগুলো মরে চেঁচাইয়া।
যজ্ঞের আপদ গেল, দূর হল ভয়,
আনন্দেতে মুনিগণ বলে জয়-জয়।

তখন  সবাই মিলে  যান মিথিলায়
বোঝাই দিয়ে গাড়ি,
সেথায়   যজ্ঞ হবে   জবর জাঁকাল
জনক রাজার বাড়ি।
আছে   ধনুক সেথায়   কেউ নাকি তায়
গুণ পরাতে নারে,
শুনে   মুনির সাথে   দুভাই সুখে
দেখতে চলে তারে।
কত   সবুজ মাঠে,   নদীর তীরে
পথ গিয়েছে ঘুরে,
আহা,  শূন্য পড়ে   তাহার ধারে
এ কোন মুনির কুঁড়ে?
মুনি   তার কাহিনী   কহেন রামে
গৌতমেরে স্মরে,
‘জায়া   অহল্যারে   শাপেন তিনি
বিষম দোষের তরে।
হেথায়   থাকবে পড়ে   ছাইয়ের পরে
বাতাস কেবল খাবে।

হাজার  বছর ধরে  কেউ তোমারে
দেখতে নাহি পাবে।
শেষে  রামকে দেখে  দুখ ফুরাবে
ফিরব আমি ঘরে।
বলেই  অমনি চলে  যান হিমালয়
দারুণ রাগের ভরে।
দেবী  ভাবেন হরি  হেথায় পড়ি,
কঠিন সাজা সয়ে।
চল,  তোমায় দেখে  এবার তিনি
উঠুন সুখী হয়ে।’
তখন  সবাই মিলে  সেদিক পানে
চলেন তাঁরা ধেয়ে,
কুটির   উজল করি   উঠেন দেবী।
রামের দেখা পেয়ে।
তাঁরে  দেখতে পেয়ে  দুভাই গিয়ে
পড়েন চরণ তলে,
দেবী  অমনি তুলে  নিলেন কোলে
ভাসল নয়ন জলে।
গৌতম  এলেন ঘরে   সেই সময়ে
এলেন ততক্ষণ,
আবার   দুজন মিলে  হরির পূজায়
দিলেন তাঁরা মন।

সেথা হতে মিথিলায় যান তিনজন,
দুভায়ে দেখিয়ে ভোলে সকলের মন

জনক বলেন ‘আহা, কেমন সুন্দর।
কাহার কুমার এরা কহ মুনিবর।’
মুনি বলেন, ‘দশরথ রাজা অযোধ্যার,
শ্রীরাম, লক্ষ্মণ এরা তাহার কুমার।
তাড়কা মারীচে মারি এসেছে হেথায়,
তোমার ধনুকখানি দেখিবারে চায়।’
রাজা বলেন, ‘বাছা সব থাকুক বাঁচিয়া
ধনুক দেখাই আমি এখুনি আনিয়া।
শিবের ধনুক সেটি, দিল দেবগণ,
গুণ দিতে নাহি তায় পারে কোনো জন।
গুণ দিবে দূরে থাক, তুলিতে না পারে,
লাজ পেয়ে শেষে চায় মারিতে আমারে।
সে ধনুকে যদি রাম পারে গুণ দিতে,
সীতার বিবাহ দিব তাহার সহিতে।’

শুনহ সীতার কথা সবে মন দিয়া,
ডিম্বের ভিতরে কন্যা ছিল লুকাইয়া।
চাষ করে মহারাজ লইয়া লাঙ্গল,
সেই কালে চারিদিক হইল উজল।
তখন দেখিল রাজা চাহিয়া সম্মুখে,
আশ্চর্য উঠেছে ডিম্ব লাঙ্গলের মুখে।
দেবতা সমান কন্যা তাহার ভিতরে,
সুখে তারে মহারাজ নিল বুকে করে।
সীতে থেকে উঠে তাই নাম তার সীতা,
জুনকেরে কয় সবে সে মেয়ের পিতা।

রাজা কন, ‘ধনুকেতে যেই গুণ দিবে,
সেই সে সীতারে মোর বিবাহ করিবে।’

 না জানি কতই ভারি ছিল ধনুখানি!
অনেক হাজার লোকে আনে তারে টানি।
ভয়ঙ্কর সেই ধনু তুলি বাম হাতে,
হাসিতে-হাসিতে রাম গুণ দেন তাতে।
তারপর গুণ ধরি দিল এক টান,
‘মট’ করি হর-ধনু ভেঙ্গে দুইখান।
ভয়ে তায় চোখ বুজি, কানে দিয়ে হাত,
‘বাপ!’ বলি কত বীর হয় চিৎপাত।
বড়ই হলেন সুখী জনক তখন,
রামেরে আদর করি কত কথা কন।
বিবাহের কথা স্থির হইল ত্বরায়,
লিখন লইয়া দূত যায় অযোধ্যায়।
পত্র পান দশরথ বসিয়া সভায়—
‘শ্রীরাম সীতার বিয়ে এস মিথিলায়।’
রাজা কন, ‘কি আনন্দ চলহ সকলে!’
অমনি সাজিল সবে ‘রাম জয়’ বলে।
হাতি ঘোড়া, লোকজন ঢাক ঢোল নিয়া,
মহানন্দে মহারাজ চলেন সাজিয়া।
চারদিনে যান রাজা মিথিলা নগরে,
জনক নিলেন তারে পরম আদরে।

শুন কি সুন্দর কথা হইল তখন।

সেথা ছিল চারি কন্যা লক্ষ্মীর মতন।
ঊর্মিলা নামেতে কন্যা জনক রাজার,
ভাইঝি মাণ্ডবী তার, শ্রুতকীতি আর।
সীতারে লইয়া তারা হয় চারিজন,
চারি পুত্র দশরথ রাজার তেমন।
মুনিগণ বলে, ‘আহা, কিবা চমৎকার,
ছেলে মেয়ে নাই হেন কোনোখানে আর।
এই সব ছেলে যদি এই মেয়ে পায়,
বড় ভালো, মহারাজ, হইবেক তায়।’
জনক বলেন, ‘বেশ,ভালো তো কহিলা,
শ্রীরামে দেই সীতা,লক্ষ্মণে ঊর্মিলা,
শত্রুঘ্নরে শ্রুতকীতি, মাণ্ডবী ভরতে,
একদিনে চারি বিয়ে হোক এই মতে।’


তখন মিথিলাপুরী করে টলমল,
কি আনন্দ, কত গান, পূজা কোলাহল।
লাগিল ভোজের ধুম বাজিল বাজনা,
ঢাক, ঢোল, কাড়া, কাঁসি, না হয় গণনা।
আলো করে ঝলমল, ধূপধুনা জ্বলে,
যতনে সাজায়ে কন্যা আনিল সকলে।
অগ্নির সম্মুখে বসি জনক তখন,
চারি বরে কন্যা দেন করিয়া যতন।
কতই মুকুতা মণি দাস-দাসী আর
মেয়েদের দেন রাজা শেষ নাই তার।
তারপর আশীর্বাদ করিয়া সকলে,

বিশ্বামিত্র মুনি যান হিমালয়ে চলে
মহারাজ দশরথ ছেলে বউ নিয়া,
মনের সুখেতে যান বিদায় হইয়া।


নিয়ে  বউ সকলে  মনের সুখে
চলেন সবাই ঘরে,
তখন পথের মাঝে  কাঁপেন তাঁরা
পরশুরামের ডরে।
সে যে বাঘের মতো  বিষম রাগী,
কুড়াল নিয়ে ফেরে।
নাহি ডরায় কারে বড়ই চটে
দেখলে ক্ষত্রিয়েরে।
মুনি কুড়াল দিয়ে তাদের সবে
কেটেছে একুশবার।
তাতেই  ভয়েতে তারা হয় যে সারা
নামটি শুনেই তার।
রাজা  কতই আদর করেন তারে
‘আসুন-আসুন’ বলে।
মুনি না চায় ফিরে,  রামকে দেখে।
গেল সে রাগে জ্বলে।
বলে, ‘শিবের ধনুক ভেঙেই বুঝি
হয়েছ ভারি বীর?
আমার ধনুকটিতে গুণ পরিয়ে
চড়াও দেখি তীর!’

শ্রীরাম  ধনুক নিয়ে  অমনি তাতে
দিলেন টেনে গুণ,
পরে  বানটি হাতে  নিতেই মুনির
মুখ তো হল চুন!
তখন  রাম ভাবিলেন  ‘এ বাণ খেলেই
যাবেন ঠাকুর মরে,’
কাজেই  অপর দিকে  দিলেন ছুড়ে
সে তীর দয়া করে।
অনেক  তপস্যাতে  পেলেন মুনি
স্বর্গে যত স্থান,
সে তীর  পড়ল গিয়ে  সেইখানেতে
বাঁচল মুনির প্রাণ।
ঠাকুর  হার মেনে তায়  সেখান হতে
গেলেন লাজের ভরে,
রাজা  সবায় নিয়ে  মনের সুখে
এলেন আপন ঘরে।
তখন  আদর করে  রানীরা সবে
বউ লইলেন কোলে,
তাঁদের  দিলেন কি যে বলতে হলে
পড়ব বড়ই গোলে।
পরে  ভরত গেলেন  মামার বাড়ি
শত্রুঘ্নরে লয়ে,
আর  শ্রীরাম করেন  পিতার সেবা
পরম সুখী হয়ে।