জওহরলাল/ছয়
ছয়
হিমালয় ভ্রমণের তিন বৎসর পরে জওহরলালের জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা দেখা দিল। সেই ঘটনার পর হইতে তাঁহার জীবনের ধারা যে স্বতন্ত্র পথে প্রবাহিত হইল, আজও তাহা ভারত-বাসীর অনুর্ব্বর চিত্তকে সরস করিয়া সমানে বহিয়া চলিয়াছে। জনমত উপেক্ষা করিয়া ভারত সরকার সেই সময় রাউলাট বিল আইনে পরিণত করিলেন।) এই আইনের দ্বারা যে কোনও লোককে রাজনৈতিক অপরাধের সন্দেহক্রমে গ্রেফতার করা যাইবে এবং তাহার বিচারও সরাসরি হইয়া যাইবে।
এই বিলের প্রতিবাদে সারা দেশ সহসা যেন সচেতন হইয়া উঠিল । গভর্ণমেণ্ট তাহা গ্রাহ্যই করিলেন না। সেই সময় মহাত্মা গান্ধী অসুস্থ হইয়া শয্যাগত ছিলেন। রোগশয্যা হইতেই তিনি বড়লাটের নিকট পত্র লিখিয়া আবেদন জানাইলেন যে, তিনি যেন এই বিলে সম্মতি না দেন। কিন্তু বড়লাট সে আবেদন গ্রাহ্য করিলেন না।
তখন মহাত্মা গান্ধী এক নূতন আন্দোলন প্রবর্ত্তন করিলেন—সত্যাগ্রহ আন্দোলন। যে সত্যাগ্রহী হইবে, সে রাউলাট আইনকে অস্বীকার করিতে প্রতিজ্ঞা -বদ্ধ হইবে এবং পরে যখনি এমনিধারা অন্য কোন অন্যায় আইন দেশের লোকের উপর চাপানো হইবে, তাহাদিগকেও অমান্য করিতে হইবে। ইহার অর্থ হইল যে, স্বেচ্ছায় কারাবাস এবং নির্যাতনকে বরণ করিয়া লইতে হইবে।
যখন এই সংবাদ জওহরলালের নিকট উপস্থিত হইল, তিনি বিরাট অন্ধকারের মধ্যে যেন আলো দেখিতে পাইলেন। এতদিন দেশের রাজনীতি যে নিস্ক্রিয় ও নির্বীর্য্য অলসতার মধ্যে পড়িয়া মরিতে বসিয়াছিল, তাহা যেন এক নূতন গতিশীলতা ও প্রাণ পাইল। আর আবেদন, নিবেদন ও প্রস্তাব নয়— বসিয়া থাকিয়া থাকিয়া সারা দেশে যেন ঘুন ধরিয়া গিয়াছে—এবার চলিতে হইবেই—পথে দাঁড়াইতে হইবে—যাহা অর্জন করিতে চাই তাহার জন্য যোগ্য মূল্য দিতে হইবে—বেদনায় দীক্ষা লইতে হইবে-জওহরলালের সমগ্র মন এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যোগ দিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল—কিন্তু একটা মস্তবড় বাধা তখনও ছিল—তার পিতার অনুমতি।
আইন ও নিয়মের ছাত্র পণ্ডিত মতিলাল এই সত্যাগ্রহ আন্দোলনের বিপক্ষে তখন মত দিলেন। বিশেষ করিয়া তিনি যখন জানিতে পারিলেন যে তাঁহার পুত্র এই আন্দোলনে যোগদান করিতে উৎসুক, তখন এক নিদারুণ দুশ্চিন্তা তাঁহাকে পাইয়া বসিল । তিনি ভাবিলেন, এই আন্দোলনে যোগদান করা মানে কারাবাসে যাওয়া! কারাবাসের যন্ত্রণা জওহরলাল সহিবে কি করিয়া? পিতাপুত্রের মধ্যে একটা নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলিতে লাগিল। একদিকে দুর্ব্বার পিতৃস্নেহ-অন্যদিকে পুত্রকে তিনি নিজে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিয়াছেন—মনকে স্বাধীনভাবে গড়িয়া উঠিতে সহায়তা করিয়াছেন—আজ সে মনকে বাধা দিলে চলিবে কেন? কিন্তু যতই নিজের মনে যুক্তি করেন, ততই দুর্ব্বল হইয়া পড়েন, তাঁহার পুত্র কি করিয়া কারাযন্ত্রণা সহ্য করিবে? আর তিনি প্রাসাদে বসিয়া তাহা দেখিবেনই বা কি করিয়া? এই দুশ্চিন্তা তাঁহাকে এমন ভাবে পাইয়া বসে যে, রাত্রিকালে যখন কেহ কোথাও নাই, তিনি খালি মাটীতে নিজে শুইয়া দেখিতে লাগিলেন, ভূমিশয্যায় কি রকম কষ্ট হয়! হায়, পিতৃস্নেহ।
নিরুপায় হইয়া চতুর আইনজীবি পণ্ডিত মতিলাল গান্ধিজীকে এলাহাবাদে তাঁহার বাড়ীতে আমন্ত্রণ করিয়া আনিলেন। জওহরলালের অজ্ঞাতে এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কি সব পরামর্শ হইল। তারপর গান্ধীজি স্বয়ং জওহরলালকে ডাকিয়া বলিলেন,