পাঁচ

 ১৯২২ খৃষ্টাব্দে ব্যারিষ্টারী পাশ করিয়া সাত-আট বৎসর বিদেশে বাস করার ফলে তিনি ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিলেন।

 শৈশবে ইংরাজ গভর্নেস, তাহার পর মিঃ ব্রুক্‌স, তাহার পর হ্যারো আর ক্যামব্রিজ। এইভাবে পূরাপুরি ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হইয়া যখন তিনি ভারতবর্ষে আসিলেন, তখন দেহ ও মনের দিক হইতে তিনি একজন পাকা য়ুরোপীয়ান।

 ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসিয়া জওহরলাল যথারীতি এলাহাবাদ হাইকোর্টে ব্যারিষ্টার হইয়া প্রবেশ করিলেন। কিন্তু কি আদালতে বা আদালতের বাহিরে, জীবন তাঁহার কাছে চরম একঘেয়ে হইয়া উঠিল। দূর হইতে ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রাম সম্বন্ধে যে সব কল্পনা মনে মনে করিয়াছিলেন, ভারতে আসিয়া দেখিলেন যে প্রকৃত অবস্থার সহিত তাঁহার কল্পনার কোনও যোগ নাই ।

 সেই বৎসরে বাঁকিপুরে কংগ্রেসের অধিবেশন বসে। তিনি সেই কংগ্রেসে যোগদান করেন। কিন্তু তাঁহার মনে হইল যে, কংগ্রেসে যাহারা আসিয়াছেন, তাঁহাদের মনে রাজনীতির গন্ধ পর্য্যন্ত নাই, যেন তাঁহারা বড়দিনের ছুটিতে দল বাঁধিয়া সব পিকনিকে আসিয়াছেন—বিলাতী পোষাক-কেতা-দুরন্ত সুট—সভায় বই মুখস্থ করা নিরীহ সব বক্তৃতা — অবশেষে বহুবার প্রস্তাবিত একই প্রস্তাবের প্রায় একই রকম ভাষায় বাৎসরিক পুনরাবৃত্তি!

 সাত বৎসর ধরিয়া ইংলণ্ডে যে জীবন তিনি দেখিয়া আসিয়াছেন, ভারতবর্ষে আসিয়া দেখিলেন যে, সে-জীবনের কণামাত্র এখানে দেখা যায় না। বালককালেই তিনি ইংলণ্ডে গিয়াছিলেন এবং সমস্ত কৈশোর সেখানেই অতিবাহিত হয়। যৌবনের মুখে অন্তর যে প্রভাব গ্রহণ করে, সেই প্রভাবেই জীবন অনুরঞ্জিত হইয়া থাকে। তাই ভারতবর্ষে আসিয়া জওহরলাল পারিপার্শ্বিক জীবনের প্রাণহীনতা এবং পঙ্গুতায় মর্মাহত হইয়া উঠিলেন!

 তাহার আত্মজীবনীতে এই সম্পর্কে সেই ঘটনা হইতে একটা ঘটনার উল্লেখ তিনি করিয়াছেন। তাঁহার মনের অবস্থা স্পষ্ট বোঝা যায় ।

 তখন নেতা হিসাবে মিঃ শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর নাম ভারতবর্ষে সকলেই জানে। এলাহাবাদে ছাত্রদের সভায় তিনি বক্তৃতা দিতেছিলেন। জওহরলাল সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। শাস্ত্রী মহাশয় ছাত্রদের উপদেশ দিতে ছিলেন,—“তোমাদের প্রধান কর্তব্য হইল, মাতাপিতা এবং গুরুজনদের বাধ্য হওয়া। তোমাদের শাসনের ভার যাঁহাদের উপর, তাঁহাদের কথার কখনও বিরূপ আচরণ করিবে না। যদি তোমাদের সহপাঠীর মধ্যে কেহ কোন অন্যায় করে, তোমার উচিত অবিলম্বে তা কর্তৃপক্ষকে জানানো।”

 শেষের এই উপদেশবাণী শুনিয়া জওহরলাল অবাক হইয়া গেলেন। এই সম্পর্কে তাঁহার আত্মচরিতে তিনি লিখিয়াছেন, “যদিও মিঃ শাস্ত্রী স্পষ্ট করিয়া ভাষায় প্রকাশ করিলেন না, কিন্তু তাঁহার বক্তব্যের আসল মানে হইল যে, ছাত্রদের তিনি নিজেদের মধ্যে গুপ্তচরের কাজ করিতে শিক্ষা দিতেছেন, তাঁহার আদর্শ অনুসরণ করা মানে 'ইনফর্‌মার' হওয়া। আমি সদ্য ইংলণ্ড হইতে ফিরিয়া আসিয়াছি। সেখানে সাত বৎসর ছাত্রদের মধ্যে দিবারাত্র বাস করিয়া আমি এই শিক্ষাই পাইয়াছি, যদি প্রাণও যায়, তথাপি নিজের সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিব না—লুকাইয়া চোরের মতন কাহারও বিরুদ্ধে কিছু ‘লাগানো' এবং সেইভাবে সতীর্থকে বিপন্ন করা, সমস্ত ভব্যতার বিরুদ্ধে—হঠাৎ মিঃ শাস্ত্রীর মতন লোকের মুখে সেই কথা শুনিয়া আমি বুঝিলাম, আমি যে নীতি শিক্ষা করিয়া আসিয়াছি, তাহার সহিত এই নীতির কোনও সম্পর্ক নাই।”

 এইভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষায় দীক্ষিত তাঁহার মন চারিদিক হইতে যে আঘাত পাইতে লাগিল, তাহার ফলে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন হইতে দূরে সরিয়াই যাইতে লাগিলেন। অসাধারণ ধনী পিতার একমাত্র সন্তানরূপে তিনি জীবনের অন্য ক্ষেত্র হইতে রস আহরণ করিতে লাগিলেন। শীকার, পিকনিক, পার্টি, দেশভ্রমণ, নিজের খুশীমত অধ্যয়ন— ফিটফাট পোষাক - পোষাকের নিত্য পরিবর্ত্তন— গ্যারীবল্‌ডী —রণক্ষেত্রে —বিচ্ছিন্ন জাতিকে এক পতাকার তলায় লইয়া আসা—আপাতত দূরে সরিয়া গেল—

 এই সময়কার বৈচিত্র্যহীন জীবন-ধারার মধ্যে হঠাৎ, ১৯১৫ খৃষ্টাব্দে জওহরলালের জীবনে একটা স্মরণীয় ঘটনা ঘটিয়া গেল। সেই বৎসর সর্ব্বপ্রথম তিনি প্রকাশ্যে বক্তৃতা দেন।

 ব্যাপারটী এমন গুরুতর কিছু নয় যে, তাহাকে স্মরণীয় বলিতে হইবে, এই বক্তৃতা দেওয়া এমন কিছু একটা স্মরণীয় ব্যাপারই নয়; আর তা ছাড়া, জওহরলালের সে বক্তৃতাটীও এমন কিছু ছিলনা যাহা স্মরণ করিয়া না রাখিলে কাহারও কিছু ক্ষতি হইবে, তথাপি এই সামান্য ব্যাপারটী তাহার জীবনে যে স্মরণীয় হইয়া আছে, তাহার কারণ, বক্তৃতা দিতে তিনি একান্ত অপারগ ছিলেন—বিশেষ করিয়া প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করিবার কথা ভাবিলেই তাঁহার শব্দযন্ত্র যেন বন্ধ হইয়া আসিত- সেইজন্য তাঁহার জীবনে সেই ঘটনাটী স্মরণীয় হইয়া আছে—তাহা ছাড়া বক্তৃতা করিতে হইলে, তাহার বিশ্বাস ছিল যে, হিন্দুস্থানী ভাষাতেই বক্তৃতা করা উচিত—কিন্তু তিনি তখন ভাল হিন্দুস্থানী বলিতে পারিতেন না—ইংরাজী ভাষাতেই তিনি কয়েক মিনিট বক্তৃতা দেন—বক্তৃতা দেওয়ার পর ঘর্মাক্ত হইয়া যখন তিনি বসিযা পড়িলেন, স্যার তেজ বাহাদুর সপ্রু উঠিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন— বক্তৃতা ভাল করিয়াছিলেন বলিয়া নয়—তিনি বক্তৃতা দিতে পারিলেন বলিয়াই এই আনন্দের অভিব্যক্তি।

 এখানে এই ঘটনার উল্লেখ করিলাম এইজন্য যে লোক কয়েক বৎসর আগে হিন্দুস্থানীতে বক্তৃতা দিতে সাহস পাইত না এবং যে লোক প্রকাশ্য সভায় কথা বলিতে ভয় পাইত, আজ তাঁহার হিন্দুস্থানী বক্তৃতায় হিন্দুস্থান ভরিয়া উঠিয়াছে—সেই ভীত-সঙ্কুচিত মূককণ্ঠে আজ ভারতের কোটী মূক প্রাণের ভাষা মুখর হইয়া উঠিয়াছে ।

 ইহার পর তাহার জীবনে আর একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে, তাহার পরের বৎসরে-দিল্লী শহরে বাসন্তী পঞ্চমীর দিন—ঘটনাটি হইল, তাহার বিবাহ। ঠিক সেই সময়, আর একটি স্ময়ণীয় ঘটনা ঘটে— কাশ্মীর ও হিমালয়ভ্রমণ। সেই সময় নেহরু পরিবার বহুদিন পরে তাঁহাদের আদি বাসস্থান কাশ্মীরে ভ্রমণের জন্য যান। সেই সুযোগে জওহরলাল প্রান্তরভূমি ত্যাগ করিয়া একজন সহযাত্রীর সঙ্গে হিমালয়ের গিরিপথের দিকে অগ্রসর হন।

 বালককাল হইতেই তাহার মনে এক দুর্ব্বার ভ্রমণ-পিপাসা ছিল। সেই নির্জ্জন পার্ব্বত্য-পথ, তুষারমণ্ডিত গিরিশৃঙ্গ—পথের, বাঁকে বাঁকে অজানা সৌন্দর্য্যের অদেখা চিত্র-পটের পর পট সাজানোসেই সুগম্ভীর সৌন্দর্য্যের মধ্যে কোথায় কোন্ ছদ্মবেশে ভয়ঙ্কর কিছু লুকাইয়া আছে পথের সঙ্কটরূপে শেষহীন হিমালয়ের সেই সব উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ তাঁহাকে যেন আকর্ষণ করিয়া লইয়া বলিল—এইভাবে চলার নেশায় মত্ত হইয়া তিনি প্রান্তরভূমি হইতে প্রায় ১১৫০০ হাজার ফিট উঁচুতে উঠিলেন।

 অনেক সময় তুঙ্গ দুরূহ পথে দড়ির সাহায্যে উঠিতে হইয়াছে—কোথাও কোথাও পথ বরফে এমন পিচ্ছিল হইয়া গিয়াছে যে তাহার উপর পা রাখা যায় না। এহেন ক্ষেত্রে একজন সাধারণ প্রান্তরবাসীর পক্ষে হিমালয়ের সাড়ে এগারো হাজার ফিট উঁচুতে উঠা কম ক্বতিত্বের পরিচয় নয়। যদি তাঁহারা জানিতেন যে কি দুঃসাহসিক কাজে তাহারা অগ্রসর হইয়া চলিয়াছিলেন, তাহা হইলে হয়ত অগ্রসর হইতেন না।

 হঠাৎ এই সাড়ে এগারো হাজার ফিটে এক মেষপালকের সঙ্গে তাঁহাদের দেখা হইল। তাহার মুখে শুনিলেন যে অমরনাথ আর মাত্র আট মাইলের রাস্তা। সুতরাং এতদূরে আসিয়া অমরনাথ না দেখিয়া কি করিয়া ফেরা যায়? কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হইবার পর, তাঁহারা বুঝিলেন, যে পথে তাঁহারা চলিয়াছেন, সে পথে পর্ব্বত-অভিযানের রীতিমত যন্ত্র-পাতি ছাড়া আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয়— সামনেই এক বিরাট তুষারগহ্বর—খালি পায়ে এবং শুধু হাতে সে তুষারগহ্বর অতিক্রম করিয়া যাওয়া সম্ভব নয়—সুতরাং সেইখান হইতেই প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হইল-

  এই সম্পর্কে তাঁহার আত্মচরিতে তিনি লিখিয়াছেন,“কাশ্মীরের এই সব উপত্যকা আর পার্ব্বত্য-ভূমি আমার মনকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করিত। সে-যাত্রা ফিরিয়া আসিলাম কিন্তু প্রতিজ্ঞা করিলাম, আবার আসিব। কতবার মনে মনে প্ল্যান করিয়াছি তুষারমণ্ডিত মানস-সরোবরে যাইব, কৈলাসশৃঙ্গে দাঁড়াইব, কিন্তু হায়, আজও পর্য্যন্ত তাহা কল্পনাতেই রহিয়া গিয়াছে—আমার ভ্রমণ-পিপাসা, কে জানিত, কারাভ্রমণেই পরিতৃপ্ত করিতে হইবে।"