জওহরলাল/চার
চার
সেই সময় খবরের কাগজে একটামাত্র সংবাদ ছিল—তাহা হইল রাশিয়ার সহিত জাপানের যুদ্ধ! এই প্রাচ্য জগতের কোন জাতি যে প্রবলপরাক্রান্ত পশ্চিমের কোন জাতিকে যুদ্ধে হারাইয়া দিতে পারে, সেদিন তাহা কল্পনা করিতেও ভারতবাসীর কি না লাগিত!
সেদিন কেহ কল্পনাও করে নাই যে, জাপান তাহার সামরিক শক্তির দর্পে প্রাচ্যের জাগরণের স্বপ্নকে নিজের স্বার্থের কাছে বলি দিয়া আর এক পররাজ্যলোলুপ সাম্রাজ্যবাদী জাতি হিসাবে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে।
তাই সেদিন জাপানের সেই সমর-গৌরব ভারতবাসীর বুকে আশা জাগাইয়া তুলিত।
অন্য সকলের মত বালক জওহরলালও সেই সংবাদ পড়িবার জন্য উদ্গ্রীব হইয়া থাকিতেন। কল্পনায় নিজেকে আনন্দ-ভবনের সেই সুখসজ্জা হইতে দূরে অজানা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড় করাইতেন—জাপানের হইয়া যেন বালক যুঝিতেছে—তারপর কল্পনার দৃশ্য দেখাইয়া দেয়—-এই ভারতের রণক্ষেত্রে অসিহস্তে বালক সৈন্যদের পুরোভাগে চলিয়াছে, তাহার পিছনে অগণিত ভারতবাসী, সকলের হাতে অসি- বালক তাহাদের লইয়া চলিয়াছে—পরাধীনতার কারাগার হইতে স্বাধীনতার মুক্ত প্রান্তরে-
ইহার বৎসর খানেক পরে, জওহরলাল তখন সবেমাত্র পনেরো বৎসরে পদার্পণ করিয়াছেন, তখন হঠাৎ তাঁহার স্থাণু জীবনের রথ চলিতে আরম্ভ করিল— ভারতবর্ষ হইতে ইংলণ্ডে-
হ্যারো আর ক্যাম্ব্রিজ—যেখানে ইংলণ্ডের বাছাইকরা ছেলেরা তাহাদের জাতির শ্রেষ্ঠ নাগরিক হইবার শিক্ষা পাইয়া আসিতেছে—যেখানে ধুরন্ধর শিক্ষকেরা লোহার জালে-আঁটা নিয়মের কারখানায় ভবিষ্যৎ ইংরেজ প্রতিনিধিদের গড়িয়া তোলেন— সেখানে গিয়া পড়িলেন এই দেশের টোলে পড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের এক বংশধর।
নিজের আত্মীয়জন থেকে দূরে এই বিদেশী ছেলেদের মধ্যে হ্যারোর ছাত্রজীবন জওহরলালের খুব ভাল লাগিল না। এই সম্পর্কে তাঁহার আত্মজীবনে তিনি লিখিয়াছেন—“এর আগে বিদেশী লোকদের মধ্যে এমনি সম্পূর্ণ একলা আমি বাস করি নি। তাই প্রথম প্রথম বাড়ীর জন্যে মন কেমন করতো। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর আমি একরকম সেখানকার জীবনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলাম। পড়াশোনা, খেলাধূলায় অন্য সব ছেলের মতই সমান ভাবে মিশতে লাগলাম কিন্তু কোন দিনই আমার মনে হয়নি যে, এদের মধ্যে আমার জীবনকে ঠিক খাপ খাইয়ে নিতে পারবো।”,
সেই অল্প বয়সেই ইংলণ্ডে গিয়া একটি জিনিস কিশোর জওহরলালকে আকর্ষণ করিল, তাহা হইল রাজনীতি। ভারতবর্ষে বাস করিবার সময় শিক্ষার গুণে, সেই বয়সেই তিনি সমবয়সী ইংরেজ সতীর্থদের চেয়ে সাধারণ জ্ঞানে খুব উন্নত ছিলেন। তাই তাঁহার ক্লাসের ছেলেরা যখন খেলা-ধূলার কথা ছাড়া আর কিছুই আলোচনা করিত না, তখন তাহার মন নানা বিষয়ের চিন্তায় ভরিয়া থাকিত। কিন্তু আলোচনা করিবার সঙ্গী মিলিত না । '
এই সময় ইংলণ্ডে পার্লামেণ্টের সাধারণ নির্বাচন আরম্ভ হয়। সেই নির্ব্বাচনে লিবারেল দল জয়লাভ করে। একদিন ক্লাসে শিক্ষক ছেলেদের নির্ব্বাচন সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেন। জওহরলাল ছাড়া আর কোন ছেলেই কোন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারিল না। জওহরলাল কাহাকে কাহাকে লইয়া সেই লিবারেল মন্ত্রিমণ্ডল গঠিত হইয়াছে, তাহা পর্য্যন্ত বলিয়া দিলেন।
সেই সময় ভারতবর্ষে তিলক ও অরবিন্দের নেতৃত্বে এক নূতন জাতীয়তা-আন্দোলন মাথা তুলিয়া উঠিতেছিল। বিলাতী সংবাদপত্রে তাহার সম্পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত না হইলেও, যেটুকু প্রকাশিত হইত, তাহার মধ্য হইতে কিশোর জওহরলাল মনে মনে বিরাট রাজনৈতিক আন্দোলনের মূর্ত্তি গড়িয়া লইতেন। ঘটনাক্রমে ক্লাসে সাধারণ উন্নতির জন্যে তিনি কতকগুলি বই প্রাইজরূপ পাইলেন। তাহার মধ্যে ছিল, গ্যারিবল্ডী-সংক্রান্ত কয়েকখানি বই। এই বইগুলি সেই সময় তাঁহার মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।
গ্যারিবল্ডী বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ইতালীকে এক জাতিতে পরিণত করেন। গ্যারিবল্ডীর সেই কীর্ত্তি কিশোরের মনে এক স্বপ্ন জাগাইয়া তুলিল-গ্যারীবল্ডীর জীবনী পড়িতে পড়িতে তাহার মনে কখন মহাত্মা গ্যারিবল্ডীর যায়গায় নিজেকে দাঁড় করাইতেন—ইতালীর পরিবর্তে ভারতবর্ষে তিনি মানসচক্ষে দেখিতেন, মুক্ত-তরবারি-হাতে তিনি সংগ্রামে চলিয়াছেন, বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতকে একজাতিতে পরিণত করিবার জন্য।
মনের এই সব ভাবনা মনেই রাখিতে হইত, কারণ, স্কুলের সেই ক্ষুদ্র সহপাঠীদের এমন কেহ ছিল না, যাহার সঙ্গে এই সব আলোচনা করা চলে। আর তাহা ছাড়া তাঁহার মনে হইত, স্কুলের ক্ষুদ্র আবেষ্টনের মধ্যে যেন তাঁহাকে কুলাইতেছে না, কলেজের বৃহত্তর জীবন তাঁহাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করিত।
তাই হ্যারো ছাড়িয়া যেদিন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজে প্রবেশ করিলেন, সেদিন যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন। স্কুলের বাঁধাধরা ক্ষুদ্র আবেষ্টনের মধ্যে তাঁহার মন হাঁফাইয়া উঠিত, কলেজের অপেক্ষাকৃত স্বাধীন জীবনের মধ্যে জওহরলাল যেন নিজেকে খুঁজিয়া পাইলেন।
বিজ্ঞানের দিকে তাঁহার স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকায় কলেজে তিনি বিজ্ঞানবিভাগে প্রবেশ করিলেন এবং ন্যাচুর্যাল সায়েন্সে তিনি ট্রাইপস গ্রহণ করিলেন। বিষয়, কেমিষ্ট্রি, জিওলজি ও বোটানি।
ক্যামব্রিজে ভারতীয় ছাত্রদের এক ক্লাব ছিল। তাহার নাম মজলিস। এই মজলিসের অধিবেশনে ভারতীয় ছাত্রেরা প্রাণ খুলিয়া দেশের কথা আলোচনা করিত, বক্তৃতা দিত। অনেক সময় তাহারা এমন সব গরম গরম বক্তৃতা করিত যে, তাহা শুনিলে মনে হইত, তাহারা যেন বিপ্লবী হইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে। পণ্ডিত জওহরলাল তাহার আত্মচরিতে লিখিয়াছেন—“যাহারা এই সব গরম গরম বক্তৃতা করিত, তাহারাই পরে দেখিয়াছি, ভারতে আসিয়া বৃটিশ আমলাতন্ত্রের সব চেয়ে কায়েমী ঢাকায় পরিণত হইয়াছে।
এই মজলিসে সেই সময় ভারতবর্ষ থেকে তিন জন বড় রাজনৈতিকের দেখা জওহরলাল পাইয়াছিলেন, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপৎ রায় এবং মিঃ গোখলে। তাহাদের বক্তৃতায় তিনি নূতন ভারতবর্ষের সন্ধান পান। সেই সময় পিতার সহিত পত্র আদান-প্রদানের মধ্য দিয়া তিনি জানিতে পারেন যে তাহার পিতা এই জাতীয়তাবাদী দলের বিপক্ষে মডারেট দলের নেতা হইয়াছেন। এই সংবাদে পিতৃগর্ব্বে গর্বিত তাহার মনে আঘাত লাগে; এবং মনের ভাব গোপন না করিয়াই তিনি পিতাকে এক পত্র লেখেন। সেই পত্রে প্রবাসী পুত্রের রাজনৈতিক বিলাসিতা দেখিয়া পণ্ডিত মতিলাল ক্ষুণ্ন হইয়াছিলেন।
সেদিন পিতা-পুত্রের মধ্যে কেহই কল্পনা করিতে পারেন নাই যে, কি এক মহাভবিতব্যতার দিকে তাঁহাদের দুইজনের জীবনের ধারা এক হইয়া মিলিতে চলিয়াছে! সে সময়, প্রত্যেক ভারতীয় ছাত্রের কাছে এবং বিশেষ করিয়া ছাত্রের অভিভাবকদের কাছে, ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করা ছিল, জীবনের চরম কাম্য। কিন্তু জওহরলাল বা তাঁহার অভিভাবকদের কাছে ইহার বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না। জওহরলালের মন তখন কাঁচা স্বদেশিকতার আদর্শে ভরপূর। তাই নিজেকে বৃটীশ আমলাতন্ত্রের প্রাণহীন অঙ্গ ভাবিতে তাহার মন চাহিত না। ওধারে তাঁহার মাতাপিতার ভাবনা ছিল যে, ছেলে যদি ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করে, তাহা হইলে চাকুরীর খাতীরে তাহাকে দূর-দূরান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে। এক তো ছেলেবেলা হইতে পুত্র প্রবাসী, তাহার পর সেই পুত্র যখন ঘরে ফিরিয়া আসিবে, তখন যদি আবার তাহাকে দূরে দূরে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয়, তাহা হইলে অমন চাকুরীতে কি লাভ? তাই সিভিল সার্ভিসে তাঁহাদের মত ছিল না।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হইতে জওহরলাল দ্বিতীয় শ্রেণীর অনার্স লইয়া গ্র্যাজুয়েট হইলেন; এবং বংশের ধারা অনুসরণ করিয়াই ব্যারিষ্টারী পড়িবার জন্য “বারে” প্রবেশ করিলেন। এই সময় তিনি য়ুরোপের বিভিন্ন দেশে ছুটির সময় ঘুরিয়া বেড়ান; এবং ফ্রান্স, জার্মানী এবং নরওয়ে দেশের সহিত সাক্ষাৎ ভাবে পরিচিত হন।