জওহরলাল/তিন
তিন
জওহরলালের যখন এগারো বৎসর বয়স, সেই সময় পণ্ডিত মতিলাল তাহার শিক্ষার জন্য ফার্ডিনান্স টি-ব্রুক্স নামে একজন পণ্ডিত আইরিশম্যানকে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন।
সেই সময় ভারতবর্ষে অ্যানি-বেশান্ত এক নূতন ধর্ম্ম-আন্দোলন শুরু করিয়াছিলেন। সেই ধর্ম্মপ্রচারের জন্য যে সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহার নাম থিওসফিক সোসাইটী। ব্রুক্স এই সোসাটির একজন প্রধান পাত্তা ছিলেন এবং অ্যানি-বেশান্তই তাঁহাকে পণ্ডিত মতিলালের কাছে সুপারিশ করিয়া দেন।
এই আইরিশম্যান বালকের জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন এবং তাঁহারই শিক্ষা এবং সাহচর্য্যে সেই অল্প বয়সেই জওহরলাল ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে বেশ সহজ ভাবে বিচরণ করিতে শিখিয়াছিলেন। সাহিত্য ছাড়া আরও দুইটী জিনিষে ব্রুক্স বালকের জীবনে কৌতূহল জাগাইয়া দেন, একটী হইল বিজ্ঞান, আর একটী হইল ধর্ম্ম।
বিজ্ঞানের প্রতি বালকের আগ্রহ দেখিয়া পণ্ডিত মতিলাল বাড়ীতেই বালকের ব্যবহারের জন্য একটা ছোট্ট ল্যাবরেটারী গড়িয়া দেন। সেই ল্যাবরেটরীতে গুরু ও শিষ্য মিলিয়া বিজ্ঞানের প্রথম পাঠ অনুশীলন করেন। বিজ্ঞানের সেই সব প্রাথমিক পরীক্ষার মধ্যে বালক এক অপূর্ব্ব উদ্দীপনা অনুভব করেন এবং সেদিন বিজ্ঞানের প্রতি যে প্রীতি এইভাবে জন্মগ্রহণ করে, তাহা তাঁহার ভবিষ্যৎ শিক্ষাকে দৃঢ়তর করিয়া তুলিতে সাহায্য করে।
ব্রুক্স তাঁহার নিজের বাড়ীতে তাঁহার দলের লোকদের লইয়া ধর্মসভা বসাইতেন। সেখানে হিন্দুধর্ম্মের সমস্ত বিষয় লইয়া বক্তৃতা ও আলোচনা হইত। ব্রুক্স যেদিন তাঁহার বালক-শিষ্যকে অবাধে সেই সভায় যোগদান করিবার অনুমতি দিলেন, সেদিন এক গোপন গর্ব্বে বালকের মন ভরিয়া উঠিল। বালকের মনে হইল, যে বৃহত্তর জীবন হইতে সাধারণত বড়রা ছোট ছেলেদের সরাইয়া রাখেন এবং যেখানে পৌঁছাইতে বালকদের বুড়া হইয়া যাইতে হয়, আজ গুরুর কৃপায় সহসা বালক বয়সেই সেই জীবনের সামনাসামনি দাঁড়াইতে পাইয়া বালক নিজেকে ধন্য মনে করিল।
সভার অন্য সব শ্রোতার মতন বালকও গম্ভীর ভাবে বক্তৃতার বিষয় বুঝিতে পারিতেন না সত্য, কিন্তু তবুও সেই সব আলোচনা শুনিতে শুনিতে বালকের মনে বহু গুরু-গম্ভীর শব্দ আপন হইতে জানা হইয়া যাইত। আপনার মনে, আপনার মতন করিয়া বালক সেই সব রহস্যময় কাজগুলি লইয়া নাড়া-চাড়া করিতে এবং নিজেকে প্রায় বড়দের সমকক্ষ মনে করিতে তাঁহার দ্বিধাবোধ হইত না।
সেইজন্য বালকের যখন তেরো বৎসর বয়স হইল, সেই সময় একদিন বালক স্থির করিলেন, এমনি ভাবে অযাচিত হইয়। সভায় যোগদান করা ঠিক তাহার মর্য্যাদার অনুকূল হইতেছে না, সকলেই সেখানে যথারীতি সভ্য, তিনিই বা যথারীতি সভ্য হইবেন না কেন?
এই স্থির করিয়া বালক একদিন পিতার নিকট প্রস্তাব করিলেন যে, থিওসফিক সোসাইটীর তিনি যথারীতি সভ্য হইবেন!
তেরো বৎসরের ছেলের মুখে সেই কথা শুনিয়া পণ্ডিত মতিলাল অট্টহাস্য করিয়া উঠিলেন! তাঁহার হাসি স্বভাবতই খুব জোরালো ছিল। সেই হাসিতে বালকের মনের গোপন গর্ব্ব ক্ষুণ্ন হইল। বালক রীতিমত আহত ও অপমানিত বোধ করিলেন।
সমস্ত ব্যাপারেই বালক পিতাকে অসাধারণ বলিয়া শ্রদ্ধা করিতেন এবং তাঁহাকে একজন শ্রেষ্ঠ লোক বলিয়া জানিতেন, কিন্তু এই ব্যাপারে বালক যেন বুঝিতে পারিলেন, পিতার সম্বন্ধে তাঁহার অনুমান হয়ত ঠিক হয় নাই—নতুবা এই ব্যাপারকে তুচ্ছ বলিয়া তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিবেন কেন? তিনি আর যাহাই বুঝুন না কেন, তাঁহার সেই প্রতিভাশালী পুত্রের মনের গভীরতা মাপিবার মত শক্তি তাঁহার নাই? বালক এমনি ক্ষিপ্ত ও অসন্তুষ্ট হইয়া উঠিলেন!
কিন্তু সহজে পরাজয় স্বীকার করা বালকের ধাতে ছিল না। দিনের পর দিন সেই সভায় বসিয়া বালক যে সব দুরূহ শব্দ মনের পাতায় সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহাই পিতার সামনে তুলিয়া ধরিলেন—হইলই বা তাঁহার তেরো বৎসর বয়স! তাঁহার পিতার জানা উচিত যে, আর অন্য সকলের মতনই তিনিও “যিওসফী” বোঝেন! সে কথা পণ্ডিত মতিলালকেও স্বীকার করিতে হইল এবং তাহার ফলে পিতার অনুমতি লইয়া যথারীতি তিনি থিওসফিক সোসাইটীর সভ্য হইলেন। স্বয়ং অ্যানিবেশান্ত পুরোহিতের কাজ করিলেন। কারণ, সে সময় এই সভার সভ্য হইতে হইলে কতকগুলি গোপন অনুষ্ঠান পালন করিতে হইত। রীতিমত দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তবে সভ্য হইতে হইত!
তেরো বৎসর বয়সে অ্যানি-বেশান্তের হাতে দীক্ষা লইয়া যথারীতি জওহরলাল থিওসফিক সোসাইটীর সভ্য হইলেন!