জগন্নাথের রথ/হিরোবুমি ইতো
হিরোবুমি ইতো
মানবজাতির মধ্যে দুই প্রকার জীব জন্মগ্রহণ করে। ষাঁহারা আস্তে আস্তে ক্রম-বিকাশের স্রোতে অগ্রসর হইয়া অন্তনিহিত দেবত্ব প্রকাশ করিতেছেন, তাঁহারা সাধারণ মনুষ্য। ষাঁহার। সেই ক্রম-বিকাশের সাহায্যার্থ বিভূতিরূপে জন্মগ্রহণ করেন, তাঁহারা স্বতন্ত্র। তাঁহারা যে জাতির মধ্যে ও যে যুগে অবতরণ করেন, সেই জাতির চরিত্র ও আচার, সেই যুগের ধর্ম্ম গ্রহণ পূর্ব্বক ঐশ্বরিক শক্তি ও স্বভাবের বলে সাধারণ মানবের অসাধ্য কর্ম্ম সাধন করিয়া জগতের গতি কিঞ্চিৎ পরিবর্ত্তন করিয়া ইতিহাসে অমর নাম রাখিয়া স্বলোক গমন করেন। তাঁহাদের কর্ম্ম ও চরিত্র মানুষের প্রশংসা ও নিন্দার অতীত। প্রশংসা করি বা নিন্দা করি, তাঁহারা ভগবদ্-দত্ত কার্য করিয়া গিয়াছেন, মানবজাতির ভবিষ্যৎ সেই কার্য্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইয়া নিদ্দিষ্ট পথে খরস্রোতে বহিবে। সীজার, নেপোলিয়ন, আকবর, শিবাজী এইরূপ বিভূতি। জাপানের মহাপুরুষ হিরোবূমি ইতোও, এই শ্রেণীর ভুক্ত এবং যাঁহাদের নাম উল্লেখ করিলাম তাঁহাদের একজনও গুণে, প্রতিভায় বা কর্ম্মের মহত্ত্বে ও ভবিষ্যৎ ফলে ইতোর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন না। ইতোর ইতিহাসে ও জাপানের অভ্যুদয়ে, তাঁহার প্রধান স্থান সকলেই অবগত আছেন, কিন্তু সকলেই না-ও জানিতে পারেন যে ইতোই সেই অভ্যুদয়ের ক্রম, উপায় ও উদ্দেশ্য উদ্ভাবনা করিয়া শেষ পর্যন্ত্য এক। এই মহৎ পরিবর্ত্তন করিয়াছেন, জাপানের আর সকল মহাপুরুষ তাঁহার হস্তের যন্ত্র নাত্র। ইতোই জাপানের ঐক্য, জাপানের স্বাধীনত।, জাপানের বিদ্যাবল, সৈন্যবল, নৌসেনাবল, অর্থবল, বাণিজ্য, রাজনীতি মনে কল্পনা করিয়া কার্য্যে পরিণত করিয়াছিলেন। তিনিই ভাবী জাপানের সাম্রাজ্য প্রস্তুত করিতেছিলেন। যাহা করিয়াছেন, প্রায়ই অন্তরালে দাঁড়াইয়া করিয়াছেন। জার্ম্মণীর কাইসার ওয়িলহেম বা বিলাতের লয়েড জর্জ যাহা করিতেছেন, যাহা ভাবিতেছেন, সমস্ত জগৎ তখনই তাহা জানিতে পারে। ইতো যাহা ভাবিতেছিলেন, যাহা করিতেছিলেন, কেহ জানিত না— যখন তাঁহার নিভৃত কল্পনা ও চেষ্টা ফলীভূত হইল, তখন জগৎ বিস্মিত হইয়া বুঝিতে পারিল, ইহাই এতদিন প্রস্তুত হইতেছিল। অথচ কি প্রকাণ্ড কার্য্য, কি অদ্ভুত প্রতিভা সেই কার্য্যে প্রকাশ পাইতেছে। যদি ইতো নিজে মনের কল্পনা করিতে অভ্যস্ত হইতেন, সমস্ত জগৎ পদে পদে তাঁহাকে উন্মত্ত অসাধ্য-সাধন-প্রয়াসী ও ব্যর্থ-স্বপ্নের অনুরক্ত idealist বলিয়া উপহাস করিত। কে বিশ্বাস করিত যে পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে জাপান দুর্লভ স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া সমস্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা আয়ত্ত করিবে, ইংলণ্ড জার্ম্মাণী ফ্রান্সের সমকক্ষ প্রবল পরাক্রমশালী জাতি হইবে, চীনকে পরাভূত করিবে, রুষকে পরাভূত করিবে, দূর দেশবিদেশে জাপানী বাণিজ্য, জাপানী চিত্রকলা, জাপানী বুদ্ধির প্রশংসা ও জাপানী সাহসের ভয় বিস্তার করিবে, কোরিয়া অধিকার করিবে, ফারমোজা অধিকার করিবে, বৃহৎ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করিবে, একতা, স্বাধীনতা, সাম্য, জাতীয় শিক্ষার চরম উন্নতি সাধিত করিবে। নেপোলিয়ন বলিতেন, আমার শব্দকোষে অসাধ্য কথা বাদ দিয়াছি। ইতো সেই কথা বলেন নাই, কিন্তু কার্যে তাহাই করিয়াছিলেন। নেপোলিয়নের কার্য্য অপেক্ষা ইতোর কার্য্য বড়। এইরূপ মহাপুরুষ হত্যা কারীর গুলিতে নিহত হইয়াছেন, ইহাতে কাহারও দুঃখ করিবার নাই। যিনি জাপানের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করিয়াছেন, জাপানই যাঁহার চিন্তা, জাপানই যাঁহার উপাস্য দেবতা, তিনি জাপানের জন্য প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, ইহা বড় সুখের কথা, সৌভাগ্যের কথা, গৌরবের কথা। হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং, জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্। হিরোবূমি ইতোর ভাগ্যে এই দুইটি পরম ফল এক জীবন-বৃক্ষে পাওয়া গেল।