দুই

দু বছরের মধ্যে শ্যামার কোলে আবার ছেলে আসিল। সেই বাড়িতে সেই ছােট ঘরে শরৎকালের তেমনি এক গভীর নিশীথে। কিন্তু মানুষের জীবনে অভাবের পূরণ আছে, ক্ষতির পূরণ নাই বলিয়া প্রথম সন্তানকে শ্যামা ভুলিতে পারে নাই। ছেলে মরিয়া যাওয়ার পর কয়েকমাস সে মুহ্যমানা হইয়াছিল, এই অবস্থাটি অতিক্রম করিতে তাহার মধ্যে যে পবিবর্তন আসিয়াছিল এখনাে তাহা স্থায়ী হইয়া আছে। সন্তানের আবির্ভাবে এবার আর তাহার সেই অসংযত উল্লাস আসে নাই, উদ্দাম কল্পনা জাগে নাই। সে শান্ত হইয়া গিয়াছে। সংসারধর্ম করিলে ছেলেমেয়ে হয়, ছেলেমেয়ে হইলে মানুষ সুখী হয় এবারের ছেলে হওয়াটা তাহার কাছে শুধু এই। এতে না আছে বিস্ময়, না আছে উন্মত্ততা—চোখে পলকে একটা বিরাট ভবিষ্যতকে গড়িয়া তুলিয়া বহিয়া বেড়ানাে, ক্ষণে ক্ষণে নব নব কল্পনার তুলি দিয়া এই ভবিষ্যতের গায়ে রঙ মাখানাে আব সর্বদা ভয়ে ও আনন্দে মশগুল হইয়া থাকা, এসবই কিছুই নাই। এবারও আঁতুড়ে এগারোটি দিবারাত্রি অনির্বাণ দীপ জ্বলিয়াছিল, কিন্তু শ্যামার এবার একেবারেই ভয় ছিল না। শুধু ছিল গভীর বিষণ্ণতা। এবার পূর্বপুরুষেরা গভীর রাত্রে শ্যামার ছেলেকে ভিড় করিয়া দেখিতে আসেন নাই। ছেলের ক্ষীণ বক্ষম্পন্দন হঠাৎ একসময় থামিয়া যাইতে পারে শ্যামার এ আশঙ্কা ছিল, কিন্তু আশঙ্কায় ব্যাকুল হইয়া সে জাগিয়া রাত কাটায় নাই। এ বিষয়ে তাহার কেমন একটা উদাসীনতা আসিয়াছে। ভাবিয়া লাভ নাই, উতলা হইযা লাভ নাই, ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া কোন ফল হইবে না। যিনি দেন তিনিই নেন। তাঁর দেওয়াকে যখন ঠেকানাে যায় না নেওয়াকে ঠেকাইবে কে?

 সে শীতলকে স্পষ্ট বলিয়াছে: এবাব আব যত্নটত্ন করব না বাবু।

 অযত্ন করা কি ভাল হবে?

 অযত্ন করব না তাে। নাওয়াবাে খাওয়াবাে যেমন যেমন দরকাব সব করব। তার বেশি কিছু নয়। কি হবে করে?

 শীতল কিছু বলে নাই। কি বলিবে?

 শ্যামা আবার বলিয়াছে, সেবার আমার দোষেই তাে গেল।

 শীতল একটু ভাবিয়া বলিয়াছে, এটার কিন্তু পয় আছে শ্যামা। হতে হতে কমল প্রেসের চাকরিটা পেলাম।

 বােলো না বাবু ওসব। পয় না ছাই। আগে বাঁচুক।

 কিন্তু কথাটা তুচ্ছ করিবার মত নয়। পয়মন্ত ছেলে? হয় তাে তাই। সব অকল্যাণ ও নিরানন্দের অন্ত করিতে আসিয়াছে হয় তাে। শ্যামা হয় তো আর দুঃখ পাইবে না।

 এরা সময় মত মাইনে দেবে?

 দেবে না? কমল প্রেস কত বড় প্রেস জানাে?

 এবার ছেলে তাহার বাঁচিবে শ্যামা যে এ আশা করে না এমন নয়। মানুষের আশা এমন ভঙ্গুর নয় যে একবার ঘা খাইলে চিরদিনের জন্য ভাঙ্গিয়া পড়িবে। তবু আশাতেই আশঙ্কা বাড়ে। সব শিশুই যদি মরিয়া যাইত পৃথিবীতে এতদিনে তবে আর মানুষ থাকিত না, শ্যামার এই পুরানো যুক্তিটাও এবার হইয়া গিয়াছে বাতিল। সংসারে এমন কত নারী আছে যাদের সন্তান বাঁচে না। সেও যে তাদের মত নয় কে তাহা বলিতে পারে? একে একে পৃথিবীতে আসিয়া তাহার ছেলেমেয়েরা কেউ বারােদিন কেউ ছ'মাস বাঁচিয়া যদি মরিয়া যাইতে থাকে। বলা তাে যায় না। এমনি যাদের অদৃষ্ট তাদের এক একটি সন্তান দশ-বারাে বছর টিঁকিয়া থাকিয়া হঠাৎ একদিন মরিয়া যায়, এরকমও অনেক দেখা গিয়াছে। হালদার বাড়ির বড়বৌ দুবার মৃতসন্তান প্রসব করিয়াছিল, তার পরের সন্তান দুটি বাঁচিয়া ছিল বছরখানেক। শেষে যে মেয়েটা আসিয়াছিল তাহার বিবাহের বয়স হইয়াছিল। কি আদরেই মেয়েটা বড় হইয়াছিল! তবু তাে বাঁচিল না।

 নৈসর্গিক প্রতিবিধানের ব্যবস্থা এবার কম করা হয় নাই। শ্যামা গােটা পাঁচেক মাদুলি ধারণ করিয়াছে, কালীঘাট ও তারকেশ্বরে মানত করিয়াছে পূজা। মাদুলিগুলির মধ্যে তিনটি বড় দুর্লভ মাদুলি। সংগ্রহ করিতে শ্যামাকে কম বেগ পাইতে হয় নাই। মাদুলি তিনটির একটি প্রসাদী ফুল, একটিতে সন্ন্যাসীপ্রদত্ত ভষ্ম ও অপরটিতে স্বপ্নাদ্য শিকড় আছে। শ্যামার নির্ভর এই তিনটি মাদুলিতেই বেশি। নিজে সে প্রত্যেক দিন মাদুলি-ধোয়া জল খায়, একটি একটি করিয়া মাদুলিগুলি ছেলের কপালে ছোঁয়ায়। তারপর খানিকক্ষণ সে সত্যসত্যই নিশ্চিন্ত হইয়া থাকে।

 এবারও মন্দাকিনী আসিয়াছে। সঙ্গে আনিয়াছে তিনটি ছেলেকেই। শ্যামার সেবা করিতে আসিয়া নিজের ছেলের সেবা করিয়াই তাহার দিনকাটে। এমন আব্দারে ছেলে শ্যামা আর দ্যাখে নাই। ঠাকুরমার জন্য কাঁদিতে কাঁদিতে যমজ ছেলে দুটি বাড়ি ঢুকিয়াছিল, তারপর কতদিন কাটিয়া গিয়াছে, এখনাে তাহারা এখানে নিজেদের খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারে নাই। বায়না ধরিয়া সঙ্গে সঙ্গে না মিটিলে ঠাকুরমার জন্যই তাহাদের শোক উথলিয়া ওঠে। দিবারাত্রি বায়নারও তাহাদের শেষ নাই। অপরিচিত আবেষ্টনীতে কিছুই বােধ হয় তাহাদের ভাল লাগে না, সর্বদা খুঁতখুঁত করে। কারণে-অকারণে রাগিয়া কাঁদিয়া সকলকে মারিয়া অনর্থ বাধাইয়া দেয়। মন্দা প্রাণপণে তাহাদের তােয়াজ করিয়া চলে। সে যেন দাসী, রাজার ছেলে দুটি দুদিনের জন্য তাহার অতিথি হইয়া সৌভাগ্য ও সম্মানে তাহাকে পাগল করিয়া দিয়াছে, ওদের তুষ্টির জন্য প্রাণ না দিয়া সে ক্ষান্ত হইবে না। শ্যামা প্রথমে বুঝিতে পারে নাই, পরে টের পাইয়াছে এমনি ভাবে মাতিয়া থাকিবার জন্যই মন্দা এবার ছেলে দুটিকে সঙ্গে আনিয়াছে। সেখানে শাশুড়ীকে অতিক্রম করিয়া ওদের সে নাগাল পায় না। সাধ মিটাইয়া ওদের ভালবাসিবার জন্য, আদর যত্ন করিবার জন্য, সেই যে ওদের আসল মা এটুকু ওদের বুঝাইয়া দিবার জন্য, মন্দা এবার ওদের সঙ্গে আনিয়াছে।

 আনিয়াছে চুরি করিয়া।

 মন্দাই সবিস্তারে শ্যামাকে ব্যাপারটা বলিয়াছে। কথা ছিল শুধু কোলের ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া মন্দা আসিবে, শাশুড়ীর দুচোখের দুটি মণি যমজ ছেলে দুটি, কানু আর কালু, শাশুড়ীর কাছেই থাকিবে। কিন্তু এদিকে কাঁদাকাটা করিয়া স্বামীর সঙ্গে যে গভীর ও গােপন পরামর্শ মন্দা করিয়া রাখিয়াছে শাশুড়ী তার কি জানেন? মন্দাকে আনিতে গিয়াছিল শীতল, কানু ও কালু স্টেশনে আসিয়াছিল বেড়াইতে, রাখাল সঙ্গে আসিয়াছিল তাহাদের ফিরাইয়া লইয়া যাইবার জন্য। গাড়ি ছাড়িবার সময় রাখাল একাই নামিয়া গিয়াছিল। কানু ও কালু তখন নিশ্চিন্ত মনে রসগােল্লা খাইতেছে।

 শীতল বলিয়াছিল, গাড়ি ছাড়ার সময় হ'ল, ওদের নামিয়ে নাও হে রাখাল।

 রাখাল বলিয়াছিল, যাক্ না যাক্, মামাবাড়ি থেকে ক'দিন বেড়িয়ে আসুক।

 মন্দা বলিয়াছিল, ওরাও যাবে যে দাদা। উনি টিকিট কেটেছেন, এই নাও।

 শ্যামাকে ব্যাপারটা বলিবার সময় মন্দা এই সংক্ষিপ্ত কথােপকথনটুকু উদ্ধৃত করিতেও ছাড়ে নাই, বলিয়াছে, দাদা কিছু টের পায় নি বৌ, ভেবেছিল শাশুড়ী বুঝি সত্যি সত্যি শেষে মত দিয়েছে। ফিরে গেলে যা কাণ্ডটা হবে! পেটের ছেলে চুরি করার জন্যে আমায় না শেষে জেলে দেয়।

 এদিক দিয়া শ্যামার বরাবর সুবিধা ছিল, স্বামীর জননীর খেয়াল মত কখনাে তাহাকে পুতুল নাচ নাচিতে হয় নাই। তবু, মাঝে মাঝে শাশুড়ীর অভাবে তাহার কি কম ক্ষোভ হইয়াছে! আর কিছু না হােক, বিপদে আপদে মুখ চাহিয়া ভরসা করিবার সুযোগ তাে সে পাইত। মন্দা কোন দায়িত্ব গ্রহণ করে না, কেবল কাজ চালাইয়া দেয়। সেবার যে শ্যামার ছেলে মরিয়া গেল সে যদি কাহারো দোষে গিয়া থাকে অপরাধিনী শ্যামা, মন্দার কোন ত্রুটি ছিল না। কিন্তু শাশুড়ী থাকিলে তিনিই সকল দায়িত্ব গ্রহণ করিতেন, শুধু আঁতুড়ে তাহাকে এবং বাহিরে তাহার সংসারকে সাহায্য করিয়া ক্ষান্ত না থাকিয়া ছেলেকে বাঁচাইয়া রাখার ভারও থাকিত তাঁহারই। যে সব ব্যবস্থার দোষে ছেলে তাহার মরিয়া গিয়াছিল সে তাহা বুঝিতে না পারুক শাশুড়ীর অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে অবশ্যই ধরা পড়িত। তা ছাড়া, স্বামীর মা তাে পর নয় যে ছেলেকে সব দিক দিয়া ঘেরিয়া থাকিলে তাহাকে কোন মায়ের হিংসা করা চলে! মন্দাকে শ্যামা সমর্থন করিতে পারে না।

 বলে, ওদের না আনলেই ভাল করতে ঠাকুরঝি!

 মন্দা বলে, ভাল দিয়ে আমার কাজ নেই বাবু—সে ডাইনি মাগীর ভাল। আদর দিয়ে দিয়ে মাথা খাচ্ছেন আর দিনরাত জপাচ্ছেন আমাকে ঘেন্না করতে,—বড় হলে ওরা কেউ আমাকে মানবে? এখনি কেমন ধারা করে দাখাে না?

 কিন্তু একটা দিনে ওদের তুমি কি করতে পারবে ঠাকুরঝি? ফিরে গেলেই তাে যে কে সেই। মাঝ থেকে শাশুড়ীর কতগুলাে গালমন্দ খেয়ে মরবে।

 মন্দার এসব হিসাব করাই আছে।

 একটু চেনা হয়ে রইল। একেবারে কাছে ঘেঁষত না, এবার ডাকলে টাকলে একবার দুবার আসবে।

 একদিন বিষ্ণুপ্রিয়া আসিয়াছিল।

 বিষ্ণুপ্রিয়ার একটি মেযে হইয়াছে। মেয়ের জন্মের সময় সেও শ্যামার মত কষ্ট পাইয়াছিল, শ্যামা ভাগ্যের সঙ্গে তাহার ভাগ্যের পার্থক্য কিন্তু সব দিক দিয়াই আকাশ-পাতাল, মেয়েটি তাহার মরে নাই, সােনার চামচে দুধ খাইয়া বড় হইতেছে। বিষ্ণুপ্রিয়ার শরীর খুব খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল, কোথায় হাওয়া বদলাইতে গিয়া সারিয়া আসিয়াছে, কিন্তু এখনাে তাহার চোখ দেখিলে মনে হয় রােগযন্ত্রণার মতই কি একটা অস্থিরতা যেন সে ভিতরে চাপিয়া রাখিয়াছে। তা ছাড়া, তাহার সাজসজ্জার অভাবটা অবাক করিহা দেয়। এমন একদিন ছিল সে যখন বসনভূষণে, কেশরচনা ও দেহমার্জনার অতুল উপাদানে নিজেকে সব সময় ঝক্‌ঝকে করিয়া রাখিত। ত্বকে থাকিত জ্যোতি, কেশে থাকিত পালিশ, বসনে থাকিত বর্ণ ও ভূষণে থাকিত হীরার চমক। এখন সে সব কিছুই তাহার নাই। অলঙ্কার প্রায় সবই সে খুলিয়া ফেলিয়াছে, বিন্যস্ত কেশরাজিতে ধরিয়াছে কতগুলি ফাটল, সে কাছে থাকিলে সাবান ছাড়া আর কোন সুগন্ধির ইঙ্গিত মেলে না। তাও মাঝে মাঝে নিশ্বাসের দুর্গন্ধে চাপা পড়িয়া যায়।

 ঘনিষ্ঠতার বালাই না থাকিলেও মন্দা চিরকাল ঘনিষ্ঠ প্রশ্ন করিয়া থাকে।

 সাজগােজ একেবারে ছেড়ে দিয়েছেন দেখছি।

 বিষ্ণুপ্রিয়া হাসিয়া বলে, এবার মেয়ে ওসব করবে।

 একটি মেয়ে বিইয়েই সন্নেসিনী হয়ে গেলেন?

 একটি দুটির কথা নয় ঠাকুরঝি। নিজে ছেলেমেয়ে মানুষ করতে গেলে ও একটিই থাক আর দুটিই থাক ফিটফাট থাকা আর পােষায় না। মেয়ে এই এটা করছে এই ওটা করছে—নােংরামির চূড়ান্ত, তার সঙ্গে কি এসেন্স মানায়? মেয়ে একটু বড় হলে হয়ত আবার সুরু করব। তা করব ঠাকুরঝি, এ বয়সে কি আর বুড়ি হয়ে থাকব সত্যি সত্যি!

 শ্যামা বলে, মেয়ে বড় হতে হতে আর একটি আসবে যে!

 বিষ্ণুপ্রিয়া জোর দিয়া বলে, না, আর আসবে না।

 মন্দা খিলখিল করিয়া হাসে: বললেন বটে একটা হাসির কথা! এখনি রেহাই পাবেন? আরও কত আসবে, ভগবান দিলে কারাে সাধ্যি আছে ঠেকিয়ে রাখে!

 শ্যামা বলে, ঠাকুরঝি আপনাকে জব্দ করে দিলে।

 বিষ্ণুপ্রিয়া বলে, আমাকে জব্দ করা আর শক্ত কি?

 যে বিষ্ণুপ্রিয়ার এমনি পরিবর্তন হইয়াছে একদিন সকালে সে শ্যামাকে দেখিতে আসিল। মেয়েকে সে সঙ্গে আনিল না। মেয়েকে সঙ্গে করিয়া বিষ্ণুপ্রিয়া কোথাও যায় না, কারাে বাড়ি মেয়েকে যাইতেও দেয় না, ঘরের কোণে লুকাইয়া রাখে। বাড়ির পুরানাে ঝি ছাড়া আর কারাে কোলে সে মেয়েকে যাইতে দেয় না। মেয়ের সম্বন্ধে তাহার একটা সন্দেহজনক গােপনতা আছে, পাড়ার মেয়েরা এমনি একটা আভাস পাইয়া কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছিল। তারপর সকলেই জানিয়াছে। জানিয়াছে যে বিষ্ণুপ্রিয়ার মেয়ে পৃথিবীতে আসিয়াছে পাপের ছাপ লইয়া, মহিম তালুকদার ভীষণ পাপী।

 এবার বিষ্ণুপ্রিয়াকে কার্পেটের আসনটাতেই বসিতে দেওয়া হইল। মন্দা ভদ্রতা করিয়া জিজ্ঞাসাও করিল, আপনাকে এক কাপ চা করে দি ল?

 চা? বিষ্ণুপ্রিয়া চা খায় না।

 খান না? মন্দা সুন্দর অবাক হইতে জানে, কি আশ্চর্যি!-তা, চা আমার মেজননদও খায় না। তার বিয়ে হয়েছে চিলপাহাড়ীর জমিদার বাড়ি, মস্তু বড়লােক তারা, চালচলন সব সাহেবি। বিয়ের আগে আমার ননদ খুব চা খেত, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ছেড়ে দিলে। বললে, চা খেলে গায়ের চামড়া কর্কশ হয়। আমার মেজননদ খুব সুন্দরী কিনা, রঙ প্রায় গিয়ে মেমদের মত কটা, রঙ খারাপ হবার ভয়ে মরে থাকে। আমার কর্তাটিকে দেখেন নি? ওদের হল ফর্সার গুষ্টি, তাদের মধ্যে ওনার রঙ সবচেয়ে মাজা, তারপরেই আমার মেজননদ।

 ছেলেদের জন্য বসিয়া কারাে সঙ্গে কথা বলিবার অবসর মন্দা পায় না। উঠানে দুই ছেলে চৌবাচ্চার জল নষ্ট করিতেছে দেখিয়া সে উঠিয়া গেল। বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল, আপনার ননদটি বেশ। খুব সরল।

 মুখ্যু।

 বিষ্ণুপ্রিয়া প্রতিবাদ করিল না। আঁচলে মুখ মুছিয়া শ্যামার সঙ্গে চোখোচোখি হওয়ায় একটু হাসিল। বাহিরে ঝক্‌ঝকে রােদ উঠিয়াছিল। শহরতলীর বাড়ি, জানালা দিয়া পুকুরও চোখে পড়ে, গাছপালাও দেখা যায়। আর পাখি। শরৎকালে পথ ভুলিয়া কতগুলি পাখি শহরের ধারে আসিয়া পড়িছে।

 বিষ্ণুপ্রিয়া বলিল, তােমার ছেলের জন্যে দুটো একটা জামাটামা পাঠালে কিছু মনে করবে ভাই? মনে যদি কর তাে স্পষ্ট বলাে, মনে এক মুখে আর এক কোরাে না।

 বিষ্ণুপ্রিয়ার বলার ভঙ্গিতে শ্যামা একটু অবাক হইয়া গেল। বলিল, জামার দরকার তাে নেই।

 দরকার নাই বা রইল, বেশিই না হয় হবে।—পাঠাব?

 শ্যামা একটু ভাবিয়া বলিল, আচ্ছা।

 আনকোরা নতুন জামা, দর্জিবাড়ি থেকে সােজা তােমায় দিয়ে যাবে,—আমার মেয়ের জামাটামার সঙ্গে ছোঁয়াছুয়ি হবে না ভাই।

 হলই বা ছোঁয়াছুয়ি?

 বিকালে বিষ্ণুপ্রিয়ার উপহার আসিল। কচি ছেলের দরকারী কয়েকটা জিনিস। গালিচার মত পুরু ও নরম ফ্লানেলের কয়েকটি কাঁথা, ছেলেকে জড়াইয়া পুঁটলি করিয়া কোলে নেওয়ার জন্য ধবধবে সাদা কোমল তিনটি তােয়ালে আর আধ ডজন সেমিজের মত পাতলা লম্বা জামা। শেষােক্ত পদার্থগুলি মন্দাকে বিস্মিত করে।

 এগুলো কি বৌ? আলখাল্লা নাকি?

 শ্যামা হাসে: ঠাকুরঝি যেন কি! সায়েবদের ছেলেরা পরে দ্যাখোনি?

 তুমি যেন কত দেখেছ!

 দেখিনি! গড়ের মাঠে চিড়িয়াখানায় কত দেখেছি!

 ও, কত তুমি বেড়িয়ে বেড়াচ্ছ গড়ের মাঠে চিড়িয়াখানায়!

 না ঠাকুরঝি, ঠাট্টা না, আগে সত্যি নিয়ে যেত, চার পাঁচবার গিয়েছি যে। সায়েবদের কচি কচি ছেলেদের এমনি জামা পরিয়ে ঠেলা গাড়িতে করে আয়ারা বেড়াতে আনত। এমন সুন্দর ছেলেগুলি চুরি করে আনতে সাধ হত আমার।

 পুরানাে কাঁথার উপর শ্যামা নূতন কাঁথা বিছায়, ছেলের গায়ের তৈলাক্ত পেনিটি খুলিয়া বিষ্ণুপ্রিয়ার দেওয়া আলখাল্লা পরায়। তারপর একখানা তোয়ালে জড়াইয়া শােয়াইয়া দেয়। আনন্দে অভিভূতা হইয়া শ্যামা বলে কি রকম দেখাচ্ছে দ্যাখাে ঠাকুরঝি!

 মন্দা হাসিমুখে সায় দিয়া বলে, খাসা দেখাচ্ছে বৌ। ওমা মুখ বাঁকায় যে!

 ছেলেকে শ্যামা সত্যসত্যই পুঁটুলি করিয়াছে। হাত পা নাড়িতে না পারিয়া সে হাঁপাইয়া কাঁদিয়া ওঠে। তােয়ালেটা শ্যামা তাড়াতাড়ি খুলিয়া লয়। মন্দা শিশুকে কোলে লইয়া বলিতে থাকে, অ সােনা, অ মাণিক —তােমায় বেঁধেছিল, শক্ত করে বেঁধেছিল, মরে যাই! শ্যামার গায়ে কাঁটা দেয়, মাথা দুলাইয়া ঝোঁক দিয়া দিয়া মন্দা বলিতে থাকে, মেরেছে? আমার ধনকে মেরেছে? কে মেরেছে রে! আ লাে আ লাে—ন ন ন

 শ্যামা উত্তেজিত হইয়া বলে, ও ঠাকুরঝি ও যে হাসলাে!

 মন্দা দেখিতে পায় নাই। তবু সে সায় দিয়া বলে, পিসীর আদরে হাসবে না?

 কি আশ্চর্য কাণ্ড ঠাকুরঝি! ওইটুকু ছেলে হাসে!

 এবকম আশ্চর্য কাণ্ড দিবারাত্রিই ঘটিতে থাকে। খােকার সম্বন্ধে এবার সে কিনা অনেক বিষয়েই উদাসীন থাকিবে ঠিক করিয়াছে, খােকার আশ্চর্য কাণ্ডগুলিতে অনেক সময় শ্যামা শুধু তাই মনে মনে আশ্চর্য হয়, বাহিরে কিছু প্রকাশ করে না। খােকার হাত পা নাড়িয়া খেলা করা দেখিয়া মনে যখন তাহার দোলা লাগে। খেলার অর্থহীন হাত নাড়া আর ক্ষুধার সময় স্তন খুঁজিয়া হাত-নাড়ার পার্থক্য লক্ষ্য করিয়া তাহার যখন সকলকে ডাকিয়া এ ব্যাপার দেখাইতে ইচ্ছা হয় শ্যামা তখন নিজেকে সতর্ক করিয়া দেয়। স্মরণ করে যে সন্তানকে উপলক্ষ করিয়া জননীর অসংযত উল্লাস অমঙ্গলজনক। আনন্দের একটা সীমা ভগবান মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, মানুষ তাহা লঙ্ঘন করিলে তিনি রাগ করেন। তবু সব সময় শ্যামা কি আর নিজেকে সামলাইয়া চলিতে পারে? অন্যমনস্ক অবস্থায় হঠাৎ একসময় ঝাঁ করিয়া খোকাকে সে কোলে তুলিয়া লয়। তাহার পাজরের একদিকে থাকে হৃৎপিণ্ড আরেক দিকে থাকে খােকা। খোকার লালিম পা দুটি হইতে কেশ বিরল মাথাটি পর্যন্ত শ্যামা অসংখ্য চুম্বন করে দীর্ঘনিশ্বাসে খােকার দেহেব আঘ্রাণ লয়। তারপর সে অনুতাপ করে। বাড়াবাড়ি করিয়া একবার তাহার সর্বনাশ হইয়াছে তবু কি শিক্ষা হইল না?

 শীতলের মিশ্র খাপছাড়া প্রকৃতিতেও বাৎসল্যের আবির্ভাব হইযাছে। বাৎসল্যের বসে তাহার ভীরু উগ্রতাও যেন একটু নরম হইয়া আসিয়াছে। পিতৃত্বের অধিকার খাটাইয়া ছেলের সঙ্গে সে একটু মাখামাখি করিতে চায়, শ্যামা সভয়ে বাধা দিলে রাগ করার বদলে ক্ষুণ্ণই যেন হয়—প্রকৃতপক্ষে রাগ করার বদলে ক্ষুণ্ণ হয় বলিয়াই তাহার বিপজ্জনক আদরের হাত হইতে ছেলেকে বাঁচাইয়া চলিবার সাহস শ্যামার হয়। সে উপস্থিত না থাকিলে ছেলেকে কোলে তুলিতে শীতলকে সে বারণ করিয়া দিয়াছে। মাঝে মাঝে দুচার মিনিটের জন্য ছেলেকে স্বামীর কোলে সে দেয় কিন্তু নিজে কাছে দাঁড়াইয়া থাকে, পুলিসের মত সতর্ক পাহারা দেয়।

 মাঝে মাঝে শীতল তাহাকে ফাঁকি দিবার চেষ্টা করে। রাত্রে হয়ত সে জাগিয়া আছে, খােকা কাঁদিল। চুপি চুপি চৌকি হইতে নামিয়া মেঝেতে পাতা বিছানায় ঘুমন্ত শ্যামার পাশ হইতে খােকাকে সে সন্তর্পণে তুলিয়া লয়—চোরের মত। অনভ্যস্ত অপটু হাতে খোকাকে বুকের কাছে ধরিয়া রাখিয়া নিজে সামনে পিছনে দুলিয়া তাহাকে সে দোলা দেয়, মৃদু গুনগুনানাে সুরে ঘুমপাড়ানাে ছড়া কাটে। বলে—আয় রে পাড়ার ছেলেরা মাছ ধরতে যাই, মাছের কাঁটা পায় ফুটেছে, দোলায় চড়ে যাই। রাতদুপুরে নিজের মুখে ঘুমপাড়ানো ছড়া শুনিয়া মুখখানা তাহার হাসিতে ভরিয়া যায়। এ ছেলে কার?—তার! শ্যামা মানুষ করিতেছে করুক, ছেলে শ্যামার নয়—তার।

 এদিকে শ্যামার ঘুম ভাঙ্গে। কচি ছেলের বুড়ি মা কি আর ঘুমায়? লোক দেখানাে চোখ বুজিয়া থাকে মাত্র। উঠিয়া বসিয়া শীতলের কাণ্ড চাহিয়া দেখিতে শ্যামার মন্দ লাগে না। কিন্তু মনকে সে অবিলম্বে শক্ত করিয়া ফেলে।

 বলে, কি হচ্ছে?

 শীতল চমকাইয়া খােকাকে প্রায় ফেলিয়া দেয়।

 শ্যামা বলে, ঘাড়টা বেঁকে আছে। ওর কত লাগছে বুঝতে পারছ?

 লাগলে কাঁদত।—শীতল বলে।

 কাঁদবে কি? যে ঝাঁকানি ঝাঁকছ, আঁৎকে ওর কান্না বন্ধ হয়েছে।—শ্যামা বলে।

 শীতল প্রথমে ছেলে ফিরাইয়া দেয়। তারপর বলে বেশ করছি! অত তুমি লম্বা লম্বা কথা বলবে না বলে দিচ্ছি খপর্দার! শীতল শুইয়া পড়ে। সে সত্যসত্যই রাগ করিয়াছে অথবা এটা তার ফাঁকা গর্জন শ্যামা ঠিক তাহা বুঝিতে পারে না। খানিক পরে সে বলে, আমি কি বারণ করেছি ছেলে দেব না! একটু বড় হােক, নিও না তখন, যত খুসি নিও। ওকে ধরতে বলে আমারি এখন ভয় করে! কত সাবধানে নাড়াচাড়া করি তবু কালকে হাতটা মুচড়ে গেল।

 শীতল বলে, আরে বাপরে বাপ! রাত দুপুরে বকর বকর করে এ যে দেখছি ঘুমোতেও দেবে না!

 শীতলের মেজাজ ঠাণ্ডা হইয়া আসিয়াছে সন্দেহ নাই। রাগ সে করে না, বিরক্ত হয়। মন যে তাহার নরম হইয়া আসিয়াছে অনেক সময় এটুকু গােপন করিবার জন্যই সে যেন রাগের ভান করে কিন্তু আগের মত জমাইতে পারে না।

 মন্দাকে নেওয়ার জন্য তাহার শাশুড়ী বারবার পত্র লিখিতেছিলেন। মন্দা বারবার জবাব লিখিতেছিল যে পড়িয়া গিয়া তাহার কোমরে ব্যথা হইয়াছে, উঠিতে পারে না, এখন যাওয়া অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত শাশুড়ী বােধ হয় সন্দেহ করিলেন। এক শনিবার রাখালকে তিনি পাঠাইয়া দিলেন কলিকাতায়। রাখালের স্নেহ শ্যামা ভুলিতে পারে নাই, সে আসিয়াছে শুনিয়াই আনন্দে সে উত্তেজিত হইয়া উঠিল, কিন্তু আনন্দ তাহার টিকিল না। রাখালের ভাব দেখিয়া সে বড় দমিয়া গেল। এতকাল পরে তার দেখা পাইয়া রাখাল খুসি হইল মামুলি ধরণে, কথা বলিল অন্যমনে, সংক্ষেপে। শ্যামার ছেলের সম্বন্ধে তাহার কিছুমাত্র কৌতুহল দেখা গেল না।

 সারাদিন পরে বিকালে ব্যাপার বুঝিয়া মন্দা স্বামীকে বলিল, তুমি কি গাে? বৌ কতবার ছেলে কোলে কাছে এল, একবার তাকিয়ে দেখলে না?

 রাখাল বলিল, দেখলাম না? ওই যে বললাম তুমি রােগা হয়ে গেছ বৌঠান?

 মন্দা বলিল, দাদার ছেলে হয়েছে জানো? জানাে আমার মাথা! ছেলেকে একবার কোলে নিয়ে একটু আদর করতে পারলে না? দাদা কি ভাববে!

 রাখাল বলিল, তােমায় আদর করে সময় পেলাম কই?

 মন্দা রাগ করিয়া বলিল, না বাবা, তোমার কি যেন হয়েছে। তামাসাগুলি পর্যন্ত আজকাল রসালাে হয় না।

 তােমার কাছে হয় না। বৌঠানকে ডেকে আনাে হবে।

 মন্দার অনুযোগের যে ফল ফলিল শ্যামার তাহাতে মনে হইল একটু গাল টিপিয়া আদর করিয়া রাখাল বুঝি ছেলেকে তাহার অপমান করিয়াছে। শ্যামার মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হইয়া রহিল। জীবন-যুদ্ধে সন্তানের প্রত্যেকটি পরাজয়ে মার মনে যে ক্ষুব্ধ বেদনার সঞ্চার হয়, এ অসন্তোষ তাহারই অনুরূপ। শ্যামার ছেলে এই প্রথমবার হার মানিয়াছে।

 পরদিন বিকালে রাখাল একাই ফিরিয়া গেল। মন্দা যাইতে রাজি হইল না, রাখালও বেশি পীড়াপীড়ি করিল না। যাওয়ার কথা মন্দাকে সে একবারের বেশি দুবার বলিল কি না সন্দেহ। পথ ভুলিয়া আসার মত যেমন অন্যমনে সে আসিয়াছিল, তেমনি অন্যমনে চলিয়া গেল।

 কি জন্য আসিয়াছিল তাও যেন ভালরকম বােঝা গেল না।

 শীতল গােপনে শ্যামাকে বলিল, রাখাল আবার বিয়ে করেছে শ্যামা।

 বলিল রাত্রে, শ্যামার যখন ঘুম আসিতেছে। শ্যামা সজাগ হইয়া বলিল, কেন ঠাট্টা করছ?

 কিসের ঠাট্টা? ও মাসের সাতাশে বিয়ে হয়েছে। মন্দাকে এখন কিছু বােলাে না। রাখাল বলে গেছে সেই গিয়ে সব কথা খুলে ওকে চিঠি লিখবে। মুখে বলতে এসেছিল, পারল না। আমিও ভেবে দেখলাম, চিঠি লিখে জানানই ভাল।

 উত্তেজনার সময় শ্যামার মুখে কথা যােগায় না। রাখালের ভাবভঙ্গি মনে করিয়া সে আরও মূক হইয়া রহিল। একদিন যে তাহার পরমাত্মীয়ের চেয়ে আপন হইয়া উঠিয়াছিল, গভীর রাত্রে বারান্দায় টিমটিমে আলােয় যার কাছে বসিয়া দুঃখের কথা বলিতে বলিতে সে নিঃসঙ্কোচে চোখ মুছিতে পারিত—শুধু তাই নয়, যে চঞ্চল হইয়া উসখুস করিতে আরম্ভ করিলেও যার কাছে তাহার ভয় ছিল না, এবার সে তাহার কাছে ঘেঁষিতে পারে নাই। একটা কিছু করিয়া না আসিলে কি মানুষ এমন হয়?

 কোথায় বিয়ে হল কি বৃত্তান্ত বল তাে আমায়, গুছিয়ে বলো।—শ্যামা যখন এ অনুরােধ জানাইল, শীতলের চোখ ঘুমে বুজিয়া আসিয়াছে।

 অঁ? বলিয়া সজাগ হইয়া সে যা জানিত গড়গড় করিয়া বলিয়া গেল। তারপর বলিল, বড় ঘুম পাচ্ছে গাে। বাকি সব জিজ্ঞেস কোরাে কাল।

 জিজ্ঞাসা করিবার কিছু বাকি ছিল না, এবার শুধু আলােচনা। শ্যামার সে উৎসাহ ছিল না, সে জাগিয়া শুইয়া রহিল নীরবে। একি আশ্চর্য ব্যাপার যে রাখাল আবার বিবাহ করিয়াছে? স্ত্রী যে তাহার তিনটি সন্তানের জননী একি সে ভুলিয়া গিয়াছিল? অবস্থা বিশেষে পুরুষমানুষের দুবার বিবাহ করাটা শ্যামার কাছে অপরাধ নয়। ধর, এখন পর্যন্ত তার যদি ছেলে হইত, শীতল আবার বিবাহ করিলে তাহা একেবারেই অসঙ্গত হইত না। কিন্তু এখন কি শীতল আর একটা বিবাহ করিতে পারে? কোন যুক্তিতে করিবে!—রাখাল একি কাণ্ড করিয়া বসিয়াছে? মন্দার কাছে সে মুখ দেখাইবে কি করিয়া? রাখালকে শ্যামা চিরকাল শ্রদ্ধা করিয়াছে, কোনদিন বুঝিতে পারে নাই। এবারও রাখালের এই কীতির কোন অর্থ সে খুঁজিয়া পাইল না। এমন যদি হইত যে মন্দার স্বভাব ভাল নয়, সে দেখিতে কুৎসিত, তাহাকে লইয়া রাখাল সুখী হইতে পারে নাই, আবার বিবাহ করিবার কারণটা তাহার শ্যামা বুঝিতে পারিত। মনের মিল তো দুজনের কম হয় নাই? এ বাড়িতে পা দিয়া অসুস্থ মন্দার যে সেবাটাই রাখালকে সে করিতে দেখিয়াছিল তাও শ্যামার মনে আছে।

 এমন কাজ তবে সে কেন করিল? শ্যামা ভাবে, ঘুমাইতে পারে না। চৌকির উপর শীতল নাক ডাকায় ঘুমন্ত সন্তানের মুখ হইতে স্তন আলগা হইয়া খসিয়া আসে, জননী শ্যামা আহত উত্তেজিত বিষণ্ণ মনে আর একটি জননীর দুর্ভাগ্যের কথা ভাবিয়া যায়। রাখালের অপকার্যের একটা কারণ খুঁজিয়া পাইলে সে যেন স্বস্তি পাইত। কে বলিতে পারে এরকম বিপদ তারও জীবনে ঘটিবে কি না? শীতল তাে রাখালের চেয়ে ভাল লােক নয়। কিসের যােগাযােগে স্ত্রী ও জননীর কপাল ভাঙ্গে মন্দার দৃষ্টান্ত হইতে সেটুকু বােঝা গেলে মন্দ হইত না। তারপর একটা কথা ভাবিয়া হঠাৎ শ্যামার হাত পা অবশ হইয়া আসে। মন্দা জননী বলিয়াই হয় তাে বাখালেব স্ত্রীর প্রয়োজন হইয়াছে? ছেলের জন্য মন্দা স্বামীকে অবহেলা কবিয়াছিল, স্ত্রী বর্তমানে রাখাল স্ত্রীর অভাব অনুভব করিয়াছিল—হয়ত তাই সে আবার বিবাহ করিয়াছে?

 পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গিয়া শীতল দেখিল বুকের উপর ঝুঁকিয়া মুখের কাছে হাসিভরা মুখখানা আনিয়া শ্যামা তাহাকে ডাকিতেছে। শ্যামা যে রাত্রেই বার বার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল ছেলের জন্য কখনাে সে স্বামীকে তাহার প্রাপ্য হইতে বঞ্চিত করিবে না। শীতল তাে তাহা জানিত না, এও সে জানিত না যে প্রতিজ্ঞা-পালনে স্বামীর ঘুম ভাঙ্গিবার নিয়মিত সময় পর্যন্ত সবুর শ্যামার সহে নাই। শীতল তাহাকে ধাক্কা দিয়া সরাইয়া দিল। বলিল, হয়েছে কি?

 বেলা হল উঠবে না?

 শীতল পাশ ফিরিয়া শুইল। বিড়বিড় করিয়া সে যা বলিল তা গালাগালি।

 তখন শ্যামা বুঝিতে পারিল সে ভুল করিয়াছে। ছেলের জন্য স্বামীকে অবহেলা না করিবার প্রক্রিয়া এটা নয়। স্বামী যতটুকু চাহিবে দিতে হইবে ততটুকু, গায়ে পড়িয়া সােহাগ করিতে গেলে জুটিবে গালাগালি।

 মন্দার কোন পরিবর্তন নাই। সে তাে এখনাে জানে না। ছেলেদের লইয়া সে ব্যস্ত ও বিব্রত হইয়া রহিল। আড়চোখে তাহার সানন্দ চলাফেরা দেখিতে দেখিতে শ্যামার বড় মমতা হইতে লাগিল। সে মনে মনে বলিল, অ পােড়াকপালী! বেশ হেসে খেলে সময় কাটাচ্ছ, ওদিকে তােমার যে সর্বনাশ হয়ে গেছে। যখন জানবে তুমি করবে কি?—একটা বিড়ালছানার জন্য মারামারি করিয়া কানু ও কালু কাঁদিতেছিল। দেখাদেখি কোলের ছেলেটিও কান্না জুড়িয়াছিল। শ্যামা সাহায্য করিতে গেলে মন্দা তাহাকে হটাইয়া দিল। তিনজনকে সে সামলাইল একা।

 শ্যামার চোখ ছলছল করিতে লাগিল। সে মনে মনে বলিল, কার ছেলেদের এত ভালবাসছ ঠাকুরঝি? সে তাে তােমার মান রাখে নি!

 মন্দার সমস্যা শ্যামাকে বড় বিচলিত করিয়াছে। রাখালের প্রতি সে যেন ক্রমে ক্রমে বিদ্বেষ বােধ করিতে আরম্ভ করে। সংসাবে স্ত্রীলােকের অসহায় অবস্থা বুঝিতে পারিয়া নিজের কাছে সে অপদস্থ হইয়া যায়। যে আশ্রয় তাহাদের সবচেযে স্থায়ী কত সহজে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। যে লােকটির উপর সব দিক দিয়া নির্ভর করিতে হয়, কত সহজে সে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বসে।

 মন্দা অবশ্যই এবার অনেক দিন এখানে থাকিবে। এ আরেক সমস্যার কথা। আর্থিক অবস্থা তাহাদের স্বচ্ছল নয়, নূতন চাকরীতে শীতল নিয়মিত মাহিনা পায় বটে, টাকার অঙ্কটা কিন্তু ছােট। শীতলের কিছু ধার আছে, মাঝে মাঝে কিছু কিছু শুধিতে হয়, সুদও দিতে হয়। খরচ চলিতে চায় না। তিনটি ছেলে লইয়া মন্দা বেশি দিন এখানে থাকিলে বড়ই তাহারা অসুবিধায় পড়িবে। শ্যামা অবশ্য এসব অসুবিধার কথা ভাবিতে বসিত না, অত ছােট মন তাহার নয়,—যদি তাহার খােকাটি না আসিত। মন্দার জন্য তাহারা স্বামী-স্ত্রী না-হয় কিছুদিন কষ্টই ভোগ করিল, কারাে খাতিরে খােকাকে তো তাহারা কষ্ট দিতে পারিবে না! ওর যে ভাল জামাটি জুটিবে না, দুধ কম পড়িবে, অসুখে বিসুখে উপযুক্ত চিকিৎসা হইবে না, শ্যামা তাহা সহিবে কি করিয়া? নিজের ছেলের কাছে নাকি ননদ ও তাহার ছেলেমেয়ে! যতদিন সম্ভব ঠিক ততদিনই মন্দাকে সে এখানে থাকিতে দিবে। তারপর মুখ ফুটিয়া বলিবে, আমাদের খরচ চলছে না ঠাকুরঝি। বলিবে, অভিমান চলবে কেন ভাই? মেয়েমানুষের এমনি কপাল। এবার তুমি ফিরে যাও ঠাকুরজামায়ের কাছে।

 হিসাবে শ্যামার একটু ভুল হইয়াছিল। কয়েকদিন পরে রাখালের পত্র আসিবামাত্র বনগাঁ যাওয়ার জন্য মন্দা উতলা হইয়া উঠিল। সে কোনমতেই বিশ্বাস করিতে চাহিল না, রাখাল আবার বিবাহ করিয়াছে। বারবার সে বলিতে লাগিল, সব মিছে কথা। সে বনগাঁ যায় নাই বলিয়া রাগিয়া রাখাল এরকম চিঠি লিখিয়াছে। একথা কখনাে সত্যি হয়? তবু, এরকম অবস্থায় তাহার অবিলম্বে বনগাঁ যাওয়া দরকার। আমায় আজকেই রেখে এসো দাদা, পায়ে পড়ি তােমার।

 এদিকে, সেদিন আরেক মুস্কিল হইয়াছে। রাত্রে শ্যামার ছেলের হইয়াছিল জ্বর, সকালে থার্মোমিটার দিয়া দেখা গিয়াছে জ্বর একশ দুইএর একটু নিচে। ছেলে কোলে করিয়া শেষরাত্রি হইতে শ্যামা ঠায় বসিয়া কাটাইয়াছে। ভাবিয়া ভাবিয়া সে বাহির করিয়াছে যে বারোকে চার দিয়া গুণ করিলে যত হয় ছেলের বয়স এখন তাহার ঠিক ততদিন। আগের খােকাটি তাহার ঠিক বারােদিন বাঁচিয়াছিল। বনগাঁ অনেক দূর, শীতলকে শ্যামা ছাপাখানায় পর্যন্ত যাইতে দিতে রাজি নয়।

 শীতল বলিল, দুদিন পরেই যাস মন্দা। চিঠিপত্র লেখা হােক, একটা খবর দিয়ে যাওয়াও তাে দরকার। থােকার জ্বরটাও ইতিমধ্যে হয়ত কমবে।

 মন্দা শুনিল না। বাড়িটা হঠাৎ তাহার কাছে জেলখানা হইয়া উঠিয়াছে। সে মিনতি করিয়া বলিতে লাগিল, আজ না পার, কাল আমাকে তুমি রেখে এসো দাদা। সকালে রওনা হলে বিকেলের গাড়িতে ফিরে আসতে পারবে তুমি।

 শীতল বলিল, ব্যস্ত হােস কেন মন্দা, দেখাই যাক না কাল সকাল পর্যন্ত, খােকার জ্বর আজকের দিনের মধ্যে কমে যেতেও পারে তাে।

 বিকালে খােকার জ্বর কমিল, শেষরাত্রে আবার বাড়িয়া গেল। সকালে মন্দা বলিল, আমার তবে কি উপায় হবে বৌ? আমি তাে থাকতে পারি না আর। দাদা যদি নাই যেতে পারে, আমায় গাড়িতে তুলে দিক, ওদের নিয়ে আমি একাই যেতে পারব।

 শ্যামা রাত্রে ভাবিয়া দেখিয়াছিল, মন্দাকে আটকাইয়া রাখা সঙ্গত নয়। উদ্বেগে ও আশঙ্কায় সে এখন বনগাঁ যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে, পরে হয়ত মত পরিবর্তন করিয়া বসিবে, আর যাইতেই চাহিবে না। বলিবে, অমন স্বামীর মুখ দেখার চেয়ে ভাইএর বাড়ি পড়িয়া থাকাও ভাল। বােনকে পুষিবার ক্ষমতা যে শীতলের নাই এতাে আর সে হিসাব করিবে না। তার চেয়ে ও যখন যাইতে চায়, ওকে যাইতে দেওয়াই ভাল। একদিনে তাহার খােকার কি হইবে? শীতল তাে ফিরিয়া আসিবে রাত্রেই।

 এই সব ভাবিয়া শ্যামা শীতলকে বনগাঁ যাইতে বাধা দিল না। জিনিস পত্র মন্দা আগের দিনই বাঁধিয়া ছাঁদিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। একচড়া আলুভাতে ফুটাইয়া কালু ও কানুকে খাওয়াইয়া, কোলের ছেলেটির জন্য বােতলে দুধ ভরিয়া লইয়া শীতলের সঙ্গে সে রওনা হইয়া গেল। গাড়িতে ওঠার সময় মন্দা একটু কাঁদিল, শ্যামাও কয়েকবার চোখ মুছিল।

 গাড়ি যেন চোখের আড়াল হইল না, শ্যামার ছেলের জ্বর বাড়িতে আরম্ভ করিল। ঝিকে দিয়া কই মাছ আনাইয়া শ্যামা এবেলা শুধু ঝােলভাত রাঁধিবাব আয়ােজন করিয়াছিল, সব ফেলিয়া রাখিয়া দুরুদুরু বুকে অবিচলিত মুখে সে ছেলেকে কোলে করিয়া বসিল। নিয়তির খেলা শ্যামা বােঝে বৈ কি! মন্দার ভার এড়াইবার লােভে শীতলকে যাইতে দেওয়ার দুর্মতি নতুবা তাহার হইবে কেন? স্বামী আবার বিবাহ করিয়াছে বলিয়া মন্দা চিরকাল ভাইয়ের সংসারে পড়িয়া থাকিত, এ আশঙ্কা শ্যামার কাছে এখন অর্থহীন মনে হইল। কাঁধে শনি ভর না করিলে মানুষ ভবিষ্যতের একটা কাল্পনিক অসুবিধার কথা ভাবিয়া ছেলের রােগকে অগ্রাহ্য করে? ছেলে যত ছটফট করিয়া কাঁদিতে লাগিল, অনুতাপে শ্যামার মন ততই পুড়িয়া যাইতে লাগিল। যেমন ছোট তাহার মন, তেমনি উপযুক্ত শাস্তি হইয়াছে। তার মত স্বার্থপর হীনচেতা স্ত্রীলােকের ছেলে যদি না মরে তাে মরিবে কার? একা সে এখন কি করে!

 ঠিকা কি বাসন মাজিতেছিল। তাহাকে ডাকিয়া শ্যামা বলিল, খােকার বড় জ্বর হয়েছে সত্যভামা, বাবু বনগাঁ গেলেন, কি হবে এখন?

 ঝি শতমুখে আশ্বাস দিয়া বলিল, কমে যাবে মা, কমে যাবে। ছেলেপিলের অমন জ্বর জ্বালা কত হয়, ভেবোনি।

 তুমি আজ কোথাও যেয়াে না সত্যভামা।

 কিন্তু না গিয়া সত্যভামার উপায় নাই। সে ধরিতে গেলে স্বামীহীনা, কিন্তু তাহার চারটি ছেলেমেয়ে আছে। তিন বাড়ি কাজ করিয়া সে ইহাদের আহার যােগায়, শ্যামার কাছে বসিয়া থাকিলে তাহার চলিবে কেন? সত্যভামার বড় মেয়ে রাণীর বয়স দশ বছর, তাহাকে আনিয়া শামার কাছে থাকিতে বলিয়া সে সরকারদের কাজ করিতে চলিয়া গেল। রাণীর একটা চোখে আঞ্জিনা হইয়াছিল, চোখ দিয়া তাহার এত জল পড়িতেছিল যেন কার জন্য শোক করিতেছে। শ্যামা এবার একেবারে নিঃসন্দেহ হইয়া গেল। এমন যােগাযােগ, এত সব অমঙ্গলের চিহ্ন, একি ব্যর্থ যায়? আজ দিনটা মেঘলা করিয়া আছে। শীত পড়িয়াছে কনকনে। খােকাব জ্বরের তাপে শ্যামার কোল যত গরম হইয়া ওঠে, হাত পা হইয়া আসে তেমনি ঠাণ্ডা। মাঝে মাঝে শ্যামার সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরিয়া যায়। বেলা বারোটার সময় খোকার ভাঙ্গা ভাঙ্গা কান্না থামিল। ভয়ে ভাবনায় শ্যামা আধমরা হইয়া গিয়াছিল, তবু তাহার প্রথম ছেলেকে হারানাের শিক্ষা সে ভােলে নাই.—তাড়াতাড়ি নয়, বাড়াবাড়ি নয়। এরকম উত্তেজনার সময় ধীরতা বজায় বাখা অনভ্যস্ত অভিনয়ের সামিল, শ্যামার চিন্তা ও কার্য দুই অত্যন্ত শ্লথ হইয়া গিয়াছিল। তিনবার থার্মোমিটার দিয়া সে ছেলের সঠিক টেম্পারেচার ধরিতে পারিল। একশ তিন উঠিয়াছে। জ্বর এখনাে বাড়িতেছে বুঝিতে পারিয়া রাণীকে সে ওপাড়ার হারান ডাক্তারকে ডাকিতে পাঠাইয়া দিল। এতক্ষণে সে টের পাইয়াছে জ্বরের বৃদ্ধি স্থগিত হওয়ায় প্রতীক্ষায় এতক্ষণ ডাক্তার ডাকিতে না পাঠানাে তাহার উচিত হয় নাই। হারান ডাক্তার যেমন গম্ভীর তেমনি মন্থর। আজ যদি রোগী দেখিয়া ফিরিতে তাহার বেলা হইয়া থাকে, স্নান করিয়া খাইয়া ব্যাপার দেখিতে আসিবে সে তিন ঘণ্টা পরে। রাণী কি রােগীর অবস্থাটা তাহাকে বুঝাইয়া বলিতে পারিবে? সামান্য জ্বর মনে করিয়া হারান ডাক্তার যদি বিকালে দেখিতে আসা স্থির করে? ছেলেকে ফেলিয়া রাখি শ্যামা সদর দরজা গিয়া পথের দিকে তাকায়। রণীকে দেখিতে পাইলে ডাকিয়া ফিরাইয়া একটি কাগজে হারান ডাক্তারকে কয়েকটি কথা লিখিয়া দিবে। রাণীকে সে দেখিতে পায় না। শুধু পাড়ার ছেলে বিনু ছাড়া পথে কেহ নাই।

 শ্যামা ডাকে, অ বিনু, অ ভাই বিনু, শুনছ?

 কি?

 খােকাব বড্ড জ্বর হয়েছে ভাই। কেমন অজ্ঞানের মত হয়ে গেছে, লক্ষ্মী দাদাটি একবার ছুটে হারান ডাক্তারকে গিয়ে বল গে—

 আমি পারব না। বিনু বলে। শ্যামা বলে, ও ভাই বিনু শােন ভাই একবার—

 বাড়াবাড়ি সে উতলা হইয়াছে? ঘরে গিয়া শ্যামা কাঁদে। দেখাে ছেলে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলিতেছে। চোখ বুজিয়া নিশ্বাস ফেলিতেছে। ওকি আর চোখ মেলিবে?

 হারান ডাক্তার দেরি না করিয়াই আসিল। হারান যত মন্থর হােক তার পুরানাে নড়বড়ে ফোর্ড গাড়িটা এখনাে ঘণ্টায় বিশ মাইল যাইতে পারে। ভাত খাইয়া সে ধীরে ধীরে পান চিবাইতেছিল। ঘরে ঢুকিয়া সে প্রথমে চিকিৎসা করিল শ্যমার। বলিল, কেঁদো না বাছা। রোগ নির্ণয় হবে না।

 কেমন তাহার রোগ নির্ণয় কে জানে। খােকার গায়ে একবার হাত দিয়াই হুকুম দিল, এক গামলা ঠাণ্ডা জল কলসী থেকে এনাে।

শ্যামা গামলায় জল আনিলে হারান ডাক্তার ধীরে ধীরে খােকাকে তুলিয়া গলা পর্যন্ত জলে ডুবাইয়া দিল। এক হাতে সেই অবস্থায় তাহাকে ধরিয়া রাখিয়া অন্য হাতে ভিজাইয়া দিতে লাগিল তাহার মাথা। খােকাব মার অনুমতি চাহিল না, এরকম বিপজ্জনক চিকিৎসার কোন কৈফিয়ৎও দিল না।

 শ্যামা বলিল, একি করলেন?

 হারান ডাক্তার বলিল, শুকনো তােয়ালে থাকলে দাও। না থাকলে শুকনাে কাপড়েও চলবে।

 শ্যামা বিষ্ণুপ্রিয়াএ দেওয়া একটি তােয়ালে আনিয়া দিলে জল হইতে তুলিয়া তােয়ালে জড়াইয়া খােকাকে হারান শােয়াইয়া দিল। নাড়ী দেখিয়া চৌকির পাশের দিকে সরিয়া গিয়া ঠেস দিল দেয়ালে। পান সে আজ আগাগােড়া জাবর কাটিতেছিল, এবার বুজিল চোখ।

 শ্যামা বলিল, আমার কি হবে ডাক্তারবাবু?

 হারান রাগ করিয়া বলিল, এই তাে, এই তাে তােমাদের দোষ! কাঁদবার কারণটা কি হল? ওর আরেকটা বাথ দিতে হবে বলে বসে আছি বাছা, তোমাদের দিয়ে তাে কিছু হবার যাে নেই, খালি কাঁদতে জানাে।

 হারান বুড়া হইয়াছে, তাহাকে ডাক্তারবাবু বলিতে শ্যামার কেমন বাধিতেছিল। রােগীর বাড়িতে ডাক্তারের চেয়ে পর কেহ নাই, সে মানুষ নয়, সে শুধু একটা প্রয়ােজন, তিতাে ওষুধের মত সে একটা হিতৈষী বন্ধু। হারানকে পর মনে করা কঠিন। তাঁহাকে দেখিয়া এতখানি আশ্বাস মেলে, অথচ এমনি সে অভদ্র যে আত্মীয় ভিন্ন তাহাকে আর কিছু মনে করিতে কষ্ট হয়।

 শ্যামা তাই হঠাৎ বলিল, আপনি একটু শােবেন বাবা? দেয়ালে ঠেস দিয়ে কষ্ট হচ্ছে আপনার।

 কষ্ট? হাসিতে গিয়া হারান ডাক্তারের মুখের চামড়া অনভ্যস্ত ব্যায়ামে কুঁচকাইয়া গেল, এতক্ষণে শ্যামার দিকে সে যেন একটু বিশেষ ভাবে চাহিয়া দেখিল, না মা, কষ্ট নেই, শােব—একেবাবে বাড়ি গিয়ে শােব। দুটো পান দিতে পার, বেশ করে দোক্তা দিয়ে?

 শ্যামা পান সাজিয়া আনিয়া দিল। এটুকু সে বুঝিতে পারিয়াছিল যে খােকার অবস্থা বিপজ্জনক, নহিলে ডাক্তার মানুষ যাচিয়া বসিয়া থাকিবে কেন? এত জ্বরের উপর জলে ডুবাইয়া চিকিৎসাও কি মানুষ সহজে করে? তবু শ্যামা অনেকটা নিশ্চিন্ত হইয়াছে। সে তাে ডাক্তারি বিদ্যার পরিচয় রাখে না, সে জানে ডাক্তারকে। জীবনমরণের ভার যে ডাক্তার পান চিবাইতে চিবাইতে লইতে পারে, সেই তো ডাক্তার,—মরণাপন্ন ছেলেকে ফেলিয়া এমন ডাক্তারকে পান সাজিয়া দিতে শ্যামা খুসিই হয়। পান আর এক খাবলা দোক্তা মুখে দিয়া হারান শীতলের কথা জিজ্ঞাসা করিল। আধ ঘণ্টা পরে খােকার তাপ লইয়া বলিল, জ্বর বাড়েনি। তবু গাটা একবার মুছে দিই, কি বল মা?

 হারান ডাক্তার গম্ভীর নয়। রােগীর আত্মীয়স্বজনকে সে শুধু গ্রাহ্য কবে না, ওর মধ্যে যে তার সঙ্গে ভাব জমাইতে পারে বুড়া তার সঙ্গে কথা বড় কম বলে না। বাবা বলিয়া ডাকিয়া শ্যামা তাহার মুখ খুলিয়া দিয়াছে, রাজ্যের কথার মধ্যে খোকার যে কত বড় ফাঁড়া কাটিয়াছে তাও সে শ্যামাকে শােনাইয়া দিল। বলিল বিকাল পর্যন্ত তাহাকে না ডাকিলে আর দেখিতে হইত না। জ্বর বাড়িতে বাড়িতে এক সময়—

 গিয়ে একটা ওষুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি রাণীর হাতে—পাঁচ ফোঁটা করে খাইয়ে দিও দুধের সঙ্গে মিশিয়ে চামচেয়—গরুর দুধ নয় মা সে ভুল যেন করে বােসাে না। আধ ঘণ্টা পর পর তাপ নিয়ে যদি দ্যাখাে জ্বর কমছে না, গা মুছে দিও।

 সন্ধ্যাবেলা আপনি আর একবার আসবেন বাবা।

 হারান দবজার কাছে গিয়া একবাব দাঁড়াইল। বলিল, ভয় পেয়ো না মা। এবার জ্বর কমতে আরম্ভ করবে।

 শ্যামা ভাবিল সাহস দিবার জন্য নয় হারান হয়ত ভিজিটের টাকার জন্য দাঁড়াইয়াছে। কত টাকা দিবে, যাহাকে বাবা বলিয়া ডাকিয়াছে দুটো একটা টাকা কেমন করিয়া তাহার হাতে দিবে, শ্যামা ভাবিয়া পাইতেছিল না। অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে সে বলিল, উনি বাড়ি নেই।

 এলে পাঠিয়ে দিও। বলিয়া হারান চলিয়া গেল। স্বয়ং শীতলকে অথবা ভিজিটের টাকা কি যে সে পাঠাইতে বলিয়া গেল কিছুই বুঝিতে পারা গেল না।

 শীতলের ফিরিবার কথা ছিল রাত্রি আটটায়। সে আসিল পরদিন বেলা বারটাব সময। বিষ্ণুপ্রিয়া কার কাছে খবর পাইয়া এবেলা শ্যামাকে ভাত পাঠাইয়া দিয়াছিল, শীতল যখন আসিয়া পৌঁছিল সে তখন অনেক ব্যঞ্জনের মধ্যে শুধু মাছ দিয়া ভাত খাইয়া উঠিয়াছে এবং নিজেকে তাহার মনে হইতেছে রোগমুক্তাব মত।

 শীতল জিজ্ঞাসা করিল, খােকা কেমন?

 ভাল আছে।

 কাল গাড়ি ফেল করে বসলাম, এমন ভাবনা হচ্ছিল তােমাদের জন্যে!

 শ্যামার মুখে অনুযােগ নাই, সে গম্ভীর ও রহস্যময়ী। কাল বিপদে পড়িয়া কারো উপর নির্ভর করিবার জন্য সে মরিয়া যাইতেছিল, আজ বিপদ কাটিয়া যাওয়ার পর কিছু আত্মমর্যাদার প্রয়ােজন হইয়াছে।