জয়তু নেতাজী (১৯৫০)/গান্ধীজী ও নেতাজী

গান্ধীজী ও নেতাজী

 অতিশয় বর্ত্তমানে ভারতবর্ষের অদৃষ্ট-কটাহে দেবে ও দানবে মিলিয়া যে তরল পদার্থটিকে ঘন ঘন তাড়না করিতেছে, তাহা যে শেষে কি রূপ ধারণ করিবে―পাত্রটির তলদেশ ফাঁসিয়া যাইবে, না ষড়গুণবলিজারিত হইয়া একটি সর্ব্বরোগহর মহৌষধির উদ্ভব হইবে―তাহা দেবাঃ ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ? তথাপি ক্রমেই অবস্থা যেরূপ হইয়া দাঁড়াইতেছে তাহাতে, একটা কিছু চূড়ান্ত যে শীঘ্রই―অন্ততঃ দুই চারি বৎসরের মধ্যে―স্থির হইয়া যাইবে, এমন সম্ভাবনাই অধিক। এ বিষয়ে ভারতবাসী আপামর-সাধারণ উদ্বেগ অনুভব করিতেছে, তাহার কারণ, ব্যাপারটা আর কেতাবী রাজনীতির মধ্যেই আবদ্ধ নাই―প্রত্যেক নর-নারীর সদ্য জীবন-মরণ-সমস্যার বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। যাহা ছিল মূলে একটা পৃথক রাষ্ট্রনৈতিক আন্দোলন, তাহাই জীবন-রক্ষার প্রাণান্তিক চেষ্টা হইয়া দাঁড়াইয়াছে; সদ্য-সমাপ্ত মহাযুদ্ধের পর, পৃথিবীর অন্যত্রও যেমন ভারতবর্ষেও তেমনই, পূর্ব্বের সমস্যা নূতন রূপ ধারণ করিয়াছে; এক্ষণে প্রায় সকলেরই গ্রাসাচ্ছাদন পর্য্যন্ত সঙ্কটাপন্ন হইয়া উঠিয়াছে―এমন আর কখনও হয় নাই। তাই, সকল তত্ত্ব সকল নীতি ঐ একটিমাত্র তত্ত্বে পর্য্যবসিত হইয়াছে―সদ্য-বিনাশ বা মহামৃত্যুর আক্রমণ হইতে রক্ষার উপায়। এখন প্রত্যেক মানুষ প্রতি মুহুর্ত্তে সেই সমস্যাকে একেবারে দেহের দ্বারা অনুভব করিতেছে, কোন দূরতর রাজনৈতিক লক্ষ্য, গভীরতর ও উচ্চতর অভিপ্রায়-সিদ্ধির জন্য অপেক্ষা করিবার সময় বা সামর্থ্য নাই। রাজনীতি এখন সাক্ষাৎ অন্ন-নীতি হইয়া দাঁড়াইয়াছে; ভারতবর্ষের মানুষ এতদিনে, বালবৃদ্ধবনিতা-নির্ব্বিশেষে, সকল রাজনীতির মূলনীতিকে জঠরের সাহায্যেই মস্তিষ্কগােচর করিয়াছে―মৃত্যুর করালমূর্ত্তি তাহার জীব-চৈতন্যে হানা দিয়াছে। এতদিনে যাহাকে একটা আদর্শ-প্রীতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বা মহতের অসন্তোষ বলিয়া সাধারণ নরনারী তেমন গ্রাহ্য করে নাই, আজ তাহাকে অতি ক্রূর বাস্তবরূপে―শ্বাসকষ্টের মত―অনুভব করিতেছে। এই অবস্থার নিদান এবং ইহার আরােগ্য-চিন্তার অধিকার এখন আর কোন দল বা সম্প্রদায়ের নয়―সকলের; এখন আর কোন মতবাদ নয়―যাহা প্রত্যক্ষ তাহাকেই স্বীকার করিতে হইবে। এই প্রবন্ধে আমি সেই অধিকার সকলকে দিয়া, এই অবস্থার পূর্ব্বাপর ইতিহাস, এবং সেই ইতিহাসে এ পর্য্যন্ত যে দুইটি প্রধান নায়ক-মূর্ত্তি দেখা দিয়াছে তাঁহাদের নীতি ও কীর্ত্তি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ আলোচনা করিব।

* * *

 দেশের এই অবর্ণনীয় দুর্দ্দশার মূলে যে একটিমাত্র কারণ আছে―পরাধীনতা, আজ তাহা বালকেও স্বীকার করিবে, কিন্তু এই পরাধীনতা যে ঠিক কিরূপ সে বিষয়ে খুব স্পষ্ট ধারণা আমাদের কখনও ছিল না। এমন কথা বলিলে বোধ হয় অযথার্থ হইবে না যে, ইংরেজ আসিবার পূর্ব্বে, এবং ইংরেজ অধিকারের প্রথম কিছুকাল আমরা সত্যই পরাধীনতা ভোগ করি নাই, তার কারণ, আমাদের জাতির রাজনৈতিক সংস্কারই অন্যরূপ। রাজাকে আমরা চিরদিন দেশের শান্তিরক্ষক প্রধান প্রহরীরূপেই দেখিতাম; যেখানে প্রকৃত স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়োজন ছিল সেখানে ঐ রাজার সহিত সম্বন্ধ ছিল না; সমাজই ছিল আমাদের প্রকৃত রাষ্ট্র, সেখানে আমরা সত্যই স্বাধীন ছিলাম। রাজার সাময়িক খেয়াল-খুশির অত্যাচার সত্ত্বেও আমাদের সেই স্বাধীনতা কখনও ক্ষুণ্ণ হয় নাই। অতএব আজ আমরা যে পরাধীনতার সম্বন্ধে এত সচেতন হইয়াছি, সেই পরাধীনতার সংস্কারও যে পুর্ব্বে ছিল না, ইহা এক অর্থে সত্য। কিন্তু ক্রমেই পরাধীনতা নামক একটি বস্তুর, চেতনা না হউক―বাস্তব অস্তিত্ব বৃদ্ধি পাইতে লাগিল; ইংরেজই আমাদের স্বাধীনতা হরণ করিল, কেমন করিয়া তাহাই বলিব।

 ইংরেজ শাসনের পূর্ব্বে, ঐতিহাসিক কালে আমরা যত প্রকার শাসনের অধীন হইয়াছিলাম, তাহাতে শাসক জাতির একটা রাজত্বাভিমানই ছিল, তাহাদের রাজপ্রাপ্য যে বশ্যতা―অর্থাৎ রাজা-প্রজা-সম্বন্ধ মাত্র স্বীকার―তাহার বেশি তাহারা চাহে নাই―প্রয়োজনও ছিল না। ইংরেজ যখন এদেশে তাহার শাসন-বিস্তার ও প্রভুত্ব-প্রতিষ্ঠা করিল, তখন আমরা তাহাদিগকে সেই চক্ষেই দেখিয়াছিলাম, সেই পূর্ব্ব রাজগণের উত্তর-পুরুষ বলিয়াই মনে করিয়াছিলাম, ভিন্ন জাতি বলিয়া শঙ্কিত হইবার কোন কারণ তখন ঘটে নাই। তার কারণ, বিদেশী রাজবংশ জাতিহিসাবে যতই স্বতন্ত্র হউক, তাহাদের সেই ‘জাতি’―ধর্ম্ম ও সমাজঘটিত একটা পার্থক্যের কারণ হইলেও, তাহাতে কোন রাজনৈতিক বৈষম্য-বিষ বেশিদিন টিকিয়া থাকিত না,―সেই জাতিও দেশেরই একটা জাতিতে পরিণত হইয়া যাইত। এইজন্যই, ভারতবাসী, ইংরেজ-রাজ ও তাহার রাজত্বের আসল রূপ অনেকদিন চিনিতে পারে নাই―তার কারণ, ধূর্ত্ততা ও কূটনীতিতে সেই জাতি জগতে অগ্রগণ্য―ভারতবাসী এখনও তাহার নিকটে বালক মাত্র। ইংরেজ এখানে কোন রাজধর্ম্ম পালন করিতে আসে নাই―সে-ধর্ম্ম সে পালন করে নিজের দেশে, এ দেশ তাহার বিদেশ, এখানে সে বাস করে না―কখনো করিবে না। সে আসিয়াছিল বাণিজ্য করিতে, পরে যখন একচ্ছত্র ক্ষমতা লাভ করিল, তখন সে তাহার বাণিজ্যের আবরণেই বেপরোয়াভাবে লুঠ করিতে আরম্ভ করিল। ঐ লুণ্ঠন-নীতিই তাহার রাজনীতি, সেই রাজনীতির সম্যক অনুষ্ঠান-কল্পে সে পুলিশ-বাহিনী, আদালত ও জেলখানা, এবং সেই সকলের খরচপত্র-নির্ব্বাহের জন্য অনেক গুলি দপ্তর―ভারত-গবর্ণমেণ্ট নামে প্রতিষ্ঠা করিয়াছে; একদিকে তাহাতে তাহার সেই আসল অভিপ্রায় যেমন সিদ্ধ হইতেছে, অপরদিকে তেমনই শান্তি-রক্ষা ও বিচার প্রভৃতির রাজকর্ত্তব্যও সুন্দর অভিনীত হইতেছে। ইংরেজ-রাজ যে মূলে পুলিশ-রাজ, ইহা কাহারও অবিদিত নাই―সেই পুলিশ যে কোন কার্য্য করিয়া থাকে, তাহার দ্বারা ইংরেজের রাজধর্ম্ম যে কিরূপ পালিত হয়, তাহা প্রত্যেক ভারতবাসী মর্ম্মে মর্ম্মে অনুভব করে।[]

 কিন্তু তথাপি ইংরেজ সহসা এ জাতির স্বাধীনতা হরণ করিতে পারে নাই―পারে নাই বলিয়াই তাহার সর্ব্বস্ব লুণ্ঠনমূলক বাণিজ্যও বাধা পাইতেছিল। আমাদের জীবনযাত্রাকে তাহার সেই লুণ্ঠনের অনুকূল করিতে না পারিলে―আমাদের সেই স্বদেশীসমাজের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিতে না পারিলে, তাহার সেই রাজ-প্রয়ােজন যে সিদ্ধ হইবে না, ইহা সে প্রথম হইতেই বুঝিয়াছিল তাই ক্রমে সে আরও দুইটি বস্তুর প্রবর্ত্তনে অধিকতর মনােযােগী হইল―একটি ইংরেজীশিক্ষা, এবং আর একটি তাহার নিজের রাজধর্ম্মসম্মত আইন। ইহার কোনটাতেই কিছু বলিবার ছিল না; একটি পণ্য দ্রব্যের মত,―ক্রেতার পছন্দ হয় কিনিবে, কোন বাধ্যতা নাই, আর একটি ন্যায় ও যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত, দেশীয়গণের ধর্ম্মশাসন বা স্মৃতিসংহিতার সহিত যতদূর সম্ভব সামঞ্জস্য করিয়া সেই আইন প্রস্তুত হইতেছিল; তাহাতেও কাহারও কিছু বলিবার ছিল না। ইংরেজী শিক্ষা সে প্রথমে প্রবর্ত্তন করিতে চাহে নাই, কিন্তু পরে এই জাতির সহিত পরিচয়-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সে পূর্ব্ব আশঙ্কা ত্যাগ করিল―বুঝিতে পারিল যে, উহার ফলে তাহার সর্ব্বপ্রকার ইষ্ট লাভ হইবে, একাধারে গুরু ও প্রভু হইয়া সে পূর্ণভক্তি আদায় করিতে পারিবে। রাজ্যশাসন-নীতি ও আইন-প্রণয়ণ সম্বন্ধে সে প্রথম দিকে যেটুকুও অসতর্ক হইয়াছিল, তাহাও আর রহিল না,―সিপাহী-বিদ্রোহ তাহার চক্ষু এমন খুলিয়া দিল যে, সেই হইতে সে আর ভুল করে নাই; তখন হইতেই সে ভারত-শাসন-নীতিকে এমন পাকা করিয়া লইয়াছে যে, এ পর্য্যন্ত সেই নীতিই তাহাকে সর্ব্বশক্তিমান করিয়া রাখিয়াছে; পরে শাসনব্যবস্থার যতকিছু সংস্কার, যতকিছু নূতন আইন সে প্রবর্ত্তন করিয়াছে, তাহাতে সেই এক নীতিই আজও অবিচলিত আছে।

 ইংরেজীশিক্ষার যতই বিস্তার হইতে লাগিল, ততই একদিকে যেমন আমাদের দাসত্ব করিবার প্রবৃত্তি ও সুযোগ দুই-ই বাড়িতে লাগিল, তেমনি এক নূতন ধরণের বাসনা প্রবল হইয়া উঠিল। ইহার নাম, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা স্বৈরাচারের আকাঙক্ষা। শুনিতে অদ্ভুত বটে, কিন্তু আদৌ অসম্ভব নয়। ইংরেজের দাসত্বও গৌরবজনক―তাহাতে বিবেকের সম্মতি আছে, আত্মার পৌরুষ আছে। কারণ, ইংরেজ সভ্য, এবং ইংরেজ গুরু; সেই ইংরেজীশিক্ষা তাহার বহু কুসংস্কার মোচন করিয়াছে, সে চিন্তার স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে। ইংরেজের চেয়ে সে কত ছোট, এই জ্ঞান তাহার যত বাড়িয়াছে, ততই তাহার উপরে ইংরেজের প্রভুত্ব করিবার দাবী সে অন্তরে অন্তরে স্বীকার করিয়াছে। সেই অধীনতায় অগৌরব নাই, বরং সেই অধীনতারূপ তপস্যার দ্বারা সে সভ্যতার উচ্চতর ধাপে আরোহণ করিবে―উদার ও স্বাধীনচেতা, বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান প্রভুর সেবা করিয়া সে সেই প্রভুর সাযুজ্য লাভ করিবে। সেই স্বাধীনতার আস্বাদ পাইয়া সে আর স্বদেশীয় সমাজশাসন মানিতে চাহিল না, সে-শাসন তাহার অসহ্য হইয়া উঠিল, তাহাই হইল প্রকৃত অধীনতা! অর্থাৎ যে শাসন-বিধি তাহার নিজেরই―তাহার নিজেরই জাতীয় স্বায়ত্ত-শাসন, সেই শাসনের স্বাধীনতা-দুর্গকে এতকাল পরে সে স্বহস্তে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে উদ্যত হইল। ক্রমে সমাজের শাসন লঙ্ঘন করিতে সে আর ভয় পাইল না; পূর্ব্বে যে সকল আচরণের জন্য সে সমাজের দ্বারা দণ্ডিত হইত, ক্রমে সে ভয় আর রহিল না। প্রথমতঃ, সে ন্যায়-অন্যায়ের একটা নূতন মানদণ্ড, ইংরেজীশিক্ষার আশীর্ব্বাদে লাভ করিয়াছে; দ্বিতীয়ত, ইংরেজের আইন তাহার সেই স্বাতন্ত্র্যরক্ষার সহায়, সেই আইনের দ্বারা সে মূর্খ ও অসভ্য সমাজপতিকে তাহার ঔদ্ধত্যের সমুচিত শাস্তি দিতে পারে। অতিশয় বর্ত্তমানে এ দেশে যে অধর্ম্মাচরণ অতিশয় বৃদ্ধি পাইয়াছে ইংরেজের আইন প্রকারান্তরে তাহার প্রশ্রয়দাতা; একমাত্র সমাজই তাহা দমন করিতে পারিত, কিন্তু সমাজের সেই শাসন-শক্তিও যেমন লুপ্ত হইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে জাতির মেরুদণ্ডও ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। ঐ ইংরেজীশিক্ষা ও ইংরেজের চাকুরীই এজাতির ধর্ম্মনাশ করিয়াছে। গ্রাম-সমাজ ত্যাগ করিয়া দলে দলে সে যখন শহরে আসিয়া ইংরেজের আইনের ছায়ায় স্বাধীনতা ভোগ করিতে লাগিল, তখন হইত, সে নিজের বাস্তুও যেমন, তেমনই―বহু রাজা ও রাজ্য ও বহু রাষ্ট্রবিপ্লবে অক্ষত―তাহার সেই সমাজ তাহার সেই স্বাধীনতার একমাত্র দুর্গ স্বহস্তে ভাঙ্গিয়া ফেলিল, জানিতেও পারিল না, নিজের কি সর্ব্বনাশ করিল। হিন্দুর সমাজ গিয়াছে, তাই আজ সে এত অসহায়; মুসলমানের সমাজ এখনও অক্ষত আছে, তাই তাহার সুযোগ এত, ভরসাও এত।

 যতদিন ঐ সমাজ-শাসন ছিল ততদিন কোন রাজশক্তি এ জাতির স্বাধীনতা হরণ করিতে পারে নাই। ইংরেজ যেদিন নন্দকুমারকে ফাঁসি দেয় সেই দিনই বুঝিয়াছিল, তাহার রাজশক্তির সীমা কোথায়। সে ঐ ব্রাহ্মণ সমাজপতিকে ফাঁসি দিবার সময়ে ভাবিয়াছিল, সে বুঝি তাহার রাজমহিমাকে আরও নিঃসংশয়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিল। কই কোন বিদ্রোহ ত’ ঘটিল না। পরে সে বুঝিয়াছিল, বিদ্রোহ ইহারা করিবে না, তাহার কারণ রাজশক্তির সহিত এ জাতির কোন বিবাদ নাই―সেখানে সে যুদ্ধ করিবে না। নন্দকুমারকে যে শক্তি ফাঁসি দিয়াছে, সে শক্তি নন্দকুমারের সমাজপতিত্বকে ফাঁসি দিতে পারে নাই―পারিবে না। ঐ ঘটনায় সমস্ত দেশ নিঃশ্বাস রুদ্ধ করিয়া মূক মৌন স্তম্ভিতভাবে, কেবল সেই রাজশক্তির ব্যভিচার দেখিয়াছিল―তাহার দুর্ভেদ্য সমাজ-দুর্গে কোন আঘাত বা আক্রমণ অনুভব করে নাই; সেখানে সে অসীম শক্তিতে শক্তিমান্; তাই কেবল তাহার দেহে রাজদণ্ডের সেই অশুচি স্পর্শ ধৌত করিবার জন্য সেদিন সে বধ্যভূমির প্রান্তবাহী পতিতপাবনীর জলে অবগাহন করিয়াছিল। ইংরেজ সে দৃশ্য ভোলে নাই; ওই ব্রাহ্মণ ওই সমাজ থাকিতে সে কখনও এদেশের প্রভু হইতে পারিবে না―শত মীরকাসেম, শত টিপুসুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করিলেও ঐ শক্তিকে সে সিংহাসনচ্যুত করিতে পারিবে না―না পারিলে, এ দেশে রাজত্ব করার যে মূল অভিপ্রায় তাহাও সিদ্ধ হইবে না, ইহা সে মর্ম্মে মর্ম্মে বুঝিয়াছিল। অতঃপর সে কোন্ উপায় অবলম্বন করিল, তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি; ইংরেজের মনস্কামনা পূর্ণ হইল, এ জাতির স্বাধীনতার সেই শেষ আশ্রয়টুকুও আর রহিল না, ঊনবিংশ শতাব্দী শেষ না হইতেই এদেশ সত্যই পরাধীন হইল।

 এখানে একটা কথা আবার বলি। আমি এ জাতির পূর্ণ স্বাধীনতার যে স্বরূপ ও অবস্থার কথা বলিয়াছি, তাহা আজিকার আদর্শে কতটুকু বা কোন্ অর্থে সত্য, সে প্রশ্ন নিতান্তই অবান্তর। স্বাধীনতারও ভিন্ন আদর্শ অবশ্যই আছে; প্রতীচ্য আদর্শ, প্রাচ্য আদর্শ, তথা ভারতীয় আদর্শ যে একরূপ হইবে না, ইহাই সত্য। প্রত্যেক জাতিকে তাহার নিজস্ব ঐতিহ্য়, তাহার সাধনা ও অন্তরলব্ধ নিঃশ্রেয়সের মানদণ্ডে বিচার করা কর্ত্তব্য। মানুষের সকল আদর্শই আপেক্ষিক, কোনটাই নিরপেক্ষ সত্য নহে। স্বাধীনতার আসল অভিব্যক্তি অন্তরে, সেই অন্তরের দিক দিয়া উহার স্বরূপ বিচার করিতে হইবে। প্রত্যেক জাতি বা সমাজ, কোন না কোন উপায়ে তাহার সেই স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া থাকে, না পারিলে সেই সমাজ ও জাতি ইতিহাসের পৃষ্ঠা হইতে লুপ্ত হইয়া যায়। ভারতীয় জাতি সকল সেদিন পর্য্যন্ত তাহাদের স্বধর্ম ও সংস্কৃতি, তাহাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করিতে পারিয়াছিল, ইহাতেই প্রমাণ হয়, সে তাহার অন্তরের সেই স্বাধীনতা কখনও হারায় নাই। তাহার আজিকার অবস্থা ও একশত বৎসর পূর্ব্বের অবস্থা তুলনা করিলেই বুঝা যাইবে যে, পূর্ব্বে সে কখনও পরাধীন হয় নাই, সত্যকার যে পরাধীনতা তাহা এইবার ঘটিয়াছে,[] আশাকরি তাহার সহস্র লক্ষণ গণিয়া দেখাইতে হইবে না।

 অবস্থা যখন এইরূপ, যখন প্রকৃত স্বাধীনতা হারাইয়া আমরা সেই দাসত্বকেই ব্যক্তিসুখ-স্বাধীনতা রূপে ভোগ করিবার জন্য বড়ই উৎসুক হইয়াছি, তখনই ইংরেজের দেখাদেখি আমাদেরও একটা জাতি-অভিমান ও রাষ্ট্রিক আত্মমর্য্যাদাজ্ঞান জাগিল, এবং তাহা হইতেই ইণ্ডিয়ান ন্যাশন্যাল কংগ্রেসের জন্ম হইল। এই আন্দোলন যাঁহারা সৃষ্টি করেন তাঁহারা খাঁটি বিলাতীভাবাপন্ন ইংরেজ-শিষ্য। ইঁহাদের প্রায় সকলেই দেশীয় সমাজ ত্যাগ করিয়াছিলেন, অন্ততঃ সেই সমাজের সঙ্গে কোন সম্বন্ধ ছিল না, ইঁহারা ইংরেজ-শাসনকেই নিজেদের সুখ-সুবিধার অনুকূল করিবার জন্য, ইংরেজেরই স্বাধীনতা-ধর্ম্ম ও তাহার স্মৃতি-সংহিতার দোহাই দিয়া―যেন গুরুর সেই সম্পত্তিতে তাঁহাদেরও একটা সহজ অধিকার আছে, এইরূপ মনোভাবের বশবর্ত্তী হইয়া, নানারূপ আবদার অভিমান করিতে লাগিলেন। দেশের জনগণের সঙ্গে ইঁহাদের ত’ কোন সম্পর্কই ছিল না; স্বাধীনতা বস্তুটি কি, কাহাদের জন্য, কিসের স্বাধীনতা এ সকল ভাবনাই ছিল না, বরং সত্যকার স্বাধীনতার কথা ভাবিতেও ইঁহারা ভয় পাইতেন। ইংরেজ শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করিবে, এবং খাইতে দিবে; জনগণের যে দারিদ্র্য তাহা ত’ চির-অভ্যস্ত, এবং একপ্রকার স্বাভাবিক। ইংরেজের নিকটে শিক্ষালাভ করিয়া যাহারা তাহাদের প্রসাদপিপাসু হইয়াছে তাহাদিগকেই তৃপ্ত করিবার জন্য এমন একটু ব্যবস্থা হইলেই হইল, যাহাতে প্রভুদের সেই প্রসাদ-বিতরণে কিঞ্চিত দাক্ষিণ্য থাকে, সঙ্গে সঙ্গে পদাঘাত-প্রাপ্তিও না ঘটে। দাসত্ব যাহাদের পক্ষে বড় সুখকর হইয়াছে, সমাজবন্ধন নাই, রাজ্যশাসনের ভাবনা বা দায়িত্ব ত’ নাই-ই―একটা দেবতুল্য জাতির অভিভাবকতায় যাহারা পরম শান্তিতে বাস করিতেছে - তাহারা সেই অবস্থার পরিবর্ত্তন চাহিবে কেন? তাহাদের নিকটে সত্যকার স্বাধীনতা অতিশয় ভয়াবহ, তাই প্রভুদের নিকটে তাহাদের সেই শিক্ষা ও সভ্যতার মর্য্যাদাই তাহারা প্রার্থনা করিয়াছিল। ইহাই আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামের আদিপর্ব্ব, তাহাতে স্বাধীনতার একটা ভাববিলাস বা অনুকরণমূলক অভিনয়মাত্র ছিল, কোন ক্ষুধাই ছিল না।

 থাকিবে কেমন করিয়া? আজ যে বন্ধন-মুক্তির প্রয়োজন হইয়াছে তাহার জন্য এই জাতির নবজন্মের প্রয়োজন, সেই নবজন্ম না হইলে―স্বাধীনতার অভাব-বোধ বা তীব্র ক্ষুধা জাগিবে কেমন করিয়া? ইংরেজ-শাসক ও ইংরেজী শিক্ষার ফলে তাহার সহস্র বৎসরের সংস্কার মিথ্যা হইয়া গিয়াছে। আজ নূতন করিয়া মুক্তিপিপাসা―মুক্তিকামনা চাই, তবে ত’ এই স্বাধীনতার অর্থ সে বুঝিবে; যে সংস্কার তাহার কখনো ছিল না, সেই সংস্কার তাহার রক্তের ভিতরে, তাহার আধ্যাত্মিক চেতনায় না জাগিলে সে তাহার জন্য ব্যাকুল হইবে কেন? তাই এতদিন স্বাধীনতাকে একটা বাহিরের অবস্থা বা ব্যবস্থা মনে করিয়া সে যে সকল আন্দোলন করিয়া আসিতেছে তাহার কোনটাই স্বাধীনতা-যুদ্ধ নয়, তাহার নীতিও অন্য নীতি, কিন্তু সে কথা পরে।

 ইতিমধ্যে ইংরেজ তাহার শাসন-যন্ত্রটি এমনই সুদৃঢ় করিয়া তুলিয়াছে যে, তাহা এতটুকু শিথিল হইবার কোন আশঙ্কা আর নাই। এতদিন যেটুকু ভয় বা সংশয় তাহার ছিল―হয় ত’ বা একটু উচ্চ ভাব ও ভাবুকতার মোহও ছিল―নিরন্তর লোভ-বহ্নিতে অযাচিত ইন্ধন লাভ করিয়া তাহা নিঃশেষে লোপ পাইল; এবং উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে নানা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে সে যে সকল অভিনব কলা-কৌশলের অধিকারী হইল, তাহাতে তাহার সেই লুণ্ঠনকার্য্য যেমন নিপুণতর তেমনই নির্বিঘ্ন হইয়া উঠিল। ইংরেজ-শাসনের মূলনীতি―ইংরেজের সেই রাজধর্ম্মের স্বরূপ আমাদের দেশের মহা-মনীষীরাও ধরিতে পারেন নাই; রামমোহন হইতে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ পর্য্যন্ত কেহই তাহার চরিত্রে সন্দেহ করেন নাই। অথচ ইংরেজের সেই নীতি ক্রমেই অতি সরল ও সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। রাজ্যশাসন বা প্রজাপালন কখনও তাহার মুখ্য অভিপ্রায় ছিল না,―এ দেশের ধন-হরণই তাহার একমাত্র কাজ, তাহার শাসন-নীতিও সেই এক কার্য্য-সাধনের নীতি। সে প্রথম হইতেই এই জাতির মধ্যে দুইটি ভাগ সৃষ্টি করিল, একভাগে সমগ্র জনসাধারণ, আর এক ভাগে কতকগুলি শিক্ষিত ও অর্দ্ধশিক্ষিত প্রসাদজীবী। নিয়মিত নির্ম্মম শোষণের ফলে একদিকে কদন্ন ও নিরন্নতার বীভৎস অবস্থা, আর একদিকে সেই অবস্থা হইতে অল্পাধিক মুক্ত ও কৃতজ্ঞ একটি দাস-সম্প্রদায়। এই দাস-সম্প্রদায়ের সহিত জনসাধারণের কোন সম্বন্ধ থাকিবে না; সহানুভূতি ত’ পরের কথা, একজাতিবোধের আত্মীয়তাও থাকিবে না। ইহা কেমন করিয়া সম্ভব হইয়াছে তাহা পূর্ব্বে বলিয়াছি; দেশীয় সামাজে উচ্চনীচভেদ থাকিলেও, একটা সামাজিক অন্যোন্য-নির্ভরতা ছিল―সহানুভূতি ছিল, তাহাও আর রহিল না; ইংরেজী-শিক্ষিত চাকুরিয়ার দল দেশকে, সমাজকে পর করিয়া দিল। একদিকে ইংরেজের আইন যেমন সেইরূপ স্বাতন্ত্র্য-বোধের সহায়তা করিল, অপরদিকে তেমনই বড় বড় চাকুরীর প্রলোভন এবং খেতাব-খিলাতের বদান্য বিতরণ তাহাদিগকে ‘প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর’ করিয়া তুলিল। এই যে প্রভুভক্ত চাকুরিয়া-সম্প্রদায় ইহারাও যাহাতে কোনরূপ সামাজিক ঐক্য অনুভব করিতে না পারে, প্রভুর মনোরঞ্জনের জন্য পরস্পরের প্রতিযোগিতা করে, একে অপরের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়,―সে জন্য চাকুরীতেও, বেতন ও পদমর্য্যাদা অনুসারে কৌলীন্যের নানা মেল-বন্ধন অত্যাবশ্যক হইয়াছে। এইরূপে একটা জাতির সংঘ-বুদ্ধি বা সামাজিক চেতনা ক্রমে লোপ পাইয়াছে। পুলিশ ও সৈন্যদলভুক্ত অগণিত ক্রীতদাসকে যে কি উপায়ে জাতি ও সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখা হইয়াছে, তাহাও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়। অতএব একটা জাতির ধর্ম্ম ও মনুষ্যত্ব যদি এমন ভাবে নষ্ট করা সম্ভব হয়,―তাহার নিরক্ষর জনগণ হইতে অপেক্ষাকৃত চতুর ও বুদ্ধিমান ব্যক্তিগুলিকে পৃথক করিয়া, এবং তাহাদের সাহায্যেই অপরগুলিকে শোষণ করিয়া, স্বজাতির ধনভাণ্ডার, লোষ্ট্ররাশির মত, স্বর্ণরাশির দ্বারা পূর্ণ করা যায়, তবে অভিপ্রায়-সিদ্ধির বাকি কি রহিল?

 আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায় যাঁহারা কংগ্রেসনামক জাতীয় মহাসভার পত্তন করিয়াছিলেন, তাঁহারা নিশ্চয়ই স্বাধীনতা চান নাই, ইংরেজের এই শোষণ-নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন নাই―সে জ্ঞানই তাঁহাদের ছিল না। এই শোষণনীতি যখন ধরা পড়িল, তখনও তাহা নিবারণের উপায় কি? ইংরেজের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক রফা বা চুক্তি? কথাটা এইখানেই তুলিলাম, তাহার কারণ, আমরা স্বাধীনতা শব্দটি আজকাল বড় বেশি ব্যবহার করিতেছি, অথচ বেশ বুঝিতে পারা যায়, জনগণ যাহাই বুঝুক―নেতারা শেষ পর্য্যন্ত একটা চুক্তি করতেই চান। সেই চুক্তি বা রফা করিতে হইলে ইংরেজকে তাহার ভারত-শাসন-নীতিই ত্যাগ করিতে হয়, তাহার রাজত্বের কোন প্রয়োজনই থাকে না। রাজত্বের জন্যই সে রাজত্ব চায় না, সে চায় ভারতের ধন-হরণ; তাহা করিতে হইলে ভারতের দারিদ্র্যমোচন ত’ নহেই, সেই দারিদ্রের মাত্রা এমন হওয়া চাই, যাহাতে তাহার বিদ্রোহ করিবার সামর্থ্যই না থাকে। ঐ ভেদনীতি এবং এই দারিদ্র্য, এই দুইটিই ইংরেজের প্রধান অস্ত্র, ইহার একটিও শিথিল করিলে, তাহার রাজত্বই বৃথা হইয়া যাইবে। অতএব কোনরূপ রফা বা আপোস করা তাহার পক্ষে আত্মহত্যারই নামান্তর। এই কথাটি ভাল করিয়া বুঝিয়া না লইলে আমাদের সকল প্রয়াস ও সকল চিন্তাই মিথ্যা হইবে। ইংরেজ কোনরূপ রফা করিবে না, করিতে পারে না―সে হয় তাহার সেই নীতির অনুসরণ করিয়া ভারতবর্ষের অষ্টপৃষ্ঠে নাগপাশবন্ধন দৃঢ় করিয়া রাখিবে, নয় একেবারে এদেশ ছাড়িয়া যাইবে। ছাড়িয়া যাইবে কেন? এবং কখন?[] কোন প্রয়োজন আছে কি? তাহার শক্তি কিছু কমিয়াছে? সেই নীতির প্রয়োগ কি পূর্ব্বাপেক্ষা দুরূহ হইয়াছে? সেই ভেদনীতি কি আরও জয়যুক্ত হয় নাই? জনসাধারণকে সে ভয় করে সত্য―ভয় করে বলিয়াই, সে দুর্ভিক্ষের অবস্থাকে আরও কঠিন ও স্থায়ী করিয়া তুলিয়াছে। সে জানে মানুষকে পশুতে পরিণত করিবার এমন অব্যর্থ উপায় আর নাই, তাই গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা―যাহার নাম হইয়াছে Civil Supply―তাহাকে নিজের বজ্রমুষ্টিতে শক্ত করিয়া ধরিয়াছে―যত চেষ্টা, যত চুক্তি, যত রফা কর―উহাকে এমন করিয়া বাঁধিয়া লইয়াছে যে, ঐ গ্রাসাচ্ছাদনের ভার যদি দেশীয়দের হাতেই তুলিয়া দেয়, তবে দেখা যাইবে, অভাবের গহ্বর এমনই যে, কিছুতেই তাহা পূর্ণ করা যায় না। ঐ জনসাধারণকেই সে ভয় করে, তাহার জন্যই এই ব্যবস্থা; সম্প্রতি সেই ব্যবস্থা আরও পাকা করিয়া লইয়াছে।[] অপর দিকে জনসাধারণের নাম যে করিবে, তাহার পক্ষে কোনরূপ আন্দোলন করিবে, সে-ই তাহার শত্রু, তাহাকেই সর্ব্বাগ্রে দমন করিবে―ইহাও তাহার সনাতন নীতি। আর একটি উপায়, তাহাও চিরদিন তাহার করায়ত্ত থাকিবে―জনসাধারণ হইতে বিচ্ছিন্ন একটি পৃথক দাস-সম্প্রদায় সৃষ্টি করিয়া―চাকরী প্রভৃতির লোভ দেখাইয়া, নানাবিধ উচ্ছিষ্ট বিতরণ করিয়া তাহাদেরই সাহায্যে জনগণকে নানা কৌশলে মুগ্ধ, প্রতারিত ও বঞ্চিত করিয়া রাখা―সেই সম্প্রদায়ের লোভকে সর্ব্বপ্রকারে প্রশ্রয় দিয়া নিজের লোভের অনুকূল করিয়া লওয়া। ইহারও খুব বড় উপায় সে করিয়া লইয়াছে, তবে আর তাহার ভাবনা কি?[]

 এ পর্য্যন্ত আমি ব্যাধি ও তাহার নিদান আলোচনা করিলাম, ইহা হইতে আর কিছু না হোক, একটা বিষয়ের পবিষ্কার ধারণা হইবে, তাহা এই যে, ভারতবর্ষের সমস্যা― ইংরেজ-শাসনের আদি হইতে আজ পর্য্যন্ত―একই; সেই সমস্যা ক্রমশ আরও দারুণ, আরও দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে; ইংরেজের নীতি এতটুকু টলে নাই, তাহার শক্তিও কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই, আমরা যত চীৎকার করিয়াছি, যত উৎপাত উপদ্রব করিয়াছি, এবং মনে করিয়াছি, বুঝি এইবার জয়ী হইতে বিলম্ব নাই―ততই আমাদের সেই আশা সুদূরপরাহত হইয়াছে, আজও আমরা ঠিক এক স্থানেই আছি, যদি কিছু অগ্রসর হইয়া থাকে―সে ইংরেজ, এবার সে তাহার সকল অস্ত্রগুলিকে সমান কার্য্যকরী করিয়া তুলিয়াছে―বঞ্চনা ও প্রতারণায় সে তাহার সকল শক্তি প্রয়োগ করিয়াছে।[] আরও বুঝিতে পারা যাইবে, এ ব্যাধির ঔষধ একটিই আছে ―দ্বিতীয় কিছু নাই। সে ঔষধ কি? কিন্তু এখনও আমার কাহিনী শেষ হয় নাই।

 প্রথম-মহাযুদ্ধের পর যখন ইংরেজের এই নীতি অতিশয় প্রকট, অর্থাৎ নগ্নমূর্ত্তিতে প্রকাশ পাইল, তখন ভারতীয় কংগ্রেস-আন্দোলনকে সম্পূর্ণ ভিন্নপথে চালনা করিয়া মহাত্মা গান্ধী একটা বড় বিস্ময় ও আশ্বাসের সৃষ্টি করছিলেন। সেই আন্দোলনের কোন বিস্তৃত পরিচয়ের প্রয়োজন নাই―এখনও তাহা চোখের সম্মুখেই শেষ অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে। গান্ধীজী প্রথম হইতেই পুরাতন কংগ্রেসের ভুল বুঝিয়াছিলেন, যাহা সত্য নহে, যে আন্দোলনের কোন অর্থই নাই তাহাকে তিনি তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করিলেন; অর্থাৎ তিনি ঐ উচ্চশ্রেণীর শিক্ষিত ভারতবাসীর অভিমান-তৃপ্তির জন্য, ইংরেজ-প্রভুর নিকট হইতে কয়েকটা সুবিধালাভকে প্রকৃত সমস্যা বলিয়া স্বীকার করিলেন না, এবং আর একটি যাহা নিশ্চিত বলিয়া স্থির করিলেন তাহা এই যে, স্বাধীনতা নামক কোনরূপ রাষ্ট্রিক মর্য্যাদালাভ—একটা ভাবগত গৌরবের বস্তুই পরমপুরুষার্থ নয়; দারিদ্র্যনিপীড়িত দুঃস্থ জনগণের যেটুকু দুঃখনিবারণ হয় তাহাই সর্ব্বাগ্রে বাঞ্ছনীয়; এবং যে উপায়ে তাহা ঐ ইংরেজ-শাসন সত্ত্বেও সম্ভব, তাহাই প্রকৃষ্ট উপায়। গান্ধীজী কখনও ভারতের সেই স্বাধীনতা―অর্থাৎ ইংরাজের শাসন-পাশ হইতে আদৌ মুক্তিলাভটাকেই একান্ত প্রয়োজন বলিয়া মনে করেন নাই। ইহা যাহারা বুঝে নাই, তাহারা গান্ধীজীকে ভুল বুঝিবে―ভুল বুঝিয়াছে বলিয়াই এখনও মোহগ্রস্ত হইয়া আছে। গান্ধীজীর এই ধারণার মূলে আছে সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মনোভাব। অর্থাৎ আমাদের তুলনায় ইংরেজ-চরিত্রের শ্রেষ্ঠতায় বিশ্বাস; দ্বিতীয় কারণ, তাঁহার সেই প্রাচীন ভারতীয় সংস্কার,―স্বাধীনতা বলিয়া পৃথক কোন বস্তু নাই; একটা বস্তুই আছে, তাহার নাম মুক্তি, তাহাও ব্যক্তির ব্যক্তিগত সাধনা―তাহা ঠিক রাষ্ট্রিক বা জাতীয় স্বাধীনতা নয়; মানুষ সেখানে স্বতন্ত্র। সামাজিক হিসাবে, লোকহিতব্রত বা দুঃখীর দুঃখমোচনই একমাত্র সত্যকর্ম্ম; জনসেবার দ্বারা যে চিত্তশুদ্ধি হয় তাহাই সেই মুক্তিলাভের সোপান। ইহাই তাঁহার হৃদ্‌গত বিশ্বাস। তিনি এখনও বুদ্ধ ও খ্রীষ্টের যুগে বাস করিতেছেন। যুগধর্ম্মের বশে মনুষ্য সমাজে যে সকল নূতন ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হয়, এবং তাহার জন্য যে নূতন ঔষধের প্রয়োজন―তিনি তাহা স্বীকার করেন না, কারণ, তাঁহার মতে জগতেরও মূল ব্যাধি এক, তাহা আরোগ্য করিতে হইলে সেই এক শাশ্বত সনাতন ঔষধই যথার্থ।

 এই যে মনোভাব ইহার সম্যক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ এখানে সম্ভব নয়, আবশ্যকও নাই। তথাপি এখানে একটি অপেক্ষাকৃত সহজ ও সুবোধ্য কারণ নির্দ্দেশ করা অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। প্রত্যেক মানুষের যেমন জাতিগত, বংশগত ও সমাজগত সংস্কার আছে গান্ধীজীরও তাহা আছে; এবং যেহেতু তিনি অসাধারণ চরিত্র-শক্তিমান পুরুষ, সেই জন্য ঐ সকল সংস্কার তাঁহার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় স্ফুরিত হইয়াছে। একে ভারতীয় সংস্কারের অধ্যাত্মপ্রীতি, তাহার উপরে জৈনধর্ম্মের প্রভাব, এবং তাহারও উপরে, তাঁহার রক্তগত বৈশ্য-বুদ্ধি। ইহার কোনটাই জাগতিক ব্যাপারে উচ্চ উদ্দেশ্য-সিদ্ধির অনুকূল নয়। ভারতীয় অধ্যাত্মসংস্কারে একরূপ বৈরাগ্যই স্বাভাবিক,―জাগতিক যতকিছু অহিত বা অমঙ্গল, তাহা শেষ পর্য্যন্ত এমন কিছু নয়, যাহার জন্য, সেই আত্মার স্বাস্থ্যহানি করা যাইতে পারে। জৈনধর্ম্ম বৌদ্ধধর্ম্মের প্রায় সগোত্র, তাহাতে সর্ব্বপ্রকার হিংসাই পাপ―অহিংসা বা non-resistance-ই ধর্ম্ম; শক্তির বিরুদ্ধে শক্তির প্রয়োেগ অপেক্ষা আত্মদমন বা নিবৃত্তিমূলক প্রতিরোধই কল্যাণকর; আঘাত যদি প্রতিঘাত না পায় তবেই সকল আঘাত আপনিই নিরস্ত হইবে, অমঙ্গলের জড় নষ্ট হইয়া যাইবে। ইহাই কোন এক যুগের ভারতীয় তত্ত্বচিন্তার ফল; এ চিন্তার মূলে আছে সৃষ্টিকে এক রূপ অস্বীকারের দ্বারা নির্ব্বিষ অর্থাৎ নিঃসত্ত্ব করিয়া তোলা। ইহার ফল কি হইতে পারে, ভারতের ইতিহাসও তাহার কতক পরিমাণ সাক্ষ্য দিবে; এবং জাগতিক ব্যাপারে ইহাকে সম্ভব করিয়া তোলা সম্ভব কিনা, মানুষের ইতিহাস এবং মানুষের সহজ বুদ্ধি তাহা বলিয়া দিবে। ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, ঐ তত্ত্বই ভারতীয় মনীষা বা সাধনার একমাত্র তত্ব নয়, উহা একটা আংশিক তত্ত্ব মাত্র, বরং প্রধান চিন্তাধারার বিরোধী; যদিও গীতা হইতে শঙ্কর-দর্শন পর্য্যন্ত, তথা ভারতীয় হিন্দুসাধারণের ধর্ম্মীয় চেতনায়, বৌদ্ধদর্শনের প্রভাব আজিও প্রচ্ছন্ন,―এমন কি, কোন কোন সমাজে প্রবল হইয়া আছে। গান্ধীজীর চিত্তে এই তত্ত্বই আর সকল তত্ত্বকে পরাভূত করিয়া বিরাজ করিতেছে। তারপর, তাঁহার রক্তগত বৈশ্য-বুদ্ধি, অর্থাৎ বণিক-মনােবৃত্তি। এই মনােবৃত্তির বশে তিনি আদান-প্রদান বা লেন-দেন, ও আপােষকেই, সর্ব্ববিধ উপার্জ্জনের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ নীতি বলিয়া বিশ্বাস করেন। বণিককে সর্ব্বদাই দুইপক্ষের কথা ভাবিতে হয়, এবং অপর পক্ষের তুষ্টিসাধনের জন্য, সকল সময়েই রফা করিতে হয়। ইংরেজীতে যাহাকে বলে ‘make-up’―গান্ধীজীর ব্যক্তিমানসের, তথা চরিত্রের সেই ‘make-up’ ইহাই; তাহা অতিমানবীয় বলিয়া বিস্ময়-বিমূঢ় হইবার কোন কারণ নাই। তাঁহার ব্যক্তিত্বের যাহা কিছু অসাধারণত্ব তাহা আর কিছু নয়, সকল শক্তিমান পুরুষেরই যাহা, তাহাই,―অদম্য আত্মবিশ্বাস; এবং সেই বিশ্বাসের বস্তুকে আর সকলের উপরে আরােপণ করিবার ‘zeal’ বা একাগ্র বাসনা। এইরূপ মানুষ পৃথিবীতে বিরল নয়, এমন কি ইহাদের অপেক্ষাও শক্তিমান পুরুষ দুর্লভ নহে; কিন্তু ইতিহাস বা কালের কতকগুলি লগ্ন আছে, সেই লগ্ন যদি এইরূপ জীবনের সহিত যুক্ত হয় তবেই গান্ধীজীর মত পুরুষের অভ্যুত্থান ঘটে; লগ্ন যদি অনুকুল না হয় তবে তাহা অপেক্ষাও মহত্তর ব্যক্তি ইতিহাসের অগােচর থাকিয়া যায়।

 কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। গান্ধীজার সাধনতত্ত্বের মূলে আছে ভক্তি ও বৈরাগ্য; ভক্তি অর্থে―একটা বিরাট শক্তি, যে শক্তি দুর্জ্ঞেয় হইলেও মঙ্গলময়―সেই শক্তির নিকটে আত্মসমর্পণ (ইংরেজও সেই শক্তির অংশ); এবং বৈরাগ্য অর্থে―গীতার সেই “মা ফলেষু কদাচন”। তিনি নিজে সেই শক্তির সেবকমাত্র, তাহার সহিত সমকক্ষতা-লাভের স্পর্দ্ধা তাঁহার নাই, তাই তাঁহার যুদ্ধও অন্তর্মুখী, বহির্মুখী নয়। যে শক্তি বহির্জগতের সকল ব্যাপারে মানুষকে যুদ্ধে আহ্বান করিতেছে, এবং সেই যুদ্ধশক্তির পরীক্ষা দ্বারাই তাহার আত্মারও উদ্বােধন করিতেছে,―সৃষ্টির সেই নিয়মকে গান্ধীজী মানেন না; সেই আধিভৌতিককেই তিনি আধ্যাত্মিকের সম্মান দিতে রাজী নহেন। তিনি শক্তিপন্থী নহেন, ভক্তিপন্থী, তিনি যাহাকে শক্তি বলেন, তাহা নিজের মধ্যে নিজেকে শাসনে রাখিবার শক্তি―বাহিরের রাজ্য শত্রুকে ছাড়িয়া দিয়া অন্তরে স্বর্গরাজ্য স্থাপনের শক্তি; ইহা সেই—‘Render unto Cæser what is Cæser's due” ভারতবর্ষের মানুষ যে পরাধীন, সেটা একটা বড় সমস্যা বা দুর্ঘটনা নয়, তাহার বিপরীত যাহা, গান্ধী-ধর্ম্মে―সেই স্বাধীনতার কোন পারমার্থিক মূল্য নাই, কারণ সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করিবার জন্য বহু জাগতিক ও প্রাকৃতিক নিয়মের অধীনতা স্বীকার করিতে হয়। তবে, মনুষ্যজীবনের নিঃশ্রেয়স কি? পরহিতব্রতের দ্বারা―জনসেবার দ্বারা―নিজ নিজ আত্মার উন্নতি সাধন; তাহাতেই প্রত্যেকের যথাকালে মুক্তিলাভ হইবে, সে মুক্তিলাভ এখনই না হয়, না হইবে, কিন্তু ঐ পরহিতব্রত―দুঃখীর দুঃখ-মোচন―অহিংসা ও সত্যাগ্রহের দ্বারা যতটুকু সাধ্য―তাহাই এখন করিতে হইবে।

 এই ধর্ম্ম ও নীতি গান্ধীজী কখনও ত্যাগ করেন নাই। তিনি ইংরেজের রাজশক্তির সঙ্গে যে বিরোধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন―ইংরেজ-শাসন হইতে মুক্তিলাভই তাহার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না; ইংরেজ রাজাই থাকুক, তাহাতে তাঁহার আপত্তি নাই, সে কেবল ভারতের দরিদ্র দুঃস্থ জনসাধারণের জন্য অন্নবস্ত্রের সচ্ছলতা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের কিঞ্চিৎ সুব্যবস্থা করিয়া দিক, ইহার অধিক তিনি দাবী করেন নাই। আদি-কংগ্রেস যে স্বাধীনতার ভাব-বিলাস করিত, এবং পরে এই বাংলাদেশে ও মহারাষ্ট্রে স্বাধীনতার যে আদর্শ ও আবেগ কিছুকালের জন্য প্রকাশ পাইয়াছিল, তিনি প্রথম হইতেই তাহার বিরুদ্ধে দাঁড়াইলেন। রাষ্ট্রীয় অর্থে ঐ স্বাধীনতালাভ চিরদিন তাঁহার চিন্তায় গৌণ―ইংরেজের নিকট হইতে ঐ কয়েকটি অধিকার আদায় করিয়া লওয়াই ছিল তাঁহার একমাত্র লক্ষ্য। তাহার জন্য ইংরেজকে তাড়াইতে হইবে না, সে আপনিই তাহা দিবে; তাহার ভিতরে যে মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্ব আছে তাহাকে জাগাইতে পারিলেই হইল, এবং তাহা জাগিবেই। ইহার জন্য ভারতবাসীকে তপস্যা করিতে হইবে―ইংরেজের চরম অত্যাচার ও পাশবিক নিষ্ঠুরতাকেও হাসিমুখে সহ্য ও ক্ষমা করিতে হইবে―যেন এতটুকু হিংসার উদ্রেক না হয়; ধর্ণা ও প্রায়োপবেশন ত আছেই। এই একটি উপায় ছাড়া অন্য উপায় নাই। যদি ইহা কঠিন বা দুঃসাধ্য হয়, তবে বুঝিতে হইবে তোমরাই এখনও উপযুক্ত হও নাই; ইংরেজের দোষ নয়, দোষ তোমাদেরই। তবু সকলেই স্বাধীনতার নামে পাগল। গান্ধীজী যেন মৃদুহাস্যে বলেন, আচ্ছা তাহাই হইবে, কিন্তু আগে ঐ কাজটি কর দেখি? অবোধ বালককে এমনই করিয়া ভুলাইতে হয়, নহিলে তাহাদের মঙ্গলসাধন করা যে অসম্ভব! ইহার পর, তিনি ইংরেজ ও মুসলিম লীগের সঙ্গে যে প্রেমের বা অহিংসার যুদ্ধ করিয়াছেন তাহাতে পদে পদে কী ফললাভ হইয়াছে তাহা আমরা দেখিয়াছি। গান্ধীজী ক্রমে তাঁহার দাবি বাড়াইয়াছেন বটে, এমন কি শেষ পর্য্যন্ত একটা পাকে পড়িয়া ইংরেজকে ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ বলিয়া ধমকও দিয়াছেন, তবু তিনি যে সত্যই তাহার সবটুকু আশা করেন নাই, আমার এই আলোচনা এবং গান্ধীজীর সদ্যতম আচরণ হইত, তাহা বুঝিতে কাহারও বিলম্ব হইবে না।

 গান্ধীজীর ধর্ম্মতত্ত্ব ও অধ্যাত্মবাদের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, গান্ধীজীর ত’ কথাই নাই ব্যক্তিমাত্রেরই ব্যক্তিগত বিশ্বাসে অধিকার আছে―ভারতবর্ষে সেই অধিকার আরও অব্যাহত। ব্যক্তির আত্ম-মানসে মিথ্যাও সত্য হইতে পারে―যদি বিশ্বাসের জোর থাকে, তবে জগতের দিকে চক্ষু বুজিয়া, একটা নিজস্ব ভিন্ন জগৎ মনে মনে সৃষ্টি করিয়া, আত্ম-সাধনায় সিদ্ধিলাভ করা আদৌ অসম্ভব নয়, আলনস্করেব মনোরাজ্যও সত্য―যদি সেই দিবাস্বপ্ন ভাঙ্গিয়া দিবার মত কোন শক্তি বাহিরে না থাকে। কিন্তু ইংরেজ-শাসন ও তাহার সেই ক্রূর-কঠিন নীতি একটা বড় সত্য, তাহার সহিত রফা যে চলে না! গান্ধীজী এ পর্য্যন্ত যে সকল উপায় অবলম্বন করিয়াছেন তাহার প্রত্যেকটি ইংরেজের ঐ নীতির দ্বারা খণ্ডিত হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও হইতে বাধ্য,[] ইহা যাহারা বুঝিবে না, তাহাদের প্রত্যেককে মহাত্মা গান্ধী হইতে হইবে, অন্যথা অন্ধ অথবা ভণ্ড না হইয়া উপায় নাই। আসল কথা, ভারতের তথাকথিত স্বাধীনতার জন্য গান্ধীজী খুব বেশী চিন্তিত নহেন; ইংরেজকে বিশ্বাস করিতেই হইবে, বিশ্বাস করতে পারিলেই ঐ অহিংসা ও সত্যাগ্রহের বলে অনেক পথ খুলিয়া যাইবে; সে পধ সংগ্রামের পথ নয়, মৈত্রীর পথ; তাহাতে স্বাধীনতা লাভ না হউক, যাহা প্রকৃত কল্যাণ তাহাই লাভ হইবে। এই যে দুঃস্থ ও দুর্গতগণের দুঃখমোচন―ইহার তুল্য ধর্ম্ম নাই; কেবল স্বাধীনতা-লাভ বলিতে লোক যাহা চায় তাহাও একটা পাপ-প্রবৃত্তি, প্রকৃত স্বাধীনতা ঐ হিতসাধনের স্বাধীনতা―ইংরেজ এ দেশে থাকা সত্ত্বেও সেই স্বাধীনতার যথেষ্ট অবকাশ আছে। তাহার সাধনপ্রণালী বা কর্ম্মপদ্ধতিও তিনি নির্দ্ধারণ করিয়া দিয়াছেন। উহা পালন করতে পারলেই চতুর্ব্বর্গ লাভ হইবে। ঐ ধর্ম্ম এমনই যে, উহাতে নিষ্ফলতার আশঙ্কাও নাই, কারণ― “নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে। স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।” আমার মনে হয়, ইহাই গান্ধী-ধর্ম্মের ও গান্ধী-কর্ম্মের সারতত্ত্ব―ইহা বুঝিয়া লইতে পারিলে গান্ধী-কংগ্রেসের কোথাও প্রত্যবায় দেখা যাইবে না। ভুল আমরাই করিয়াছি, আমরা সেই বিলাতী আদর্শের স্বাধীনতাকেই পরমপুরুষার্থ বলিয়া স্থির করিয়াছি, অথচ তাহার জন্য গান্ধী-নীতিকেই বরণ করিয়াছি—না করিয়া উপায় নাই; এজন্য, আমাদেরও যেমন, গান্ধীজীরও তেমনই বিড়ম্বনার অন্ত নাই।

 গান্ধী-মন্ত্র ও সেই মন্ত্রে দীক্ষিত কংগ্রেসী ভারতের কথা বলিয়াছি, এইবার উহার প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত যে আর এক তন্ত্র তাহার কথা বলিব। এই তন্ত্র গান্ধী-ভারতের নহে, ইহা বাংলাদেশের―বাঙালীর; পন্থাও স্বতন্ত্র। ইংরেজ-আগমনের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এই দেশে, একটা বিশিষ্ট জাতির ধ্যানে ও জ্ঞানে ভারতীয় সংস্কৃতি এক নূতন রূপ পরিগ্রহ করিতে আরম্ভ করিল, এই বাংলাদেশেই ভারতের সেই সমগ্র অতীতের সহিত বর্ত্তমানের একটা বােঝাপড়া অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিল। এইখানেই সেই অতীতের দুয়ার সবলে ভাঙ্গিয়া অত্যুগ্র বর্ত্তমান প্রথম প্রবেশ করিয়াছিল,―সে আসিয়াছিল ঐ বণিকদস্যুর ছদ্মবেশে, তখনও,পুর্ব্বসীমান্তের এই নিভৃত পল্লী-প্রদেশ―কবির ভাষায়

“শান্তমুখে বিছাইয়া আপনার কোমল নির্ম্মল শ্যামল উত্তরী
তন্দ্রাতুর সন্ধ্যাকালে শত পল্লীসন্তানের দল ছিল বক্ষে করি।”

 এই ইংজেদের মত মানুষ ভারতবর্ষে পূর্ব্বে কেহ দেখে নাই, বাঙালীও তাহার আকারে-প্রকারে ও ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া গেল, এবং তৎক্ষণাৎ তাহাকে “গঙ্গোদকে অভিষিক্ত করিয়া” নিজ গৃহে চুপে চুপে বরণ করিয়া লইল। সেই অতিথি যখন তাহার অজ্ঞাতসারে সর্ব্বস্ব-হরণ আরম্ভ করিয়াছে, তখন এই দারিদ্র্যব্রতী ভাবস্বপ্নাতুর তত্ত্বপিপাসু জাতি তাহারই মুখে এক নূতন জগতের অফুরন্ত রূপকথা শুনিয়া ভক্তিবিস্ময়ে বিহ্বল হইতেছিল। সেই রূপকথার মধ্যে সে এক নৃতন রাজপুরী ও রাজকন্যার সন্ধান পাইল,―জীবন ও মৃত্যু, প্রেম ও পৌরুষের, ক্রন্দন ও উৎসবের ―এক নূতন রস ও নূতন তত্ত্ব সে হৃদয়-গােচর করিল; ইংরেজের দ্বারা বাঙালী যেমন মুগ্ধ হইয়াছিল এমন আর কোন ভারতীয় জাতি হয় নাই। তাহার সেই ছলনা সে কেমন করিয়া বুঝিবে? ইংরেজ-জাতির চরিত্রে যে পরস্পরবিরােধী দুইটা দিক আছে, যাহার জন্য সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বণিক ও শ্রেষ্ঠ কবি, এবং যে কারণে সে চিরদিন “Perfidious Albion” নামে পরিচিত হইয়াও সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ কয়ািছে― তাহার সেই অপার ছলনা এই সুরল ভাবপ্রবণ জাতি বুঝিবে কেমন করিয়া? তাহার চরিত্রের একটা দিকই সে সেই প্রথম-পরিচয়ের যুগে কিছু বেশি করিয়াই দেখিয়াছিল, তাহার কারণও ছিল; য়ুরোপে তখন একটা নূতন হাওয়া বহিতেছিল, সেই হাওয়া ইংরেজের গায়েও লাগিয়াছিল। তথাপি ইংরেজ-চরিত্রের সেই রহস্যভেদ করিতে অনেক দিন লাগিয়াছিল, এবং ভেদ করতে পারিলেও সেই ভক্তি তাহার অন্তর হইতে কিছুতেই সে দূর করিতে পারে নাই, ইংরেজ তাহার আত্মার উপরে চাপিয়া বসিয়াছিল। ইহার প্রমাণ―ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষেও রবীন্দ্রনাথের মত কবি-মনীষী বলিতেছেন―

 “ইংরেজের যাহা কিছু শ্রেষ্ঠ, ইংরেজ তাহা যে সম্পূর্ণভাবে ভারতবর্ষে প্রকাশ করিতে পারিতেছে না, সে জন্যও আমরা দায়ী আছি। আমাদের দৈন্য ঘুচিলে তবে তাহাদের কৃপণতাও ঘুচিবে” [ইহাকেই আমি ঊনবিংশ শতাব্দীর মনোভাব বলিয়াছি―মহাত্মা গান্ধীর এই মনোভাব এখনও পুরামাত্রায় আছে।]

 “ভারতবর্ষ অত্যন্ত অধিক পরিমাণে ইংরেজের লাভকে, ঔদ্ধত্যকে, ইংরেজের কাপুরুষতা ও নিষ্ঠুরতাকেই উদ্বোধিত করিয়া তুলিতেছে, একথা যদি সত্য হয়, তবে সেজন্য ইংরেজকে দোষ দিলে চলিবে না, এ অপরাধের প্রধান অংশ আমাদিগকে গ্রহণ করিতে হইবে।”

 “নিজের দেশকে যখন আমরা নিজের চেষ্টা নিজের ত্যাগের দ্বারা নিজের করিয়া লইব,―তখন ভারতবর্ষে আমরা ইংরেজদের সহযোগী হইব, তখন ইংরেজকে আমাদের সঙ্গে আপোষ করিয়া চলিতে হইবে।” [স্বাধীনতা-লাভের কোন চিন্তাই ইহাতে নাই।]

 এইরূপ মনোভাবের একটা কারণ, ইংরেজের দেশে যাহারা ইংরেজকে দেখিয়াছে, তাহারা, ভারতবর্ষে যাহাদিগকে দেখে তাহাদিগকে সেই জাতি বলিয়াই মনে করে, না করিয়া পারে না; সেই জাতি নিজ দেশে এমন ধর্ম্মনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, ও চরিত্রবান হইয়া, ভারতবর্ষে আসিয়া এমন মূর্ত্তি ধারণ করে কেন—ইহা বুঝিয়াও কেহ বুঝিতে চাহেন নাই, অথচ ঐ রবীন্দ্রনাথই একথাও বলিয়াছেন যে―

 “যে সকল জাতি মনুষ্যে মনুষ্যে ব্যবহারে সত্যের মর্য্যাদা রাখে, ন্যায়াচরণকে শ্রেয়োজ্ঞান করে•••রাষ্ট্রতন্ত্রে তাহাদেরও ধর্ম্মবোধ অসাড় হইয়া পড়ে।”

 আশ্চর্য্য নয় কি? এত জানিয়া, এত বুঝিয়াও ইংরেজভক্তির মোহ কিছুতেই ঘোচে না। ইহার পর, “ছোট ও বড়” নামক একটি অতিশয় উপাদেয় প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ-চরিত্রকে, দেশকালভেদে, দুই ভাগে ভাগ করিয়া কতকটা নিশ্চিন্ত হইতে পারিয়াছিলেন। আসল কথা, ইংরেজের স্বজাতি-প্রেম ও স্বধর্ম্মনিষ্ঠাই যেমন তাহার মহত্ত্বের হেতু, তেমনই, ভারত-অধিকার ও লুণ্ঠন-বৃত্তির হেতুও যে তাহাই,―এবং একটি যেমন গভীর, অপরটিও তেমনি দুর্দ্দমনীয় ও অপরিহার্য্য, ইহা আমরা বুঝিয়াও বুঝতে পারি না। আরও কারণ, পূর্ব্বে বলিয়াছি—ঐ ইংরেজের মাবফতেই বাঙালা এক নূতন দৃষ্টির অধিকারী হইয়াছিল, ইংরেজ-চরিত্রের সেই অপর দিকটি হইতে সে তাহার বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টি কিছুতেই ফিরাইতে পারে নাই। ডেভিড হেয়ারের মত ইংরেজকে সে ভুলিতে পাবে না, Edwin Arnold-এর Light of Asia পড়িবার সময়ে সে তাহাকে তাহার আত্মার দোসর বলিয়া মনে করে। তাই বলিতেছিলাম, ইংরেজের মধ্যে যেটুকু মনুষ্যত্ব, এমন কি দেবত্ব ছিল, বাঙালীর মত আর কেহ তাহার পূজা করে নাই।

 এই পূজা করিয়াছিল বলিয়াই, ইংরেজ যাহাকে তাহার বাণিজ্যের বিনিময়-পণ্য করিয়াছিল, বাঙালী তাহাকেই পরমার্থের পাথেয়রূপে বরণ করিল। অবশেষে, ইংরেজ-গুরুর নিকটেই সে যে মন্ত্রদীক্ষা পাইয়াছিল―ইংরেজের ইতিহাস ও ইংরেজী সাহিত্যের সেই জ্ঞানাঞ্জন-শলাকায় তাহার চক্ষু ক্রমে উন্মীলিত হইতে লাগিল, তখন সেই ছলনাও সে বুঝিল। ইংরেজের সেই জাতিপ্রেম-মন্ত্রকে সে আপন ধর্ম্মে শোধন করিয়া, ইংরেজের বজ্রমুষ্টি হইতে গ্রীবা মুক্ত করিবার উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। ততদিনে ইংরেজ তাহার পল্লীজীবনে হানা দিয়া শুধুই শাকান্ন হরণ করে নাই, সে তাহার সেই শেষ আশ্রয় সমাজটাকেও ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। তখন বড় ভয়, বড় বেদনা জাগিল, গুরু ইংরেজের নিকটেই সে যাহা শিখিয়াছিল তাহাকেই দীপ-বর্ত্তি করিয়া সে এইবার আপন দেশের, আপন জাতির ইতিহাস উল্টাইতে লাগিল—অতীতের সেই ভগ্নপ্রাসাদ ও জীর্ণ-কুটীরে যাহা-কিছু কুড়াইয়া পাইল, তাহাই সেই নূতন আলোকে নূতন করিয়া পাঠ করিল। বেদান্ত ও উপনিষৎ, বুদ্ধ ও কৃষ্ণ, ব্যাস ও শঙ্কর―তাহার মনে এক নূতন ভাষায় কথা কহিতে লাগিল, সেই সনাতনতত্ত্বই যুগের ছন্দে নূতন বাণী রচনা করিল। সে আবাব ভাগীরথীতীরে পিতৃতর্পণ করিতে বসিল। তাহার আসন নির্দ্দেশ করিলেন বঙ্কিম, তিনি নবযুগের মধ্যে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারতবর্ষকে স্থাপনা করিয়া এক নূতন তত্ত্বের ইঙ্গিত করিলেন―তাহা জৈন নয়, বৌদ্ধ নয়, বেদান্ত নয়, বৈষ্ণবও নয়, সে এক নূতন শক্তিমন্ত্র, তাহার দেবতা―মানুষ, এবং ধর্ম্ম―পৌরুষ। ইহার পর, ভারতের আত্মাই যেন শরীরী হইয়া ঐ ভাগীরথীতীরেই অবতরণ করিল, এবং এক মহাবীর্য্যবান আধার সংগ্রহ করিয়া তাহার কর্ণে সেই মন্ত্র দিল, যাহাতে সর্ব্বভয় নিবারণ হয়,―সেই মন্ত্র সর্ব্ববন্ধন-মোচনের মন্ত্র, অথচ বৈরাগ্যের ত্যাগমন্ত্র বা শূন্যবাদ নয়; তাহা স্বাধীন আত্মার স্বাধিকার ঘোষণার মন্ত্র। জাতির আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য পাশ্চাত্যের নিকট হইতে বঙ্কিমচন্দ্র যজ্ঞের যে সমিধ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, এবং ভারতীয় ভাবে শোধন করিয়া তাহাতে যে অগ্ন্যাধান করিয়াছিলেন, সেই অগ্নিতেই স্বামী বিবেকানন্দ নব পুরুষ-যজ্ঞের মন্ত্র উচ্চারণপূর্ব্বক আহুতি প্রদান করিলেন। ভারতের সেই প্রাচীন মুক্তি-সাধনাকেই, তিনি ঋষির অরণ্য, যোগীর গুহা, ভক্তের আশ্রম হইতে উদ্ধার করিয়া, জাতি ও সমাজের জীবন-সমস্যার সহিত যুক্ত করিয়া দিলেন। আহুতিশেষে সেই যজ্ঞাগ্নি হইতে যে পুরুষেব আবির্ভাব হইল, সেই বাণীই যে-মূর্ত্তি ধারণ করিল, তাহার লৌকিক নাম―নেতাজী সুভাষচন্দ্র। তখনও যজ্ঞশালার ___ সেই মন্ত্র কেহ কর্ণগোচর করে নাই, সেই পুরুষও কাহারও দৃষ্টিগোচর হয় নাই―অদূর ভবিষ্যৎ তখন বর্ত্তমান হইয়া উঠে নাই।

 সর্ব্বব্যাধি―সর্ব্বদুঃখ-মোচনের একমন্ত্র যে ঐ স্বাধীনতা, আর কিছুদ্বারা যে তাহা সম্ভব নয়― ঐ এক বস্তু লাভ করিতে পারিলে আর সকলই লাভ হইবে, না পারিলে কিছুই হইবে না―ইহা ভারতবর্ষে আর কেহ এমন করিয়া অনুভব করে নাই, এই মন্ত্রের আদি-ঋষি বা স্রষ্টা যে বাঙালী, গত পঞ্চাশ বৎসরের বাংলার, তথা ভারতের ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য দিবে। ইহার কারণ কি? কারণ পূর্ব্বে বলিয়াছি; ইংরেজ-সংসর্গের বিষ ও অমৃত দুই-ই সে যে পরিমাণে পান করিয়াছে, এমন আর কেহ করে নাই। শেষে অমৃতের পরিবর্ত্তে বিষই তাহার আত্মাকে জর্জ্জরিত করিল ―না করিলে, দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটীমূলে সেই আত্মার এমন প্রকাশ দেখা যাইত না। কিন্তু আরও কারণ আছে; স্বাধীনতাকে বাঙালী যে-রূপে ও যে-উপায়ে চিরদিন ভোগ করিয়াছে —সে যেন নিঃশ্বাস-বায়ুর মত। এজন্য সে যেমন সে বিষয়ে সচেতন ছিল না, তেমনই তাহার অভাবে, অন্তরের অন্তরে শ্বাস-কষ্ট অনুভব করিয়াছে। সে স্বাধীনতা কেমন? স্বাধীন রাজ্য-স্থাপনের স্বাধীনতা নয়, ধ্বজা তুলিয়া সমারোহ সহকারে স্বাধীনতা ভোগ করাও নয়; পাখী যেমন আকাশে, মাছ যেমন জলে বিচরণ করে, বাঙালীও নেই, রাজা ও রাজধানী হইতে দূরে নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র জলাশয় বা বায়ুমণ্ডল সৃষ্টি করিয়া লইয়াছিল, জীবনযাত্রার উপকরণবাহুল্য বর্জ্জন করিয়া, সুখ-সম্পদর উচ্চাভিলাষ দমন করিয়া, সে যে-স্বাধীনতা ভোগের আয়োজন করিয়া লইয়াছিল, তাহা তাহার প্রকৃতি ও প্রতিভার পক্ষেই সম্ভব। বাঙালীর ইতিহাস এ পর্য্যন্ত রচিত হয় নাই, যাহা হইযাছে তাহা বাংলাদেশের ইতিহাস―বাঙালীজাতির ইতিহাস নয়। বাঙালীর সেই জাতিগত বৈশিষ্ট্য না বুঝিলে, বাঙালীর সাধনা ও সংস্কৃতির সহিত মিলাইয়া না লইলে, সেই প্রকৃত ইতিহাস অজ্ঞাত থাকিয়াই যাবে। আমি ঐ যে স্বাধীনতার কথা বলিয়াছি―বাঙালীর ইতিহাস সেই স্বাধীনতা, সেই বৈশিষ্ট্য-রক্ষার ইতিহাস। সেই স্বাধীনতা সন্ন্যাসীর স্বাধীনতাও নয়, আবার রাজভোগের স্বাধীনতাও নয়। বাঙালী রাজাও নয়, ফকিরও নয়; তাহার সাধনায় মধ্যযুগের সেই ভজন-সাধনও যেমন নাই, তেমনই বৌদ্ধবেদান্তের শূন্যমার্গও নাই, সেখানে সে তান্ত্রিক, অর্থাৎ, তত্ত্ব ও তথ্য উভয়ের সমান উপাসক। বাঙালী কখনও রাজ্যেশ্বর হইতে চাহে নাই (বাঙালী জাতি হইতে কোন বৃহৎ রাজবংশের উদ্ভব নয় নাই), সে বাণিজ্যের দ্বারা জাতির ধনবৃদ্ধিও করে নাই। তথাপি সে ত্যাগী সন্ন্যাসী নয়, সে ভোগের মধ্যেই বন্ধন-মুক্তির স্বাধীনতা চাহিয়াছে। সেজন্য জীবনকে অতিশয় সহজ ও সরল করিয়া সে সেই শক্তির সাধনা করিয়াছে―যে-শক্তি সহজে ও সরলে আনন্দরূপিণী। তাহার সেই স্বাধীনতা দম্ভ বা অভিমানের বস্তু ছিল না, সেই স্বাধীনতা লোভই সে দারিদ্র্যকে জয় করিয়াছিল, ধনের প্রভুত্ব স্বীকার করে নাই তাহাব ভূমি তাহাকে যে শস্য দেয় তাহার অধিক সে চাহে নাই―কেবল তাহাই সে স্বাধীন ভাবে ভোগ করিয়াছে। এই বাঙালীর সহিত ইংরেজের ঘনিষ্ঠতাও যেমন সহজ হইয়া ছিল, সংঘর্ষও তেমন দারুণ হইতে বাধ্য। সে তাহাকে ভুলাইয়া তাহার ধর্ম্মনাশ করিয়াছে, তাহার সেই হাজার বৎসরের স্বল্পে-সন্তুষ্ট শান্তিময় জীবনযাত্রা উৎসাদিত করিয়াছে ―এমন আঘাত ভারতবর্ষে আর কোথাও সে করে নাই। বাঙালীর রাজ্য-পিপাসা ছিল না,[] ধন পিপাসাও তাহার স্বাস্থ্য নয়, ব্যাধি,―সে ব্যাধিও ইংরেজের সৃষ্টি; তাই আর সকলের সহিত তাহার রফা চলিতে পারে, বাঙালীর সঙ্গে কোন রফা চলিবে না। সে যাহা হারাইয়াছে ভারতের আর কেহ তাহা হারায় নাই; আর সকলে ধন হারাইয়াছে, বাণিজ্যের মুনাফা হারাইয়াছে, রাজসম্মান বা প্রভুত্বের গৌরব হারাইয়াছে; বাঙালী হারাইছে―তাহার শান্তিময় অনাড়ম্বর জীবনের সেই উগ্রতাহীন মাদকতাহীন স্বাধীনতা―তাহার সেই নিঃশ্বাস-বায়ু। ইংরেজও তাহা বুঝিয়াছে—এ জাতিকে সে বিশেষরূপেই জানে, তাই ইহার জন্য তাহাকে একটা বিশেষ ব্যবস্থাও করিতে হইয়াছে। কংগ্রেসী-ভারতও বাঙালীর এই ধর্ম্মকে বিধর্ম্ম বলিয়াই মনে করে, তাই সে তাহাকে বশ করিতে না পারিয়া অবশেষে বর্জ্জন করিয়াছে।

 এই হৃত-স্বাধীনতার বেদনা তাহার মগ্ন-চৈতন্যের মধ্যে গুমরিয়া উঠিয়াছিল বলিয়াই, বাঙালী ভারতে এক নবধর্ম্মের প্রচারক হইয়াছিল; সেই বেদনা বঙ্কিম-বিবেকানন্দের সাধনায় যে মানসী-মূর্ত্তিতে প্রকাশ পাইয়াছিল, তাহাই নেতাজী সুভাষচন্দ্রে বাস্তব রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র কেবল যুদ্ধ-নায়ক নেতা নহেন, ইংরেজের সহিত যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে জয়লাভই তাঁহাব সাধনার শেষ ফল নহে; তিনি কেবল শত্রুঞ্জয় নহেন, তিনি আরও অনেক বড়—তিনি নিজে মৃত্যুঞ্জয় হইয়া এই জাতির মৃত্যুভয়হারী; যে-বীর্য্যবলে, বিনতানন্দন গরুড়ের মত, স্বর্গ হইতে স্বাধীনতার অমৃত-সোম হরণ করা যায়―তিনি সেই বীর্য্যের অবতার, সেই বীর্য্য ও সেই অমৃত-পিপাসা তিনি আপনার বক্ষ হইতে সমগ্র জাতির বক্ষে সঞ্চারিত করিয়াছেন। তিনি বিবেকানন্দেরই উত্তরসাধক। ইংরেজ সেই স্বাধীনতার সাক্ষাৎ বাধা বটে, এবং সর্ব্বাগ্রে সেই বাধা অপসারিত করিতেই তিনি তাঁহার সর্ব্বশক্তি নিয়োজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই যুদ্ধজয়কেই যদি আমরা তাঁহার প্রধান বা চূড়ান্ত কীর্ত্তি বলিয়া মনে করি তবে তাঁহার ব্রতকেও যেমন, তেমনই তাঁহার সেই অলৌকিক শক্তিকে আমরা গৌরবহীন করিব। নেতাজী যে মুক্তি চান সে যে কত বড় মুক্তি—সে পিপাসা যে কিসের পিপাসা, তাহা ঐ আজাদ-হিন্দ্-সেনাই বুঝিয়াছে, আমরা বুঝি নাই; যাহারা খাঁটি গান্ধী-পন্থী তাহারা ত’ বুঝিবেই না। তাই নেতাজীর সেই মুক্তি-সাধনের পন্থা লইয়া এত ধম্মাধর্ম্ম-বিচার, এত বিতর্ক আমরা করিয়া থাকি। যাহারা সেই স্বাধীনতা সেই মুক্তিকে অন্তরে প্রত্যক্ষ করে নাই, এবং করিয়া, এই মোহগ্রস্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ অতি-দুর্গত জাত কে তাহা দিবার জন্য, সেই অপার প্রেম, অপার করুণা অনুভব করে নাই—যে-প্রেম সর্ব্বস্ব-ত্যাগ করিয়াও তৃপ্তি পায় না,―তাহারাই অতি-ক্ষুদ্র ধর্ম্মবুদ্ধিকে আশ্রয় না করিয়া পারে না, কারণ তাহাদের আত্মার সেই মুক্তি ঘটে নাই—সে মুক্তি-পিপাসাও নাই। সে যে কত বড় প্রেম― তাহতে সকল দ্বিধা, সকল হিসাব-বুদ্ধি ভস্ম হইয়া যায় বলিয়াই হিংসাতেও যে হিংসাবোধ থাকে না, আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের নরনারী তাহা জানিয়াছে। সেই প্রেমকে তাহারা নেতাজীর রূপে সাক্ষাৎ-দর্শন করিয়াছে, রক্তমাংসের শরীরে তাহার আবির্ভাব দেখিয়াছে। সে এমন দেখা যে, তাহার পর আর কিছু বুঝিতে বা শুনিতে হয় না, তাহারা সকল শোনা ও সকল দেখার— ‘শ্রুতি’ ও ‘শ্রোতব্যে’র-পারে গিয়াছে; কারণ তাহারা যে ‘দেখিয়াছে’! তেমন দেখা কি আর কেহ দেখাইতে পারিয়াছে? যাহারা হিংসা-অহিংসার কথা বলে তাহারা কি ইহাও বুঝে না যে, যুদ্ধ সুভাষচন্দ্রের বৃত্তি বা পেশা নয়—যুদ্ধবিদ্যাই তাঁহার নিকটে পরাবিদ্যা নয়; যিনি কুরুক্ষেত্রে অর্জ্জুনের সারথি হইয়াছিলেন, এবার তিনিই নিজে রথী ও সারথি হইয়া সুভাষচন্দ্রের হৃদ্‌দেশে আসন লইয়াছেন। অথবা, নেতজীর ঐ যুদ্ধযাত্রা, উহা যেন বুদ্ধের সেই মহাভিনিষ্ক্রমণ―[] অগণিত আর্ত্ত নরনারীর দারুণ দুঃখমোচনের জন্য, ইহাও সেই বোধিবৃক্ষ-মূলে মার-বাহিনীর সঙ্গে শাক্য-সিদ্ধার্থের সংগ্রাম, মার-সেনাকে সদলে পরাজিত করিয়া নিজে মুক্ত ও বুদ্ধ হইয়া, তিনি সেই মুক্তি ও সেই বোধি আর সকলকে দিবার অধিকারী হইয়াছেন―ঐ বাহিরের যুদ্ধে যাহারা যোগ দিয়াছিল, তাহারাও অন্তরে মুক্তিলাভ করিয়াছে―তাহারাও মার-সেনাকে পরাস্ত করিয়াছে; সেই মার-সৈন্যগণের নাম―জাতি-অভিমান, ধর্ম্ম-অভিমান, নেতৃত্বাভিমান; কুলগর্ব্ব, পদগর্ব্ব, সর্ব্ববিধ লোভ, ঈর্ষ্যা, দেহসুখ ও মৃত্যুভয়। ইহা যদি হিংসার পথেই হইয়া থাকে, এবং অহিংসাব পথে ইহার অন্ধ ও প্রাণহীন অভিনয় মাত্র হইয়া থাকে―তবে কোন্ ধর্ম্ম বড়? হিংসা কাহাকে বলে? অহিংসাই বা কি?

 আসল কথা, এ তন্ত্রই ভিন্ন—ইহা গান্ধী-তন্ত্র নয়। ইহার মূলে আছে বিশুদ্ধ মুক্তি-পিপাসা। উহা শুধুই রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, তাহা অপেক্ষা অনেক বড়, উহা সেই আত্মারই বন্ধন-মুক্তি― যুগ-প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় বন্ধন-মুক্তির সঙ্গে তাহা এক হইয়া গিয়াছে। ইহা যে কেন বাঙালীর প্রতিভায় ও বাঙালীর সাধনায় সম্ভব হইয়াছে, তাহাও বলিয়াছি। দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাতীরে এই মুক্তি-পিপাসার আকুলতা, এবং সেই মহাসাধনায় সিদ্ধিলাভের কথা স্মরণ কর। সেই পিপাসার জন্ম হইয়াছিল বাংলায় এক অখ্যাত পল্লীতে―রাজা-জমিদারের ঘরে নয়— দরিদ্র-কুটীরে; সেই মূর্ত্তির সেই বেশ স্মরণ কর, অঙ্গে কেবল একখানি কটি-বসন,—ঐ বেশ যেমন খাঁটি বাঙালীর বেশ, ঐ মুক্তি সাধনাও তেমনই বাঙালীরই সাধনা। বাঙালীর প্রতিভাই ভারতীয় সাধনার বিচিত্র ও বহুমুখী প্রয়াসকে আত্মসাৎ করিয়া এবার যে নূতন বাণী ঘোষণা করিল, তাহাতে জীব ও ব্রহ্ম, ইহ ও পর, নিজের মোক্ষ ও পরের মুক্তি—আর্থিক ও পারমার্থিকের ভেদ রহিল না, এই মন্ত্রই স্বামী বিবেকানন্দের অপার্থিব মুক্তি পিপাসাকে পার্থিব মুক্তি-পিপসার সহিত অভিন্ন কবিয়া তুলিয়াছিল —আত্মার বন্ধন ও দেহের বন্ধন দুই-ই যে সমান, এবং দেহের বন্ধন দশাই অগ্রে মোচন করতে হইবে, এই মহাবাক্য তিনি ভারতবর্ষে সর্ব্ব প্রথম বজ্রকণ্ঠে প্রচার করিয়াছিলেন।

 জাতির মহাদুর্গতির আসন্ন অন্ধকারে এই প্রাণদ মন্ত্রই প্রচারিত হইয়াছিল, তখন কে জানিত তাহার এত প্রয়োজন ছিল। কোন দূর-দুর্লভ মুক্তি বা মোক্ষ নয়, এই জীবনেই মানুষকে তাহার স্বধর্ম্মে ও স্বাধিকারে প্রতষ্ঠিত করিবার কামনা এক বাঙালী-সন্তানকেই বেদান্তের দিব্যাচার হইতে শাক্তের বীরাচারে নামাইয়া আনিয়াছিল। ইহার কাবণ আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি—বাঙালী ইতিহাসে ও তাহার জাতিগত সংস্কারে তাহা নিহিত আছে। যে-বস্তু কোন জাতি সত্যই পাইয়াছিল, দীর্ঘকাল ভোগ করিয়াছিল, সে-বস্তু যদি সে হারায় তবে তাহার বেদনা যতই প্রচ্ছন্ন হউক, সে কিছুতেই শান্তি পায় না; এবং লগ্ন উপস্থিত হইলেই সেই জাতিগত উৎকণ্ঠা একটা বিবেকানন্দ, একটা সুভাষচন্দ্রে কেন্দ্রীভূত ও ঘনীভূত হইয়া প্রকাশ পায়—বায়ুমণ্ডলের অদৃশ্য জলকণা মেঘের আকারে শ্রাবণ ধারায় বর্ষিতে থাকে। বিবেকানন্দ যাহাকে তত্ত্বরূপে প্রত্যক্ষ করিয়া, আসন্ন ভবিষ্যতের প্রয়োজনে, চতুর্দ্দিকের মাটিতে বপন করিয়াছিলেন—তাহারই একটি বীজ অনতিবিলম্বে অঙ্কুরিত হইয়া নেতাজী-নামক বিশাল মহীরুহে পরিণত হইয়াছে।

 দেশের দুর্গতিমোচনের প্রয়াস যে উপায়েই হোক, সেই দুর্গতির নিদান সম্বন্ধে অভ্রান্ত দৃষ্টিই সর্ব্বাগ্রে প্রয়োজন। অভাবটা মূলে কোথায়, কি চাই, ইহাই যদি স্থির করিতে না পারি, তবে উপায় যত বড় উপায় হৌক, যত সাধু বা সত্য উপায় হৌক—তাহার অর্থ কি? মূল্যই বা কি? লক্ষ্য সম্বন্ধে যদি সত্য-জ্ঞান ও বিশ্বাস না থাকে, তবে একদিন উপায়টাই পরমার্থ হইয়া উঠিতে পারে, উপলক্ষ্যটা লক্ষ্যকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে। গান্ধী-নীতি ও সুভাষ-নীতির মধ্যে কেবল একটা উপায়গত ভেদই আছে মূলে দুইয়েরই লক্ষ্য এক, কেবল উপায়ের প্রভেদ মাত্র—একটি অহিংসার ও অপরটি হিংসার পথ, এই যে ধারণা, হহাব মত ভুল আর নাই। গান্ধীজী নেতাজীর লক্ষ্য এক নয়, একজন চান—যতদূর সম্ভব—দেশের জনগণের দুর্গতি-লাঘব, আর একজন চান—মুক্তি। একজন অন্তরের অন্তরে ব্রহ্মবাক্যের মত বিশ্বাস করিয়াছেন যে, এ ব্যাধির যে নিদান তাহাতে ঐ মুক্তি ছাডা আরোগ্যের আর কোন উপায় নাই, এজন্য মুক্তি আগে—পরে আর সব, আরেকজন তাহা বিশ্বাস করেন না, তাঁহার নিকট মুক্তির চিন্তা আগে নয়, দুর্গতিমোচনটাই আগে; সেই দুর্গতিমোচনের জন্য মুক্তির প্রয়োজন থাকিলেও তাহা সর্ব্বাগ্রে সম্ভবও নয়, আবশ্যকও নয় —সে মুক্তি ঐ দুর্গতিমােচনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমিক মাত্রায় লাভ করাই সম্ভব।[১০] একজনের বিশ্বাস অপরিসীম, আর একজন সেরূপ বিশ্বাস করিতেও ভয় পান। ইহাই স্বাভাবিক, কারণ একজন বদ্ধ, অপর জন মুক্ত। গান্ধীজীর কর্ম্মব্রত অসহায় দুর্গতদের লইয়া—বদ্ধ-জীব লইয়া, তাই তাঁহাকে বড় সতর্ক হইয়া, বড় হিসাব করিয়া চলিতে হয়। তিনি মহাত্মা হইলেও মহাপুরুষ নহেন; তিনি কত ভুল করেন, আরও কত করিবেন— মহাত্মার মত তাহা স্বীকার করেন, মহাপুরুষের মত তাহা বোধ করিতে পারেন না। সুভাষচন্দ্র ‘নিজে মুক্ত—নিত্যমুক্ত’ তাঁহার সেই মুক্ত-স্বভাবের যে প্রয়াস, তাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত দ্বিধাহীন—তাহা experiment নয়, কোনরূপ পরীক্ষার দ্বারা তাহার সত্যতা নির্ণয় করিতে হয় না। তাঁহার মনে কোন সংশয় নাই, দৃষ্টি অভ্রান্ত, তাঁহার পথও পৌঁছিবার পথ আবিষ্কারের পথ নয়, নিজে পৌঁছিয়াছেন বলিয়া তিনি জানেন, কোন্ পথে সকলকে পৌঁছিতে হইবে। ঐ একজনই সেই দিব্যশক্তি লাভ করিয়াছে, যাহাব সম্বন্ধে শ্রুতি বলিয়াছেন “যমেবৈষ বৃণুতে তেন লভ্যঃ”।

 এতকাল পরে সারা ভারতে যে নূতন প্রাণের সাড়া জাগিয়াছে—পরিত্রাণের যে ভরসা আবালবৃদ্ধবনিতাকে সঞ্জীবিত করিয়াছে তাহার কারণ কি? তাহার কারণ, এতদিন কাহারও মােহভঙ্গ হয় নাই, আজ ঐ একজনের হইয়াছে। যদি একজনেরও মোহভঙ্গ হয়, কেবল একজন মুক্ত হয়, তবে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আর সকলেও মুক্ত হইবে—আমাদের বেদান্তদর্শনের এই তত্ত্বটিই যেন আর এক ক্ষেত্রে, আর এক অর্থে প্রত্যক্ষ হইয়া উঠিয়াছে! বেদান্ত বলেন, রাম, কৃষ্ণ, কেহই মুক্ত হন নাই—হইলে সঙ্গে সঙ্গে জগৎ মুক্ত হইয়া যাহত, কারণ ব্রহ্মরূপী সেই এক জীব মুক্ত হইলে—তাহার মোহ-স্বপ্ন ভঙ্গ হইলে সেই স্বপ্নের অন্তর্গত সকল জীবেরই মুক্তি হইবে, সকলেই সেই স্বপ্নদ্রষ্টা ব্রহ্মে বিলীন হইয়া যাইবে। এই তত্ত্ব ঘোর উচ্চাধিকারের তত্ত্ব,ইহা বুঝিবার বা বিশ্বাস করিবার সামর্থ্য আমাদের নাই। কিন্তু আজ একি দেখিতেছি? সেই তত্ত্বই নিম্নাধিকারের ভূমিতে, মানবজীবনের জবানীতেই যেমন সত্য, তেমনই বোধগম্য হইয়া উঠিয়াছে। এখানে সেই এক জীব সুভাষচন্দ্র, একা তাঁহারই মোহভঙ্গ হইয়াছে, তিনিই মুক্তিকে অপরোক্ষ করিয়াছেন, ভারতবর্ষে আর কেহ তেন করে নাই। কিন্তু তাহারই ফলে একি দৃশ্য। সেই এক মুক্ত-জীবেব অপূর্ব্ব উৎসাহ ও উল্লাস শত শত জীবকে বন্ধনমুক্ত করিতেছে পঙ্গুকে গিরিলঙ্ঘন করাইতেছে। এ যেন সেই একটি ক্ষুদ্র দীপ-শলাকা কক্ষব্যাপী অন্ধকার নিমিষে দূর করিয়াছে, এ যেন সেই এক খ্রীষ্ট্রের আত্মবলিদানে সর্ব্বজীবের মুক্তিলাভ। না, বেদান্ত মিথ্যা বলে নাই; আমরাই ক্ষুদ্র, আমরাই অবোধ, আমাদেরই বিশ্বাস নাই।

 এই মোহভঙ্গই সবচেয়ে বড় কথা। আধুনিক ভারতে সুভাষচন্দ্র ভিন্ন আর কাহারও যে মোহভঙ্গ হয় নাই, ইহা অতিশয় সত্য কথা। সেই মোহভঙ্গ যে কি, তাহা পূর্ব্বে সবিস্তারে বলিয়াছি। শেষ পর্য্যন্ত, ইংরেজের মহত্ত্ব ও শুভবুদ্ধিতে বিশ্বাস কাহারও ঘুচে নাই—তাহার বিরুদ্ধে যত অভিমান ও অভিযানই করিয়া থাকুক, অন্তরের অন্তরে সেই মোহ ছিল, এখনও আছে। আমাদের এই বাংলাদেশের দুই মহামনীষীর কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহার মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের কথা ছাড়িয়া দিই, এমন কি রবীন্দ্রনাথেরও এ মোহ শেষ পর্য্যন্ত ছিল; কেবল মৃত্যুর কিছু পূর্ব্বে তাঁহার সেই মোহ ভাঙ্গিয়াছিল—মৃত্যুশয্যাশায়ী কবির সেই শেষ-বাণী সারা ভারতের আর্ত্তনাদের মত দিক-দেশ বদীর্ণ করিয়া ছিল। কিন্তু তাহারও পূর্ব্বে তিনি সুভাষচন্দ্রের মধ্যে, দেশনায়কের যে-মূর্ত্তি দেখিতে পাইয়া যে-বাণী উচ্চারণ করিয়া ছিলেন, তাহাতে সেই শেষবার তিনি তাঁহার ঋষিত্বই প্রমাণ করিয়াছেন।

 *  *  *

 গান্ধী-পন্থা যে সম্পূর্ণ বিপরীত, তাহা আহ কে না বুঝিয়াছে? কিন্তু সফলতা ও নিষ্ফলতার দ্বারাই যদি এই দুই পন্থা বিচার করিতে হয়, তবে তাহাও এতদিনে সুসাধ্য হইয়া উঠে নাই?নেতাজীর পন্থা কি নিষ্ফল হইয়াছে? গান্ধীজীর পন্থা কি সফল হইয়াছে? এই দুইটি পশ্নের উত্তর যাঁহারা ধীরভাবে চিন্তা করিবেন তাঁহারা বলিতে বাধ্য হইবেন যে, নেতাজীর নিষ্ফলতাও সারাভারতের যে কল্যাণ সাধন করিয়াছে, গান্ধীজীর অধুনা-বিঘোষিত তথাকথিত সফলতা সেই কল্যাণকে বিপন্ন করিতে চলিয়াছে। গান্ধীজীর নীতি মূলে দ্বৈত-নীতি, তাহাতে সর্ব্বত্র দুইপক্ষ আছে—ভেদকে স্বীকার করিয়াই রফা বা আপোসই তাহার গৌরব। এই প্রবন্ধে আমি, ইংবেজের যে নীতি ও তাহার যে গূঢ় ও দৃঢ় অভিপ্রায়ের কথা সবিস্তারে বলিয়াছি, তাহা স্মরণ করলেই বুঝিতে পার যাইবে যে, গান্ধীজী ও তাঁহাব সহচরগণের এই আত্ম-প্রসাদ একটি ঘোরতর আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র, ইংরেজের কূটনীতির নিকটে গান্ধী নীতি সম্পূর্ণ পরাস্ত হইয়াছে বলিয়াই ঐ আত্মপ্রবঞ্চনা এক্ষণে অশেষ মর্ম্মান্তিক হইয়া উঠিয়াছে। মন্ত্রী-মিশনের প্রস্তাবিত ব্যবস্থা মূলে গান্ধী-নীতিকে মানিয়া লইযাছে, অথচ তাহাতেই এমন কতগুলি গ্রন্থি বা প্যাঁচ লাগাইয়াছে যে, তাহাদের নিজেদের নীতিই জয়ী হইয়াছে। তথাপি গান্ধীজী তাহা মানিবেন না, মানিলে তাঁহাকে পূর্ণ-পরাজয় স্বীকার করিতে হয়, এক রূপ আত্মহত্যা করিতে হয়। যাহারা প্রতিবাদ করিয়াছে, যাহারা দ্রুত স্বাধীনতা চায় বলিয়া, তাঁহার ঐ আচরণে অতিশয় হতাশ হইয়াছে, তাহাদিগকে ভর্ৎসনা করিয়া তিনি ক্রমাগত যাহা বলিতেছেন তাহা যেমন বিস্ময়কর, তেমনই অর্থপূর্ণ—তাহাতে বুঝিতে পারা যায়, তাঁহার অন্তরের কামনা কি, এই পচিশ বৎসর তিনি ভারতের ভাগ্যকে কোন পথে চালনা করিয়াছেন। এমন অনেক উক্তি তিনি কিছুকাল যাবৎ করিতেছেন— তাঁহাকে ভুল বুঝিবার কোন কারণ নাই। তথাপি একটি উক্তি এখানে উদ্ধৃত করিলেই যথেষ্ট হইবে। ঐ মন্ত্রী মিশনের ব্যবস্থায যাহারা খুশী হয় নাই তাহাদিগের উদ্দেশে গান্ধীজী বলিতেছেন—

 “Now that there is Congress Raj or representative Raj, whether of the Congress variety or the Muslim League, they must set about reforming it in detail and not condemn it in toto.” (১৪ই জুলাই এর সংবাদে ‘হরিজন’ হইতে উদ্ধৃত)।

 অর্থাৎ—“(এই মন্ত্রী-মিশনের ব্যবস্থায়) এইবার যখন জনগণের অনুমোদিত শাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইল, তখন—তাহা কংগ্রেস-মার্কাই হোক, আর লীগ-মার্কাই হৌক —ঐ ব্যবস্থাকে আদৌ অতিশয় মন্দ বলিয়া পরিহার না করিয়া (অর্থাৎ উহার মূল নীতি স্বীকার করিয়া) যেখানে যেটুকু গলদ আছে তাহারই সংশোধনে প্রবৃত্ত হইতে হইবে।”

 এই কথাগুলিতে নিশ্চয় কেহ চমকিত হইবেন না, কারণ, ইহা দ্বারা প্রকারান্তরে ‘পাকিস্তান মানিয়া লওয়া হইয়াছে অথচ উক্তিটি কেমন নির্দ্দোষ! কিন্তু গান্ধীজী যাহা বলেন, তাহা যেমন সরল তেমনই গভীর— ঐ উক্তিটির ভাষ্য করিতে হইলে, তাঁহার আরও অনেক উক্তি, এবং গান্ধী-কংগ্রেসের অনেক পূর্ব্ব-সিদ্ধান্ত ও কীর্ত্তিকলাপ ইহার সঙ্গে স্মরণ করাইতে হয়। তথাপি ঐ উক্তিটির মধ্যেও সেই এক মনোভাব উঁকি দিতেছে, তাহা এই যে, কংগ্রেস বা লীগ—ভারতের যে অংশে যে-ই রাজত্ব করুক—শাসন-নীতি যখন মূলে একই হইয়া দাঁড়াইল, তখন সমগ্র ভারত ত’ সেই এক স্বাধীনতা লাভ করিল, বাংলাদেশে লীগের শাসনও যেমন, বিহারে কংগ্রেসের শাসনও তেমন—সেই একই জন-গণ-মন-অনুমোদিত শাসন, মূলে কোন দোষ নাই; গলদ যাহা থাকে তাহা নিজেরাই সংশোধন করিয়া লও; না পার, সে তোমাদেরই অক্ষমতা।[১১] ইহাতে ইংরেজের কোন ষড়যন্ত্র নাই, তাহারা ত’ কোথাও রহিল না,—হিন্দুই হোক, আব মুসলমানই হোক, তাহারা ত’ ইংরেজ নয়, তাহাদের হাতেই ইংরেজ সর্ব্বস্ব ছাড়িয়া দিয়াছে। ইংরেজের কোন কু’ মতলব নাই, এমন কি—

 “If the Constituent Assembly fizzles out it will not be because the British are wicked every time; it will be because we are fools, or shall I say even wicked”. (_ই জুলাই-এর সংবাদে ‘হরিজন’ হতে উদ্ধৃত)।

 অর্থাৎ “গণ-পরিষদ গঠন যদি শেষ পর্য্যন্ত একটা নিষ্ফল চেষ্টায় পরিণত হয়, তাহার কারণ, এই নয় যে, ইংরেজী প্রতিবারেই দুর্ব্বৃত্তপনা করিতেছে; এবং আমরাই নির্ব্বোধ শুধু নির্ব্বোধ নয়, আমবাই দুর্ব্বৃত্ত।”

 —ইংরেজের প্রতি এই বিশ্বাস, এবং ইংরেজের ঐ ব্যবস্থাতেই সন্তুষ্ট হইবার কারণ, আশা করি, আর বলিতে হইবে না, বরং আমি গান্ধী-নীতির যে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করিয়াছি— তাঁহার এই বর্ত্তমান উক্তিগুলি তাহারই সমর্থন করিতেছে। ঐ ব্যবস্থা দ্বারা ভারতের জাতীয়তা ও ঐক্যের মূলে যে কুঠারাঘাত হইল, উহা যে সদ্য-বিষের মত প্রাণহারী—উহার দ্বারা মুসলমানের সহিত প্রীতিস্থাপনও নয়, ইংরেজেরই শাসন-শৃঙ্খলকে আরও দৃঢ় করা হইল[১২]—এই অতি সহজ সত্যকে গান্ধীজী কিছুতেই মানিবেন না। তার কারণ, তিনি চিরদিন যাহা চাহিয়াছেন এই ব্যবস্থায় তাহার সবটুকু না হইলেও কিছু পাইয়াছেন—আপাততঃ তাহাই যথেষ্ট। ইংরেজ তাহার রাজ্য ভারতীয়গণের হাতে ছাড়িয়া দিল, অন্ততঃ দিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছে, এবং শীঘ্রই দিবে বা দিতে বাধ্য হইবে, এই মহাত্মাসুলভ সরল বিশ্বাসে তিনি তাঁহার কংগ্রেসী-ভারতের দুশ্চিন্তা দূর করিয়াছেন। কিন্তু ইংরেজ আর যাহা হউক—মহাত্মা নয়, সে যে কি করিয়া লইল, তাহা অন্ধেও দেখিতে পাইতেছে। ইংরেজ যদি দেশ শাসনের ভার ভারতীয়দিগের হাতে ছাড়িয়াই দেয়, তাহাতেই বা তাহার ক্ষতি কি? রাজ্যশাসন কখনও তাহার উদ্দেশ্য ছিল না, সে চায় লুণ্ঠনের অবাধ অধিকার। আজ যদি শাসনের দিকটা সে ছাড়িয়া দেয়, তবে দেখিতে হইবে তাহার সেই আসল অধিকারটি সে নিরাপদে রাখিতে সক্ষম হইয়াছে কিনা। স্পষ্ট দেখা যাইতেছে, সেই আসল অভিপ্রায় সিদ্ধির জন্য সে কোন কৌশলই বাকি রাখে নাই। প্রথমতঃ, এমন অনৈক্য সৃষ্ট করিয়াছে, যে ভারতবর্ষ কতকগুলি খণ্ডরাজ্যের প্রতিযোগিতায় নিত্য অশান্তিপূর্ণ হইয়া থাকিবে। শান্তিরক্ষার জন্য তাহাকে থাকতেই হইবে -ব্রিটিশসৈন্য মোতায়েন রাখিবার অজুহাত তাহার থাকিবেই[১৩] দুইটি— রাষ্ট্র-বিভাগ যেরূপ পরিকল্পিত হইযাছে, তাহাতে ভারতবর্ষে যে কখনো শান্তি স্থাপিত হইবে না, ইহা নিশ্চিত। তৃতীয়তঃ, যদি বা জনশক্তি কখনও একতাবদ্ধ হইয়া, এই সকল বন্ধন বেষ্টন ছিন্ন করে, তজ্জন্য দেশের গ্রাসাচ্ছাদন সমস্যাটি সে একটি নূতন অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর স্থাপন করিয়াছে,[১৪] সে এমনই যে, দেশীয় গভর্নমেণ্ট কি কেন্দ্রীয়, কি প্রাদেশিক—তাহার কূল-কিনারা পাইবেনা, কারণ তাহা এখন হাত একান্ত আন্তর্জাতিক সমস্যা বলিয়া গণ্য হইতেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইংরেজ এখনও তাহার ব্রহ্মাস্ত্র বাহির করে নাই, ভারতের সহিত ব্রিটেনের সেই Treaty বা চুক্তি, যাহা প্রধানতঃ বাণিজ্যাধিকারসংক্রান্ত—তাহাই এখনও কেহ জানে না। কিন্তু গান্ধীজী সে সকল কথা শুনিবেন না— ইংরেজ ঐ শাসন-কার্য্য ভাবতীয়গণের হাতে ছাডিয়া দিতেছে— ইহাই সবচেয়ে বড় কথা। শিশুকে যেমন কাঠের ঘােড়া দিয়া তাহার অশ্বারোহণ-বাসনা পূর্ণ করিতে হয় ইংবেজও তাহাই করিতেছে। গান্ধীজী মহাত্মা— এজন্য তাঁহার প্রাণ শিশুর মতই সরল; খ্রীষ্ট বলিয়াছেন, শিশুরাই ধন্য, কারণ তাহারাই সহজে স্বর্গে প্রবেশ করিতে পারিবে। গান্ধীজীও গােটা ভারতবর্ষকে সেই স্বর্গরাজ্যে পরিণত করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছেন।

 আসল কথা, নেতাজীর দ্বারা যদি ভারতে মুক্তিসাধন না হয়, যদি সেই মহাবীর্য্যবান, মহাপ্রেমিক, মহাপ্রাণ পুরুষ-বীরের আত্মোৎসর্গ আমাদিগকে মুক্তির পথে অগ্রসর না করিয়া থাকে, তবে আমাদের মুক্তির আর কোন আশা নাই। নেতাজীর পন্থাকে যাহারা কেবল হিংসা বা যুদ্ধের পন্থা বলিয়াই মনে করে তাহারা এখনও তাঁহার জীবনের মূলমন্ত্র বুঝিতে পারে নাই,—“স্বাধীনতা আগে, পরে আর সব।” সেই স্বাধীনতার ঐকান্তিক আকাঙক্ষা, এবং তাহার জন্য সেই প্রেম ও সেই প্রাণ—একটা অতি প্রবল ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ,—বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য নেতাজী তাহাকেই একমাত্র উপায় বলিয়া জানেন। গান্ধীজীর প্রেরণা সম্পূর্ণ moral - নেতাজীর প্রেরণা একান্তভাবে spiritual; একটিতে আছে সংকল্প-বিকল্পাত্মক মনের উপরে ধর্ম্মাধর্ম্মবোধের কঠিন শাসন, আর একটিতে আছে “বুদ্ধেঃ পরতস্তু” যে, সেই আত্মার সর্ব্ববন্ধন-মুক্তি—অকুণ্ঠিত প্রসার, অসীম স্ফূর্ত্তি। গান্ধীজী ধমক দেন, ভর্ৎসনা কুরেন, নেতাজী বুকে জড়াইয়া ধরেন। গান্ধীজী বলেন, তোমরা দুর্ব্বল, পাপচিত্ত—আমি করিব কি? নেতাজী বলেন, কোন ভয় নাই, তোমাদের ভিতরে অনন্ত শক্তি আছে; বিশ্বাস কর— আমাকে দেখ, তোমাদের পক্ষেও কিছু অসাধ্য নয়। গান্ধীজী নিয়মিত ভজনের দ্বারা, আত্মশুদ্ধি বা পাপমোচনের উপদেশ দেন, নেতাজী ভগবানের নাম করেন না, মানুষের নামই করেন তাঁহার ধর্ম্ম—ভগবানকে ভক্তি নয়, মানুষকে প্রেম; সেই প্রেমে পাপের চিন্তামাত্র নাই। নেতাজীর মধ্যে যে-শক্তির স্ফুরণ আমরা দেখিয়াছি, তাহা জগতে কচিৎ কখনো দেখা যায়; ভারতবর্ষের ইতিহাসে মনুষ্যভাগের একটি অতিকঠিন সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে বলিয়াই, এবং তাহা হইতে এই বিশাল মানবগোষ্ঠীর পরিত্রাণের আর কোন উপায় নাই বলিয়াই, আজ এ ঘটনা ঘটিয়াছে;— সমগ্র জাতির ভ্রান্তি ও দুর্ব্বলতা, ভয় ও নিরাশা, ঐ এক পুরুষের অসীম প্রেম ও অনন্ত বিশ্বাসের তাড়িতশক্তি বলে তিরোহিত হইতে চলিয়াছে, নেতাজীর সেই বিরাট বিশাল হৃদয়-মুকুরে ভারতবর্ষ আজ তাহার আত্মার প্রতিবিম্ব দেখিয়া উঠিয়া বসিয়াছে— তাহার নবজন্ম হইয়াছে।

 এই প্রবন্ধে, আমি কেবল গান্ধীজী ও নেতাজী—দুইজনের দুই মন্ত্র আমার সাধ্যমত বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি; দেশের বর্ত্তমান অবস্থায় কোন্ মন্ত্র অধিকতর উপযোগী, এবং সেই মন্ত্রে পরিত্রাণের উপায়ই বা কি, সে বিচার আমি করি নাই। উপায় যেমনই হৌক, তাহার মূলে একটা সত্য-নীতি থাকা চাই, এবং সত্য এক বই দুই নয়—তাহাতে মাত্রাগত প্রভেদও নাই; উপায় যদি সেই সত্য হইতে ভ্রষ্ট হয়, তবে অনন্তকালেও সিদ্ধিলাভ ঘটিবে না। আমি কেবল সেই সত্যটিকে ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি। আমি যাহা বলিয়াছি, তাহাতে আমার মত ব্যক্তির পক্ষে অতিরিক্ত দুঃসাহস আছে; অধিকাংশ পাঠকের তাহা শ্রুতিরোচক হইবে না। কারণ, আমি ইহা স্পষ্টই বলিয়াছি যে, গান্ধীজী নিজে সত্যনিষ্ঠ, সত্যাগ্রহী ও আত্মবিশ্বাসী হইলেও তাঁহার ঐ নীতি অতিশয় ভ্রান্ত-নীতি; সেই নীতিরও বহু পরিবর্ত্তন ইতিমধ্যে ঘটিয়াছে। তাহাতে প্রমাণ হয়, তিনি কখনও সাধ্য ও সাধন সম্বন্ধে নিঃসংশয় হইতে পারেন নাই। তিনি ভারতের ভাগ্য লইয়া, এ পর্য্যন্ত নিজেরই আত্মগত একটি hypothesis-এর experiment করিয়া চলিয়াছেন। সেই experiment-এর যেটুকু সুফল ফলিবার তাহা বহু পূর্ব্বেই ফলিয়াছে, তাহার বেশি হইবে না, হইবারও নয়; কিন্তু তাহাকেই খুব বেশি মূল্য দিয়া, একরূপ monomania-র বশে, তিনি এখন যে নেতৃত্বের দাবি করিতেছেন, তাহাতে হিত না হইয়া সমূহ অহিত হইতেই চলিয়াছে। মানুষ ক্রমেই যন্ত্রবৎ—বুদ্ধহীন ও আবেগহীন হইয়া পড়িতেছে, বিচারের পরিবর্ত্তে অন্ধ-ভক্তিই ___ হইয়া উঠিতেছে; এবং ভণ্ডামী ও মিথ্যাচার অতিশয় বৃদ্ধি পাইতেছে। অপর পক্ষে, নেতাজীর মন্ত্র অতিশয় প্রাণদ, এই মন্ত্রে যাহারা দীক্ষিত হইবে, তাহারা উপায়ের জন্য চিন্তা করিবে না—স্বাধীনতার সেই প্রাণময় আকাঙক্ষা যদি তাহাদের হৃদয়ে জাগে, তবে শুধু শক্তি নয—দিব্যজ্ঞানও লাভ করিবে, উপায় আপনিই দেখা দিবে; কারণ প্রেম কখনও ভুল করে না, প্রেমেই দিব্যজ্ঞান লাভ হয়। নেতাজীকে যদি তাহারা সত্যই অন্তরে পাইয়া থাকে, যে তাহারা যেমন ভয়ও করিবে না তেমনই ভুলও করিবে না।

  1. কংগ্রেস-রাজও খাঁটি পুলিশ-রাজ হইয়া উঠিয়াছে।
  2. অধুনা কংগ্রেস সরকার রাষ্ট্রীয় ঐক্যস্থাপনের নামে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রভুশক্তিকে নির্বিঘ্নে করিবার জন্য়, সমগ্র ভারতবাসীকে অধীনতার নাগপাশে দৃঢ়বদ্ধ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। ভারতের যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হইতেছে, তাহাতে ঐ উদ্দেশ্য গােপন করিবার কিছুমাত্র ভাবনা নাই―একটা নকল প্রতিনিধি সভার আজ্ঞাবাহী মেম্বরদিগের দ্বারা জনগণের নামে ঐ আইন বিধিবদ্ধ হইতেছে জাতির নেতা, এবং মহাত্মা গান্ধীর শিষ্যরূপে―ইহারা সকলের মুখ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। তাহার ফলে এইবার সমাজে, শিক্ষায়, এমন কি ধর্ম্মেও ভারতবাসীর স্বাধীনতা লোপ পাইবে,―এমন অধীনতা ইংরেজের আমলেও ভোগ করিতে হয় নাই। ইহারা আসলে সমগ্র ভারতের আত্মীয় নয়―আর সকল প্রদেশের বিরুদ্ধে একটা বিশেষ অঞ্চলকে তাহাদের প্রভুশক্তির কেন্দ্রস্বরূপ গড়িয়া লইতে চায়। প্রাদেশিক জাতি সকলের ভাষা ও সংস্কৃতির উপরেও ঐ প্রভু-জাতির আধিপত্য বা শ্রেষ্ঠতা একজাতিত্বের নামে প্রতিষ্ঠিত করিতে চায়; তাহার প্রমাণ প্রতিদিন স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। ইংরেজর মত ঐ একটা অঞ্চলের অধিবাসীরা রাজার জাতি হইবে; উহাদের ভাষা ইংরেজীর মতই রাজভাষা হইবে, শাসন পরিষদে উহারাই ইংরেজ শাসকবর্গের মত সকল ক্ষমতার অধিকারী হইবে―উহারাই নূতন সিভিল সার্ভিসের শীর্ষস্থানগুলিতে বিরাজ করিবে। উহাদের বিরুদ্ধে কিছু করিলে তাহাই হইবে রাজদ্রোহ, তাহার ছদ্মনাম হইবে anti-national, অর্থাৎ জাতীয়তার বিরােধী।
  3. যদি শেষ পর্য্যন্ত ছাড়িতেই হয় তবে তাহাতেও মুল স্বার্থ বজায় থাকে এমন একটা নীতি সে পালন করিয়াছে। পরিশিষ্টে “গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র” দ্রষ্টব্য।
  4. এই Civil Supply নামক শাসনদপ্তরটি প্রজা-দমন করিবার, অর্থাৎ প্রজাকে অন্নাভাবের দ্বারা ক্ষীণ ও নিঃসাহস করিয়া রাখিবার বড় উপায় হইয়া উঠিয়াছে; উহা প্রজাকে অন্ন দিবার জন্য নয়, অন্ন-বঞ্চিত করিবার যন্ত্র।
  5. ব্রিটিশ প্রভুদের সেই নীতি না মানিয়া চলিলে কংগ্রেসী প্রভুত্বও টিকিবে না। কংগ্রেস কেবল ব্রিটিশের পরিত্যক্ত সেই একই সিংহাসনে বসিয়াছে বইত’ নয়।
  6. ভারতকে সে কি স্বাধীনতাই দান করিয়াছে! এমন লাভজনক আদুষ্পাঠ্য, কেহ কল্পনা করিতে পারিত!
  7. এখনও অর্থাৎ এই তথাকথিত স্বাধীনতা-লাভের পরেও, ইংরেজের সেই নীতি জয়ী হইয়া আছে।
  8. বাংলার প্রাচীন রাজবংশগুলি প্রায় সকলই অবাঙ্গালী, তাহাদের রাজত্বকালেও― পরবর্ত্তী কালের বিদেশী রাজাদের আমোলে যেমন, ঠিক তেমনই ভাবে রাজাকে দূর হইতে ভক্তি করিয়া ও রাজ কর দিয়া, এ জাতি পরিবারে ও সমাজে আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়াছে―তাহার ধর্ম্ম ও সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ ও অব্যাহত রাখিয়াছে।
  9. ইহা যে কত সত্য তাহা বুদ্ধের সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দের এই বাক্যগুলি পাঠ করিলেই নিঃসংশয় হওয়া যায়, ইহার প্রাকটি কথায় নেতাজীর সমগ্র জীবন ও অন্তরতম চরিত্রের পরিচয় অভ্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে―
     “That boldness, that fearlessness, who that tremendous love. He was born for the good of men. Others may seek God, others may seek truth for himself, he sought truth because people were in misery. How to help them that was his only concern. Throughout his life he never had a thought for himself."
     যাঁহারা আধ্যাত্মিক ধর্ম্ম সাধনার উচ্চাভিমানে এমন চরিত্রের কু-ব্যাখ্যা করেন (শ্রীদিলীপকুমারের ইংরাজী পুস্তক দ্রষ্টব্য) তাঁহাদের সম্বন্ধেও স্বামীজী যথার্থই বলিয়াছেন―
     “How can we, ignorant, selfish, narrow-minded human beings ever understand the greatness of this man?”
  10. পরিশিষ্টে “গান্ধী ও গান্ধী-কংগ্রেস সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র” শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।
  11. গান্ধীজীর সকল ব্যবস্থাই এইরূপ অভ্রান্ত, যদি সুফল না ফলে, তবে দোষ মানুষগুলার, আজ এই যে অবস্থা হইয়াছে তাহার জন্য তাঁহার ঐ নীতি দায়ী নয়, আমরাই অক্ষম।}}
  12. কথাটায় কেহ চমকিত হইবেন না। ইংরেজ যে কিরূপ স্বাধীনতা দান করিয়াছে, তাহা এখনও যাহারা বুঝিতে পারেন নাই, তাহাদিগকে বুঝাইবার প্রয়োজনও নাই।
  13. ব্রিটিশ রাষ্ট্রধুরন্ধরগণ আরও গভীর জলে খেলিতেছেন। ব্রিটিশ সৈন্য সম্মুখ হইতে সরাইয়া শিখণ্ডীর পশ্চাতে তাহা স্থাপন করিয়া আবশ্যক মত কার্য্য হাসিল করিতেছেন।
  14. এই নীতিও যুদ্ধোত্তর জাগতিক অবস্থায় অলঙ্ঘনীয় তাহাতে আরও সুবিধা হইয়াছে।