গ্রন্থকারের নিবেদন

 ভারত-ইতিহাসের বর্ত্তমান সন্ধিক্ষণে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মত একজন পুরুষের আবির্ভাব কেমন করিয়া সম্ভব হইল ও তাহার কি প্রয়োজন ছিল, এই পুস্তকে তাহাই বুঝিবার ও বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছি। এ পর্য্যন্ত নেতাজীর জীবন-কথা, কীর্ত্তি ও চরিত্র সম্বন্ধে অনেক ছোট বড় পুস্তক বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় রচিত হইয়াছে, কিন্তু সে সকলের উদ্দেশ্য অন্যরূপ―তাহাতে, ইংরেজীতে যাহাকে ‘mission’ বলে,সুভাষ চন্দ্রের সেই mission বা তাঁহার জীবনের একমাত্র ব্রত নির্দ্দেশপূর্ব্বক, তাহারই আলোকে তাঁহার চরিত্র ও প্রতিভার ব্যাখ্যা কেহ করিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। যে রাজনৈতিক রণক্ষেত্রে তিনি একরূপ অবিশ্রামে তাঁহার যোদ্ধৃ-জীবন যাপন করিয়াছিলেন, মুখ্যত তাহারই পটভূমিকায় তাঁহার সেই ব্রত ও তাহার সাধন-মন্ত্র বুঝিয়া লইতে হইবে; আবার, সকল দ্বন্দ্ব, সকল ঝড়-ঝঞ্ঝার ঊর্দ্ধে সেই পুরুষের যে মুক্ত-আত্মা, স্থিরদীপ্ত নক্ষত্রের মত নিঃসঙ্গ নৈঃশব্দ্যে আপনাতে-আপনি পূর্ণ হইয়া বিরাজ করিত, তাহার রহস্য-গভীর মহিমাও স্মরণ রাখিতে হইবে। কারণ, সুভাষচন্দ্রের মত পুরুষ কোন একটা ব্রত-পালনের দৃষ্টান্তই নহে―সে জীবন তদপেক্ষা মহত্তর ও গূঢ়তর সত্যের ইঙ্গিত-স্বরূপ।

 তাই, আমি সুভাষচন্দ্রের সেই সমগ্র পরিচয় আমার সাধ্যমত অতি সংক্ষেপে বিবৃত করিয়াছি। ব্যক্তিকে বুঝিবার জন্য, দেশ ও কালের পরিবেষ্টনী এবং জাতির পূর্ব্ব-সাধনার ধারাটিকে সর্ব্বদা সম্মুখে রাখিয়াছি, কারণ, সুভাষচন্দ্রও যে একটা জাতি ও যুগের মুখ্য প্রতিনিধি তাহাতে সন্দেহ নাই। সেই তথ্য ও তত্ত্বের আলোচনায় আমি, যতদুর সম্ভব ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই, জাতীয় চরিত্রের অন্তর্নিহিত প্রেরণাও বুঝিবার চেষ্টা করিয়াছি, এবং তাহারই অভিনব ও যুগোচিত অভিব্যক্তিরূপে ঐ চরিত্র ও ঐ প্রতিভার ব্যাখ্যা করিয়াছি। ইহার প্রয়োজন ছিল; কারণ,সুভাষচন্দ্র ভারতের রাজনীতি-ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্টনীতিকে জয়যুক্ত করিতে চাহিয়াছিলেন; সেই নীতি এমনই যে, তাহার শক্তি ও দীপ্তি যেমন সকলকে সচকিত করিয়াছিল, তেমনই অপর একটা পূর্ব্ব-প্রতিষ্ঠিত ও বহুজন-বন্দিত নীতিকে আক্রমণ করিয়া তাহার সুস্পষ্ট প্রতিবাদরূপে আত্মপকাশ করিয়াছিল। এই নীতিই সুভাষচন্দ্রের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার মনোময় বিগ্রহ। এজন্য সুভাষচন্দ্রকে চিনিতে ও বুঝিতে হইলে, গান্ধী-কংগ্রেসের সহিত তাঁহার যে বিরোধ, তাহার স্বরূপ ও মূল কারণ উত্তমরূপে অনুধাবন করিতে হইবে, তাহাতেই সেই নীতি অতিশয় সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হইবে।

 এই পুস্তকে সেই বিরোধের তথ্য ও তত্ত্বঘটিত আলোচনা আমি একটু বিশেষভাবেই করিয়াছি, এবং সেই সঙ্গে, সুভাষচন্দ্রকে বুঝিবার জন্য, অথবা আমি যতটুকু বুঝিয়াছি তাহারই সাক্ষ্যস্বরূপ, কয়েকটি প্রধান তথ্য অবলম্বন করিয়া, অতিশয় সহজ যুক্তি ও ঘটনা-প্রমাণে সেই বিরোধের যে বিবৃতি ও ব্যাখ্যা করিয়াছি, তাহা আজিকার দিনে অধিকাংশ পাঠকের প্রীতিকর হইবে না জানি; কিন্তু আমার গত্যন্তর ছিল না, কারণ সত্যের অপলাপ করিলে সুভাষচন্দ্রকেও মিথ্যার দ্বারা কলঙ্কিত করিতে হয়; নেতাজীকে যাঁহারা সত্যই শ্রদ্ধা করেন তাঁহারা ইহা মনে রাখিবেন। কিন্তু প্রতিকার যে হইবে না তাহার কারণ চিন্তা করিলে আরও দুঃখিত হইতে হয়। প্রথমতঃ, কংগ্রেসের গান্ধীবাদ এখন একটা ধর্ম্মমতের মত জনসাধারণের চিত্ত অধিকার করিয়াছে এবং ধর্মবিশ্বাস-মাত্রেই অন্ধ, তাহা কোন যুক্তি মানে না, যুক্তি চাহে না। দ্বিতীয়তঃ, দেশের সকল পত্র ও পত্রিকা গান্ধীমতাবলম্বী; এই সকল পত্রিকার নিরবচ্ছিন্ন প্রোপাগ্যাণ্ডা এমন সংস্কারের সৃষ্ট করিয়াছে যে, তদ্দ্বারা যুক্তিনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, সত্যপিপাসু ব্যক্তিগণও বিভ্রান্ত হইয়াছেন। তৃতীয়তঃ, অবস্থা এমন দাঁড়াইয়াছে যে, জনসাধারণের জন্য এমন-কোন দলভাব মুক্ত পত্রিকা নাই যাহাতে সমালোচনার নিরপেক্ষতা সকলের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। অথচ, যত সত্যই হৌক, সকল মতেরই একটা প্রতিবাদী মত থাকিবে, এবং থাকাই উচিত, না থাকিলে জাতি বা সমাজের মনের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। কিন্তু এক্ষণে এ দেশে ঐ এক-ধর্ম্ম ও এক মত ব্যতিরেকে আর কিছুই প্রচার হইতে পারিবে না। বেশ বুঝিতে পারা যায়, এই প্রোপাগ্যাণ্ডার পশ্চাতে একটা বিরাট ব্যবসায়ী- চক্রান্ত বা অর্থনৈতিক প্রভূত্ব আছে। ইহাতেও প্রমাণ হয় যে, ঐ কংগ্রেসের নীতির মধ্যেই এমন কিছু আছে যাহা ছোট বড় সকল সুবিধাবাদীগণের পক্ষে বড়ই হিতকর। বাংলাদেশে এই সুবিধাবাদই কংগ্রেস ধর্ম্মকে দৃঢ়মূল করিয়াছে, এ কথা যে সত্য তাহা প্রমাণ করিতে বেশীদূর যাইতে হইবে না―বাংলাদেশে যাঁহারা ঐ ধর্ম্মের পাণ্ডা তাঁহাদের বাহিরের নর্ত্তন ও ভিতরের কীর্ত্তন মিলাইয়া দেখিলেই তাহাতে আর সন্দেহ থাকিবেনা। ঐ প্রপাগ্যাণ্ডা এমনই নিশ্ছিদ্র ও সংঘবদ্ধ যে, আজিকার এই দারুণ দুর্গতির মধ্যেও বাঙালীর মুখ বন্ধ রাখা হইয়াছে, তাহার বুকের বেদনা ও মনের প্রকৃত ভাব প্রকাশ পাইতেছেনা। কোন পত্রিকাই সত্য কথা বলিবে না, বরং, তাঁতিকুল ও বৈষ্ণবকুল দুই কুলই রক্ষা করিবার জন্য, কেহ কেহ যেরূপ চতুরতার কসরৎ করিয়া থাকে, তাহা যেমন শোচনীয়, তেমনই হাস্যকর।

 চতুর্থতঃ, সুভাষচন্দ্রের আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের রোমাণ্টিক কীর্ত্তিকাহিনীই বাঙালীকে তথা ভারতবাসীকে মুগ্ধ করিয়াছে; কিন্তু সুভাষজীবনের আদ্যন্ত, তাঁহার সেই মহাযজ্ঞের প্রায়ণ বা আরম্ভ-কাহিনী প্রায় অজ্ঞাত রহিয়া গিয়াছে; বিশেষ করিয়া কংগ্রেসের সহিত তাঁহার সেই বিরোধ―সেই বিরোধের কারণ ও গুরুত্ব সম্বন্ধে জনসাধারণ প্রায় অজ্ঞ। এই অজ্ঞতার হেতু কি তাহা কাহারও বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। সেই স্মৃতিকে জন-চিত্ত হইতে মুছিয়া ফেলাই যাহাদের একান্ত প্রয়োজন তাহারাই, সুভাষচন্দ্রের আজীবন একনিষ্ঠ প্রয়াস―আসন্ন ও নিশ্চিত সর্ব্বনাশ হইতে দেশকে বাঁচাইবার জন্য তাঁহার সেই আকুল আগ্রহ, এবং তাহারই প্রতিমুখে কংগ্রেসের সর্ব্বশক্তি-নিয়োগ―ত্রিপুরীর সেই কলঙ্ক-কাহিনী—এখনও মৃত্তিকাতলে পিহিত রাখিয়াছে। আমি এই পুস্তকে, সেই কাহিনীর যেটুকু অত্যাবশ্যক তাহাই পুনরুদ্ধার করিয়াছি; অত্যাবশ্যক এইজন্য যে, ঐ কাহিনীতেই আজাদ হিন্দ্-ফৌজের নেতাজীকে―মেঘাচ্ছন্ন হইলেও, নবোদিত সূর্য্যের মত দেখিতে পাওয়া যাইবে। আমি বলিয়াছি, গান্ধী-নীতি ও গান্ধী-কংগ্রেসের সহিত তাঁহার সেই বিরোধই তাঁহার ধর্ম্মের মূলমন্ত্র এই বিরোধকে কোনরূপে ছোট করা বা অস্বীকার করা চলিবে না―সুভাষচন্দ্রের গান্ধী-ভক্তির দোহাই দিয়া গান্ধীজী ও সুভাষ উভয়েরই মান-রক্ষা করিবার চেষ্টাও নিষ্ফল। পাছে কেহ মনে করেন যে, আমি আমারই ব্যক্তিগত মত বা ধারণার বশে, সুভাষচন্দ্রের উপরে ঐরূপ একটা অনমনীয় মনোভাব আরোপ করিয়াছি, এজন্য আমি এই পুস্তকের ‘পরিশিষ্টে’ সুভাষচন্দ্রের এমন কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়াছি যাহাতে, আর কিছু না হোক, সুভাষচন্দ্র যে গান্ধীবাদের সহিত কোনরূপ রফা করিতে প্রস্তুত ছিলেন না, তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ মিলিবে।

 সুভাষচন্দ্রের স্বকীয় রাজনীতি, তাঁহার বিশ্বাস ও লক্ষ্য কি ছিল, তাহার যথাসাধ্য পরিচয় ও প্রমাণ আমি দিয়াছি, কিন্তু একটি বিষয়ে আমি পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি বিশেষ করিয়া আকর্ষণ করিতে চাই। তাহার সেই মত বা দৃষ্টিভঙ্গি যেমনই হোক, তাহার বিরুদ্ধে যেমন যুক্তিই থাকুক,―তিনি ব্রিটিশ জাতির চরিত্র, তাহাদের কঠিন সংঙ্কল্প ও গভীর কূটনীতি সম্বন্ধে যে কিছুমাত্র ভুল করেন নাই, এবং কংগ্রেসের মতি-গতি ও আচার-অনুষ্ঠান, তাহার নীতি ও ধর্ম্ম তিনি যে উত্তমরূপে বুঝিয়াছিলেন এবং সে সকলের ব্যর্থতাও নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করিয়াছিলেন―আজিকার অবস্থা-দৃষ্টে তাহা সকলেই স্বীকার করিবে; আমি সুভাষচন্দ্রের সেই সকল সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ-বাণী মিলাইয়া দেখিতে বলি। কংগ্রেসের সেই সংগ্রাম-ভীরু আপোষ নীতি এতদিন তাহার কর্ম্মনাশ করিতে ছিল, এক্ষণে ধর্ম্মনাশ করিতেছে। আজ দেশে যে গুরুতর সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছে তাহা পূর্ব্বে কেহ ভাবিতেও পারে নাই, তাহার কারণ, কংগ্রেসের সেই ধর্ম্মনীতিকেই উৎকৃষ্ট রাজনীতি ও দূরদর্শিতার প্রমাণ বলিয়া সকলে বিশ্বাস করিয়াছিল। কিন্তু আজিকার এই ভূমিকম্পে চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তিমাত্রেরই দৃষ্টিভ্রম ঘুচিবে। ইহা যে কংগ্রেসের সেই ভ্রান্ত নীতির অবশ্যম্ভাবী ফল, এবং ভারতের স্বাধীন-সংগ্রাম যে অতঃপর নূতন করিয়া আরম্ভ করিতে হইবে, সে সম্বন্ধে কাহারও সন্দেহ থাকিতে পারে না। কিন্তু কংগ্রেস এমনই মোহগ্রস্ত হইয়াছে, এমনই সত্য-মিথ্যা-জ্ঞান হারাইয়াছে যে, এখনও সে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিতেছে যে, এ সকলই আসন্ন স্বাধীনতা-লাভের লক্ষণ। কিন্তু জনগণ কি দেখিতেছে? চতুর্দ্দিকের ঘটনা-প্রমাণে যে অবিসংবাদিত সত্যকে তাহারা সহজবুদ্ধিতে প্রত্যক্ষ করিতেছে, কেবল বাক্যের কূট-কৌশলে তাহাকে অস্বীকার করে কেমন করিয়া? আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ঠিক ইহাই যে ঘটিবে, এবং গান্ধী-কংগ্রেসও যে ধ্বংস প্রাপ্ত হইবে তাহা সুভাষচন্দ্র অতিপূর্ব্বেই দৃঢ়কণ্ঠে ও নিঃসংশয়ে প্রচার করিয়াছিলেন; তখন যাহা কেহ বিশ্বাস করে নাই, আজ তাহা বেদবাক্যের মতই অভ্রান্ত হইয়া উঠিয়াছে। তাই মনে হয়, যখন দেশের সকলেই ঘুমাইতেছিল, তখন ঐ একমাত্র পুরুষ নিজের অন্তর দীপটি জ্বালাইয়া জাগিয়া বসিয়াছিলেন, কারণ,―“যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী। আমি তাঁহার সেই বাণীগুলির প্রতিও বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি, হয় ত’ এখনও তদ্দ্বারা মোহাচ্ছন্নের চৈতন্য-সম্পাদন হইতে পারে।

 নেতাজীর নীতি ও নেতৃত্বের মূলে যে একটী বিশিষ্ট জাতি-ধর্ম্ম বা সাধনামূলক সংস্কৃতির প্রেরণা আছে, এই পুস্তকে আমি তাহাও বিশেষ করিয়া উল্লেখ করিয়াছি। বাঙালী পাঠককে সে বিষয়ে অবহিত হইতে হইবে, কারণ, ধর্ম্মের দিয়াও ঐ নীতির সহিত গান্ধী নীতির প্রত্যক্ষ বিরোধ আছে। গান্ধীজীর ধর্ম্ম আধুনিক ভারতের ধর্ম্ম হইবার উপযোগী কি না, তাহা মধ্যযুগীয় আধ্যাত্মিকতারই অধিকতর অনুকূল কি না―আত্মনিগ্রহ এবং ব্রত-উপবাস-ভজন প্রভৃতির বৈরাগ্যমূলক সেই সন্ন্যাসের আদর্শ আধুনিক জীবনের আদর্শ হইতে পারে কিনা, ইহাও চিন্তা করিয়া দেখা আবশ্যক। বাঙলীই ধর্ম্মের ঐরূপ আদর্শ-বিষয়ে, ভারতের অন্য সকল জাতি হইতে চিরদিনই কিছু স্বতন্ত্র, সেই আধ্যাত্মিক আদর্শকেও আধিভৌতিকের সহিত মিলাইয়া, একটা পূর্ণতর জীবন-বাদকে ধরিয়া থাকাই তাঁহার প্রতিভার বিশিষ্ট লক্ষণ। ‘বাংলার নবযুগ’ নামক গ্রন্থে আমি ইহার বিস্তারিত বিচারণা করিয়াছি, এখানে এই প্রসঙ্গে পুনরায় দুই-চারটি কথা বলিব। বাঙালীই পুনরায় সেই আধ্যাত্মিকতাকে, নবযুগের প্রয়োজনে, একটি নূতন রূপে, মানুষের দেহমনের বাস্তব ভিত্তির উপরে স্থাপিত করিয়াছে। এই ধর্ম্মের নাম―দেশ ও জাতি-প্রেম, ইহার সাধনায় শক্তিই মুখ্য। ইহা যেমন নিখিল মানব-প্রেম নয়, তেমনই তাহার বিরোধীও নয়; ইহা অহিংসা বা উপবাসের ধর্ম্মও নহে। এই ধর্ম্ম বিশেষভাবে বাঙালীজাতির জাতীয় সংস্কারে নিহিত থাকিলেও, ইহাতে সার্ব্বজনীন মানব-প্রকৃতির এমন একটি চিরন্তন সত্য স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে, যে তাহাকেও ভারতীয় আদি-হিন্দুধর্ম্ম বা ‘সনাতন’-মানবধর্ম্ম বলা যাইতে পারে,―তাহার সেই মধ্যযুগীয় আবরণ ভেদ করিয়া এই ধর্ম্মই তাহাকে পুনঃপ্রকাশিত করিয়াছে। এইরূপে বাঙালীই, যে-ধর্ম্ম প্রকৃত হিন্দুধর্ম্ম―যাহা ব্যাসের সঙ্কলিত ‘মহাভারতে’ একটি সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করিয়াছে―সেই ধর্ম্মকে পুনরুদ্ধার করিয়াছে। সেই ধর্ম্ম হইতেই বাঙালী একটা খুব বড় ‘nationalism’-এর অনুপ্রাণনা পাইয়াছে,―তান্ত্রিক অনার্য্য বাঙালীই আর্য্য ও অনার্য্যের মধ্যে মিলনের সেতু যোজনা করিয়া একটা নূতন ও বৃহত্তর মহাভারতের সূচনা করিয়াছে। তাহার সেই তান্ত্রিক শক্তিপ্রীতি ও বৈষ্ণব রস-সৃষ্টি―এই দুই মিলিয়া ঐরূপ ধর্ম্ম-প্রণয়নের সহায় হইয়াছে। সেই ধর্ম্ম একদিকে আর্য্যের শ্রেষ্ঠ ধর্ম্মতত্ত্ব―মহাভারতের সার-মর্ম্ম―গীতার সেই কর্ম্ম-সন্ন্যাস বা জীবন্মুক্তিবাদকে, এবং অপর দিকে অনার্য্যের ভোগবাদ বা জীবনসত্য-বাদকে মিলাইয়া একটি অপূর্ব্ব সমন্বয়মূলক জীবন-বাদের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে; তাহাতে শক্তিরূপা প্রকৃতিই একাধারে ভক্তি ও মুক্তিদায়িনী হইয়াছে। তন্ত্রের সেই শক্তিপূজাকেই ভারতের স্বাজাত্য-সাধনায় প্রয়োগ করিয়া বাঙালী আধুনিক ভারতে এক নবধর্ম্মের শুরু হইয়াছে। এই মন্ত্রের আদি-স্রষ্টা―বঙ্কিমচন্দ্র; পরে স্বামী বিবেকানন্দ ও নেতাজী সুভাষচন্দ্রের মধ্যে ইহার স্ফুটতর ও পূর্ণতর অভিব্যক্তি হইয়াছে। আদি-কংগ্রেসের সহিত এই ধর্ম্মের সাক্ষাৎ সম্পর্ক ছিল না,―বঙ্কিম বা বিবেকানন্দ কেহই তৎপ্রতি আকৃষ্ট হন নাই―তাহার কারণ, উহার মূলে ভারতীয় প্রেরণা ছিল না; গান্ধী-কংগ্রেসও সুভাষচন্দ্রকে আকৃষ্ট করে নাই এই জন্য যে, সেই খাঁটি ভারতীয় ধর্ম্মের সুস্থ ও প্রাণময় প্রেরণা উহাতে নাই; উহা প্রাণধর্ম্মী, গতিধর্ম্মী নয়; উহার মূলে আছে সেই মধ্যযুগীয় mysticism―জীবন-সত্যকে অগ্রাহ্য় করিয়া একটা অবাস্তব ভাব-সাধনার মোহ, গীতা যাহাকে ‘ক্লৈব্য' বলিয়াছেন সেই ক্লৈব্যেরই জয়গান। একমাত্র মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক বাংলার এই নবজাগরণকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখিয়াছিলেন, তিনি এই ধর্ম্মের সমর্থন করিয়াছিলেন। তাঁহার গীতাভাষ্য―সেই ‘গীতা-রহস্য’ নামক বিশাল গ্রন্থে, তিনি হিন্দুধর্ম্মের যে ব্যাখ্যা করিয়াছেন তাহাতেও সেই ধর্ম্মকে―‘নিবৃত্তিপর’ নয়―‘প্রবৃত্তিপর’ বলিয়া প্রমাণিত করিয়াছেন; তিনি শ্রীকৃষ্ণের ‘তস্মাৎ যুধ্যস্ব ভারত’ এই উপদেশকে মধ্যযুগীয় ভক্তি-বৈরাগ্যের দুর্ব্যাখ্যা হইতে মুক্ত করিয়াছেন।

 বাংলাদেশেই সর্ব্বপ্রথম রাজনৈতিক বিক্ষোভ আরম্ভ হয়, তাহার মূলে ছিল বঙ্কিম-বিবেকানন্দের বাণী। সেই নবধর্ম্মাবেগের আঘাতে আদি-কংগ্রেস ভাঙিতে আরম্ভ করে; সেই সময়েই বাঙালীর সেই ধর্ম্মমন্ত্র বীজরূপে ভারতের সর্ব্বত্র ছড়াইয়া পড়ে, এবং ক্ষেত্রবিশেষে তাহা অঙ্কুরিত হয়। তখন হইতেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রকৃতপক্ষে আরম্ভ হয়। ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষও রীতিমত চঞ্চল হইয়া উঠে; এবং তখন হইতেই একদিকে যতরকমের তথাকথিত reforms এবং অপরদিকে কঠোর দমন-নীতি তাহাদের রাজ্যরক্ষার প্রধান উপায় হইয়া আছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর, পৃথিবীর সকল দেশের মত, এদেশেও বিষম অবস্থান্তর ও অবসাদ ঘটে। সেই লগ্নে গান্ধীজী তাঁহার নূতন ধর্ম্ম ও নূতন কর্ম্মনীতি লইয়া ভারতের রাজনীতি-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হইলেন; সেই দারুণ অবসাদ ও নিরাশ তাঁহার নেতৃত্বের বড়ই অনুকুল হইয়াছিল, তিনি হইয়াছিলেন—‘The man of the moment’। সেই স্বাজাত্যবাদ ও শক্তিবাদকে সম্পূর্ণ ভিন্নমুখী করিয়া, তিনি ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামকে যে পথে প্রবর্ত্তিত করিলেন তাহাতে বাঙালীর স্থান আর রহিল না—সঙ্গে সঙ্গে সেই জীবন-বাদ, সেই শক্তিবাদ, সেই মহাভারতীয় হিন্দুধর্ম্মও পুনরায় মধ্যযুগীয় আধ্যাত্মিকতা ও ক্লীববৈরাগ্যের দ্বারা আচ্ছন্ন বা নিরাকৃত হইয়া গেল। এখানে এ সময়ে অধিক বলিবার স্থান নাই―ভুমিকা দীর্ঘ হইয়া পড়িতেছে। এ সম্বন্ধে আমি অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করিয়াছি।[] এখানে আমি কেবল ইহাই বলিতে চাই যে, নেতাজী সুভাষচন্দ্রেই সেই বাঙালী-ধর্ম্ম ও বাঙালী-প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হইয়াছে, তিনিই নবযুগের মানব-ধর্ম্মকে স্বাভাবিক ও সার্ব্বজনীন ভিত্তির উপরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়া, শুধুই ভারতের হিন্দুকে নয়, মুসলমানকেও, মুক্তির পথ দেখাইয়াছেন। এই বাংলাদেশে বাঙালীই সে পথের সন্ধান করিয়াছে―সেই যে “দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি,” তাহাকে সুগম করিয়াছে, এবং সারা ভারতকে সেই পথে চলিতে আহ্বান করিয়াছে। গান্ধীধর্ম্ম মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ বলিয়া―বরং তাহা প্রকৃতি সম্বন্ধে নাস্তিক, এবং একরূপ অধ্যাত্মবাদে অন্ধবিশ্বাসী বলিয়া, হিন্দু মুসলমান কাহারও ধর্ম্ম হইতে পারে না; সেই ধর্ম্ম যেমন যুগোচিত নয়, তেমনিই তাহার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সমন্বয়বিমুখ বলিয়া―সত্যও নহে। সুভাষচন্দ্রও, বিবেকানন্দের মত, কেবল বাংলার কথাই ভাবেন নাই; তিনি ভারতের সর্ব্বপ্রদেশ, সর্ব্বজাতি ও সর্ব্বসম্প্রদায়কে এক গভীর ও উদার স্বাজাত্যবোধের দ্বারা―সমগৌরব-বোধের দ্বারা (পাপমোচন বা হরিজনসেবা দ্বারা নয়), সত্যকার আত্মীয়তা-বন্ধনে বাঁধিতে চাহিয়াছিলেন। এই মুক্তির বার্ত্তা বাঙালীই প্রথম হইতে বহন করিয়াছে; কি হেতু তাহা সম্ভব হইয়াছে, সে কথা আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি। ভারতের স্বাধীনতা-যজ্ঞে বাঙালীর এই পৌরোহিত্য সকল সত্যনিষ্ঠ ভারতবাসীই স্বীকার করিবেন। শ্রীযুক্ত সীতারামাইয়া রচিত কংগ্রেসের সরকারী ইতিহাস তাহা করে নাই, যথা―

 In the history of the struggle for Indian Independence Bengal occupies a unique position among the provinces of India. It has not only played a prominent role in strengthening the foundations of the Indian National Congress but has always made the most valuable contribution towards the fight for the emancipation of the country. The people of this country may rightly be called the inspirers of the rational movement in India (Durlab Singh The Rebel President P 37)

 কিন্তু আরও একজন পণ্ডিত ও চিন্তাশীল অ-বাঙালী লেখক বাংলা ও বাঙালীর সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন তাহাও হয় ত’ নিতান্ত মিথ্যা নহে―

 This province on the extreme eastern fringe of India has been a problem child. It has a keen resemblance to Catalonia, that hotbed of extremists in Spain for ever trying to break away from the rest of the country and at the same time trying to assimilate it.. One thing however is clear—It has the separatist and rebellious spirit which has inspired Catalonia. And it is essentially paradoxical. For Bengal, like Catalonia, likes and dislikes the rest of the country. It wants to win it over and yet has often broken loose from it.’ (Hiralal Seth Subhas C Bose. P 17.)

 উপরি-উদ্ধৃত উক্তিতে বাঙালী সম্বন্ধে যে দুইটি মন্তব্য আছে, সে দুইটিই গুরুতর; একটি তাহার শাক্ত মনোবৃত্তি, বা উগ্র, চরমপন্থী প্রকৃতির কথা―লেখক এই অর্থেই বাঙালীকে ‘extremist’ বলিয়া থাকিবেন। কথাটা মিথ্যা নহে;―কারণ, বাঙালী যেমন ভাবুক তেমনি ভাবপ্রবণ, ভাবকে বা তত্ত্বকে সে জীবনের তথ্যরূপে সাক্ষাৎ করিতে চায়। ইহাই তাহার তান্ত্রিকতা, এ বিষয়ে ফরাসী জাতির সহিত তাহার কথঞ্চিৎ সাদৃশ্য আছে। দ্বিতীয় মন্তব্যটি আরও গুরুতর এবং একজন অ- বাঙালীর বলিয়া মূল্যবান। ঐ যে ‘separatist and rebellious spirit’ —উহা ভারতের অপর জাতিসকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে, এবং―ভাবনারও কারণ হইয়াছে; তাই কি বাঙালীর প্রতি অ-বাঙালী কংগ্রেসের মমতা প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে? ঐ স্বাতন্ত্র্য-বোধ বাঙালী জাতির জন্মগত, ইহার কারণ অবশ্যই আছে; কিন্তু সেজন্য পূর্ব্ব-ইতিহাসে কোনরূপ সমস্যার উদ্ভব হয় নাই, আজ হইয়াছে। পুর্ব্বে, বাঙালী তাহার ধর্ম্মগত স্বাতন্ত্র্য বা স্বেচ্ছাচারের জন্য যতই অশ্রদ্ধাভাজন হউক,তাহাতে কাহারও ক্ষতি ছিল না, তখন সে তাহার সেই স্বাতন্ত্রধর্ম্মকে রাজনীতির বাহন করিয়া সারাভারতকে অনুগামী করিবার দুরাশা পোষণ করিত না। ইহাও সত্য যে, অবশিষ্ট ভারতের অভ্যস্ত সংস্কার ও মনোবৃত্তি সম্বন্ধে তাহার একটা প্রতিকূল মনোভাব আছে, তাই সেই ভারতের আধুনিক আচার ব্যবহারকে সে শ্রদ্ধা করে না; কিন্তু প্রাচীন ভারত―সেই গীতা, মহাভারত, সাংখ্য, বেদান্তের ভারতকে সে আপনার ভাবে আত্মসাৎ করিয়াছে, সেই ভারতের গৌরবে সে আত্মহারা। তাই আজিকার ভারতকেও সে অপর এক কারণে বুকে জড়াইয়া ধরিতে চায়। এই বিরাগ ও অনুরাগ দু-ই সত্য। কিন্তু আজ এমন এক বাঙালীর অভ্যুদয় হইয়াছে, যাহার বাঙালীত্বের বিশাল বক্ষে সর্ব্ব-ভারত আলিঙ্গিত হইয়াছে; যে বাঙালী হইয়াও আর বাঙালী নয়―বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারতকে এক দেহে পরিণত করিয়া সে তাহারই প্রাণরূপে স্পন্দিত হইতেছে! তাই আশা হয়, নেতাজী সুভাষচন্দ্রেরই জয় হইবে, তাঁহার সেই মহাজাতি-প্রেম সমগ্র ভারতকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনরুত্থিত করিবে।

যত্র যোগেশ্বর: কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুৰ্দ্ধরঃ।
 তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতি ধ্রুর্বা নীতির্ম্মতির্ম্মম॥

জয়তু নেতাজী!

বাগনান, বি-এন্-আর,

১১ই, অগ্রহায়ণ, ১৩৫৩ ৷

  1. লেখকের ‘বঙ্কিম-বরণ’ গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।