জয়তু নেতাজী (১৯৫০)/নেতাজীর জন্মদিনে

নেতাজীর জন্ম-দিনে

[ ১৩৫৫ ]

 এবার নেতাজীর জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশে―অন্ততঃ শহর অঞ্চলে―বেশ একটু সাড়া পড়িয়াছে, যেন একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। চাঞ্চল্যের কারণ অবশ্য ইহা নয় যে, লোকে এবার নেতাজীকে বেশি করিয়া স্মরণ করিতেছে; কারণ নেতাজীর প্রতি সমগ্র দেশের যে ভক্তি ও ভালবাসা, তাহাতে আর জোয়ার-ভাঁটা নাই, হৃদয়ের অন্তস্তলে একই ভাবে বহিতেছে; হয় তো পূর্ব্বাপেক্ষা আরও অন্তঃসলিলা হইয়াছে। অতএব কারণটা যতদূর দেখা যাইতেছে তাহা এই যে, দেশের গবর্ণমেণ্ট বা কংগ্রেসের পক্ষ হইতে এবিষয়ে বিশেষ আগ্রহ বা উৎসাহ দেখা যাইতেছে না; বরং তাঁহাদের আচরণ এমনই যে, মনে হয়, নেতাজী সম্পর্কে কোনরূপ উৎসব-অনুষ্ঠানের তাঁহারা পক্ষপাতী নহেন। এই কারণেই দেশে এবার যেন একটু চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে।

 কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে, এই অভিমান বা বিক্ষোভ অকারণ বলিয়াই মনে হইবে। ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতাজীর সেই মন্ত্র বা আদর্শ, এবং তাঁহার সেই নীতি সম্পূর্ণ বর্জ্জিত হইয়াছিল; এমন কি, যে-নীতির অনুসরণে এই স্বাধীনতা-লাভ হইয়াছে তাহা নেতাজীর সেই মন্ত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী; এতই বিরোধী, যে নেতাজীকে কোনরূপ সম্মান করিলে এই স্বাধীনতাকেই অসম্মান করা হয়। এইজন্যই নূতন ভারত-সরকার নেতাজীর সম্বন্ধে কঠোর নীরবতা রক্ষা করাই সমীচীন মনে করিয়াছেন। এই কারণটি বুঝিয়া দেখিলে জনগণের ঐ অভিমান অর্থহীন হইয়া পড়ে।

 কিন্তু জন-মন কোনরূপ চিন্তা করে না, কেবল ভাবাবেগের বশীভূত হয়; তাই অতিশয় স্ব-বিরোধী মনোভাব―সম্পূর্ণ বিপরীত আকাঙ্ক্ষাও তাহারা একই কালে পোষণ করে। একথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, আজিকার এই স্বাধীনতা, এবং সেই স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠাতা যে গবর্ণমেণ্ট, উভয়কেই দেশের প্রায় সকল মানুষই ভক্তিভরে বরণ করিয়াছে, এবং যাঁহার এই গবর্ণমেণ্টের কর্ণধার তাঁহারাও জনগণের অসীম শ্রদ্ধা অর্জ্জন করিয়াছেন। যদি ইহা সত্য হয়, তবে নেতাজীর জন্যও তাহারা এমন অধীর হয় কেন? কারণ অবশ্য আছে, একাধিক কারণ আছে। প্রথম কারণ, তাহাদের অজ্ঞতা। স্বাধীনতা বস্তুটা যে কি, তাহা অনেকেই জানে না―হৃদয়ে তাহার সত্যকার অভাবও অনুভব করে না। স্বাধীনতার বাস্তব-রূপ সম্বন্ধে তাহাদের কোন ধারণাই নাই―সে একটা ভাব-কল্পনার বস্তু। যখন তাহা ছিল না, তখন কেবল ঐ ‘নাই’-ভাবটার আবেগে তাহারা অনেক হুড়াহুড়ি করিয়াছে―‘কি নাই’ তাহা বুঝিবার আবশ্যক হয় নাই; কেবল ‘তাহা নাই’ এইরূপ একটা ভাবের আবেগই যথেষ্ট ছিল। আবার যখন, ‘তাহা পাইয়াছি’ এই ভাবের আবেগটা অনুভব করিবার একটা উপায় বা উপলক্ষ্য হইল, তখন তাহাতেই জনগণ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল―‘কি পাইয়াছি’ সে জিজ্ঞাসা তাহারা করে না। ইহাই মূল কারণ―অর্থাৎ, স্বাধীনতা কাহাকে বলে, সে বিষয়ে নিদারুণ অজ্ঞতা। এইজন্য তাহারা ‘নেতা’-দিগকেই জানে ও মানে―অন্ধভাবেই তাঁহাদের অনুসরণ করে; সবচেয়ে যে দল বড় তাহারই আনুগত্য করে। অর্থাৎ সত্যকার রাজনৈতিক চেতনা এ জাতির এখনও হয় নাই; সেই পুরাতন ধর্ম্মভাব, অর্থাৎ অন্ধভক্তিই তাহাদের একমাত্র সম্বল। রাজনৈতিক সংগ্রামেও ধর্ম্মগুরু এবং অন্ধভক্তি এই দুইয়ের বিষময় ফল ফলিতে আরম্ভ করিয়াছে,―বুদ্ধি, বিচার চিন্তা ও জ্ঞানকে সম্পূর্ণ নির্ব্বাসিত করিয়াই জনগণকে ষে এক-নেতৃত্বের বন্ধনপাশে বদ্ধ করা হইয়াছিল, সেই বন্ধনই এখন স্বাধীনতারও বন্ধন হইয়া উঠিয়াছে। এ জাতি স্বাধীন হয় নাই―হয় নাই যে, সে জ্ঞানও নাই, কারণ, স্বাধীনতা যে কি বস্তু তাহাই জানে না।

 দ্বিতীয় কারণ, নেতাজীর ব্যক্তি-মহিমা―তাঁহার বীর-কীর্ত্তি ও অপূর্ব্ব আত্মোৎসর্গই তাহাদিগকে ভাবাকুল করিয়াছে; নেতাজীর সেই আদর্শ বা মন্ত্র―তাঁহার সেই ব্রত―তাহারা এখনও ভালো করিয়া অবধারণ করিতে পারে নাই। যাহাতে সিদ্ধিলাভের জন্য তিনি সেই অমানুষিক তপশ্চরণ করিয়াছিলেন তাহা না বুঝিয়া, কেবল তাহারা তাঁহাকেই দেখিয়াছে, সেই কীর্ত্তিকলাপের রশ্মিচ্ছটায় তাঁহার মূল ব্রতটি আচ্ছন্ন হইয়া আছে। জনগণ যদি তাঁহার সেই মন্ত্র এবং সেই ব্রতটিকে বুঝিতে পারিত, তবে আজিকার এই স্বাধীনতালাভে তাহারা কৃতার্থ হইত না: কারণ, তাহা হইলে ইহাও বুঝিতে পারিত যে, এইরূপ স্বাধীনতাকেই নেতাজী বড় ভয় করিয়াছিলেন। এই কথা যাহারা এখনও বুঝে নাই, যাহারা কেবল তাঁহার আত্মোৎসর্গের সেই দিব্যাবদান দেখিয়া হৃদয়ের ভাবাবেগ সম্বরণ করিতে পারে না, তাহারাই আজ এইরূপ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে; কিন্তু তাহারাই আবার,―যে মহা-বিপদ নিৰারণ করিবার জন্য নেতাজী প্রাণান্তিক প্রয়াস করিয়াছিলেন,― সেই বিপদকেই মহাসম্পদ মনে করিয়া কৃতার্থ হইয়াছে। ইহার মত পরিহাস আর কি হইতে পারে?

 আজ পণ্ডিত জবাহরলাল নেহেরুই ভারতের রাষ্ট্রনেতা,―সেই এক ব্যক্তির পদতলে সমগ্র ভারত ভক্তিবিহ্বল হইয়া লুটাইতেছে। কিন্তু এই নেহেরুই ছিলেন সুভাষচন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী; প্রতিদ্বন্দ্বী বলিলে সুভাষচন্দ্রকে ছােট করা হয়, রাজনৈতিক দলাদলির কথাই মনে হয়। কিন্তু সুভাষচন্দ্র কোন দলের মানুষ ছিলেন না; সকল দলের উপরে যাহা, সেই সত্য―অর্থাৎ ভারতের প্রকৃত মুক্তিই ছিল তাঁহার লক্ষ্য। অতএব পণ্ডিত জবাহরলাল যদি তাঁহার প্রতিদ্বন্দ্বীই হন, তবে বুঝিতে হইবে, সুভাষচন্দ্রের সেই মুক্তি-সংগ্রামে তিনি ছিলেন―বিপক্ষ বা প্রতিবাদী। আজ জবাহরলালই জয়ী হইয়াছেন, ভাগ্যদেবতা তাঁহাকেই জয়মাল্য পরাইয়াছেন; তাই একজনের অসীম দুঃখ, দুশ্চর তপস্যা, আজীবন আত্মত্যাগ ব্যর্থ হইয়াছে, আর, সেই তপস্যার তুলনায় যাহাকে সুকোমল সুখশয্যা বলা যাইতে পারে,―যে পন্থাকে নিরাপদ সুবিধাবাদ বলা যাইতে পারে,―সেই পন্থায় শেষে বৈঠকী আলাপ-আলােচনার সুখকর ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে স্বাধীনতা লাত হইয়াছে, সেই স্বাধীনতার রাজ-গৌরব ও রাজ্যসুখ ভােগ করিতেছে আরেক জন। সেইজন যদি নিজেও সুভাষচক্রের নাম উচ্চারণ না করে, প্রজাসাধারণকেও করিতে না দেয়, তবে তাহাতে আশ্চর্য হইবার কি আছে? এই অভিযােগ যে তাহারা করে, তাহাতেই প্রমাণ হয়, তাহারা সুভাষচন্দ্রকে তাঁহার ব্যক্তিগত মহত্ত্বের জন্যই পূজা করে, তাঁহার সেই ব্রত ও সাধন-মন্ত্র তাহারা বুঝে না; বুঝিলে, তাহারা এমন অবুঝের মত আক্ষেপ করিত না।

 কিন্তু না-বােঝা বরং ভালাে, ভুল-বােঝা আরও অনিষ্টকর। আমরা জানি, জনগণকে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা হইয়াছে―সে চেষ্টা কতক পরিমাণে সফলও হইয়াছে। একবার, আজাদ-হিন্দ-ফৌজের বন্দী সেনানায়কদের পক্ষ অবলম্বন করিয়া জনগণকে বুঝানো হইয়াছিল―যেন সুভাষের আদর্শ ও তাহাদের আদর্শে কোন পার্থক্য নাই, এমন কি, নেতাজীর সেই আজাদ-হিন্দ-ফৌজ ভারতের মুক্তিসংগ্রামের আদর্শ সেনা। পরে তাহা অস্বীকার করা হইয়াছে; তাহাতে মনে হয়, সে ছিল একটা সাময়িক প্রয়ােজনসিদ্ধি। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর, আজাদ-হিন্দ-ফৌজের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করা হইয়াছে তাহা ভাবিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। সেই আজাদীফৌজের বিরুদ্ধেই, ব্রিটিশ গবর্নমেণ্টের বেতনভুক, ব্রিটিশভক্ত অর্থাৎ দেশদ্রোহী যে সৈন্য ও সেনানায়কেরা যুদ্ধ করিয়াছিল, স্বাধীন ভারত তাহাদিগকেই মাথায় করিয়া লইয়াছে, এবং আজাদ-হিন্দ-ফৌজকে সর্ব্বপ্রকারে অপমানিত করিয়াছে। ঐ একটি কার্য্যের দ্বারাই তাহারা নেতাজীকেও ভারতের রাষ্ট্র-জীবন হইতে বহিস্কৃত করিয়াছে।

 আর একটা ভুল-বিশ্বাস এখনও জনগণের মনে দৃঢ়মূল হইয়া আছে, তাহা এই যে, যেহেতু নেতাজী সুভাষচন্দ্র কথনও গান্ধীজির প্রতি শ্রদ্ধাহীন হন নাই, অতএব নেতাজী গান্ধী-মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন―তাঁহার পন্থা স্বতন্ত্র হইলেও গান্ধীই তাঁহার গুরু ছিলেন, এবং ঐ কংগ্রেসেরই তিনি অনুগত সেবক। এজন্য ঐ কংগ্রেসের প্রতি ভক্তি এবং নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধা, এই দুইয়ের মধ্যে কোন বিরোধ নাই। এই বিশ্বাস এমনই সহজ ও সুলভ যে, জনগণকে নিশ্চিন্ত করিবার ইহাই একটা বড় উপায় হইয়াছে। এইরূপ বিশ্বাস জন্মাইবার পক্ষে অনেক সুবিধাও আছে। দেশের যাবতীয় পত্র-পত্রিকায়এমন কি, নেতাজীর সম্পর্কে যত পুস্তক লিখিত হইয়াছে, তাহার অধিকাংশে (বিশেষতঃ বাংলা পুস্তক গুলিতে) সবচেয়ে বড় কথাটাই চাপা দেওয়া হইয়াছে―গান্ধী-কংগ্রেসের সহিত সুভাষচন্দ্রের সেই মূলগত বিরোধ, যে বিরােধের চূড়ান্ত প্রকাশ হইয়াছিল ত্রিপুরীতে। ঐ ত্রিপুরীর পর, সুভাষচন্দ্রের সহিত গান্ধী-কংগ্রেসের ষে আর কোন সন্ধি হয় নাই,―সেই যুদ্ধই ক্রমে নির্ম্মম ও কঠিন হইয়া উঠিয়াছিল বলিয়া সুভাষচন্দ্রকে দেশত্যাগ করিতে হইয়াছিল, এবং সেই বিরোধ যে শুধুই পন্থাগত বিরোধ নয়―মূলমন্ত্র বা আদর্শগত বিরোধ, ইহা কাহাকেও বুঝিবার অবকাশ দেওয়া হয় নাই। গান্ধীজির প্রতি সুভাষচন্দ্রের যে ভক্তি তাহা যে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত, তাহার কারণও ভিন্ন—সে সংবাদ কেহ রাখে না। কিন্তু এইরূপ সাক্ষ্য-প্রমাণও নিম্প্রয়োজন; সুভাষচন্দ্র যে প্রথম হইতেই গান্ধীনীতির বিরোধী ছিলেন, এবং শেষে, কেবল ব্রিটিশ গবর্ণমেণ্টই নয়, ঐ গান্ধী-কংগ্রেসও তাঁহার প্রতিপক্ষ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, একথা যাহারা বুঝে না বা স্বীকার করে না, তাহারা সুভাষচন্দ্র সম্বন্ধে কোন কথাই বলিবার যোগ্য নহে। কারণ, যাহারা সুভাষচন্দ্রের ঐরূপ পরিচয় দেয় তাহারা তাঁহার সত্যটাকেই মিথ্যা করিয়া তোলে; গান্ধীবাদ ও গান্ধী-কংগ্রেসের প্রতি যাহাদের আন্তরিক আস্থা আছে, তাহারা সুভাষচন্দ্রের প্রতি কপট শ্রদ্ধাই নিবেদন করিতে পারে। যাহারা তাঁহার সেই মন্ত্র ও সেই পন্থাকে ভ্রান্ত ও অশুচি আখ্যা দিয়া, তাঁহার ত্যাগ ও বীরত্বের প্রশংসা করে―তাহারা কেবল দায়ে পড়িয়াই ঐটুকু স্বীকার করে, সত্যকার শ্রদ্ধা তাহাদের নাই। কারণ, সুভাষচন্দ্র কেবল একটা ব্যক্তি নয়, কোন একটা মতের প্রচারক মাত্র নহেন,―তাঁহার সমগ্র জীবন, তাঁহার দেহ, মন এবং আত্মা―সকলই একটা অখণ্ড সত্যের পূর্ণাঙ্গ অভিব্যক্তি; সত্য বলিয়াই তাহাকে খণ্ডিত করা যায় না। ঐরূপ পৃথক করিয়া দেখিলে সেই পুরুষকে অপমাণ করাই হয়।

 কিন্তু নেতাজীর আদর্শ, তাঁহার সেই মহান চরিত্র এবং অতুলনীয় আত্মোৎসর্গ, এ সকল স্বীকার করিলেও―অনেকে বাধ্য হইয়া তাহা করেন,―তথাপি, ভারতের স্বাধীনতা-লাভে তাহা কতটুকু কার্য্যকরী হইয়াছে?

 এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে দুরূহ, কারণ, ভারত যে কিরূপ স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে, তাহাই এখনও সন্দেহস্থল। তথাপি আমি এমন ছুইজনের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি, যাঁহাদের একজন সুভাষ পক্ষীয়, আর একজন কোন পক্ষেরই নহেন। সুভাষ-পক্ষীয় যিনি তাঁহার কথাই প্রথমে শোনা যাক, কারণ এ প্রশ্নের জবাব দিবার ন্যায়সঙ্গত অধিকারী তিনিই। গান্ধীবাদী কংগ্রেসপন্থী যাঁহারা তাঁহারাই ঐ স্বাধীনতালাভকে কংগ্রেসের যুদ্ধজয় বলিয়া গৌরব করেন―সুভাষচন্দ্রকে, সেই যুদ্ধে সাহায্যকারী তো নহেই―বরং বিপক্ষতাচরণকারী বলিয়াই উল্লেখ করিয়া থাকেন। অতএব এ প্রশ্নের উত্তরে অপর পক্ষ কি বলেন, তাহা শুনিতে হইবে বৈকি। সেই জবাব সকলেই শুনিয়াছেন—এমন কি, সুভাষচন্ত্রকে মুখে প্রশংসা করিবার প্রয়োজন হইলে, কংগ্রেসী নেতাদেরও কেহ কেহ অত্যন্ত অস্পষ্ট ভাবে, এ বিষয়ে সুভাষচন্দ্রের কিঞ্চিৎ কৃতিত্ব স্বীকার করেন। তথাপি, আমি আজ এই উপলক্ষ্যে সেই পুরাণো কথাটাই আর একবার স্পষ্ট করিয়া তুলিব, তাহার জন্য, আজই হাতের কাছে যাহা পাইলাম তাহাই তুলিয়া দিলাম। আজাদ-ছিল গভর্ণমেণ্টের ভূতপূর্ব্ব মন্ত্রী শ্রীযুক্ত এ, এন্, সরকার অন্যকার তারিখের ‘হিন্দুস্থান ষ্ট্যাণ্ডার্ড’ পত্রিকায় লিখিতেছেন―

 “Again I would ask: Did the struggle end in failure? History will record its verdict on it. It is common knowledge that the whole structure of India shook to its bottom when the reverberations of the deeds of the epic struggle reached the country. The British diplomats saw that the army which was the last reed to depend on was infected with the virus of freedom and felt that the citadel of Imperialism was toppling down and their ground was slipping from under their feet. Discretion being better part of valour, the Britishers while maintaining economic interests, the vested interests of two centuries, decided to part with the Indian possession geographically. It was a bloodless victory forsooth, a victory of Ahimsa!”

 আমি ইহার অনুবাদ দিলাম না, তার কারণ, ইহার পরে আমি আরেক জনের যে উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি তাহাও ইংরাজীর অনুবাদ; সেই উক্তি আরও বিস্তারিত হইলেও, ভাবে-অর্থে একেবারে হুবহু সমান―মনে হয়, একজন আরেক জনের কথাই যেন পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। পরবর্ত্তী কথাগুলি অধ্যাপক বিনয়কুমার সরকার মহাশয়ের একটি ইংরেজী নিবন্ধ হইতে সংকলিত হইয়াছে—নাম, “Formless Bengal and the Fluid Bengali.”-এ প্রবন্ধ কিছু আগে লেখা। তিনিও লিখিতেছেন―

 “দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তান এই যে দুইটি নূতন ‘ডোমিনিয়ন’ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে ইহাও অনেক পরিমাণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সুভাষ বসুর সেই যুদ্ধঘোষণার―সেই প্রচও ধাক্কারই একটা বিপরীত ফল। বিপ্লবী ভারতের হিন্দু ও মুসলিম, অ-বাঙালী— পাঞ্জাবী, মারাঠী, মাদ্রাজী―মিলিত সেনার সাহায্যেই, নেতাজী ঐ যুদ্ধ চালাইয়াছিলেন; বস্তুতঃ সুভাবচন্দ্রের ঐ সেনাকে প্রধানতঃ—এমন কি, প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম-সেনা বলিলেও হয়। হিন্দু সুভাষের এই সাফল্য-দর্শনে ব্রিটিশের হৃৎকম্প হইবারই কথা। এ সম্ভাবনা তাহাদের মনে একবারও জাগে নাই। তাছাড়া, ভারতের ঐ জাতীয়-সেনা গঠিত হইয়াছিল―কয়েক হাজার সুশিক্ষিত ভূতপূর্ব্ব বৃটিশ ভৃত্য, অ-বাঙালী সৈন্য ও সেনানায়ক লইয়া; মাত্র কয়েক জন বিদ্বান-বাঙালী ও ডাক্তার-বাঙালীকে ভলাণ্টিয়ার বা সদ্য-সংগৃহীত সৈন্যরূপে পাওয়া গিয়াছিল। বাঙালীর এই সৃজনী-শক্তি ও সংগঠনী প্রতিভা, এৰং বাঙালীর দুর্জ্জয় চিৎ-শক্তির এইরূপ চাক্ষুষ প্রমাণে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজনীতি-ধুরন্ধরগণের বুঝিতে বাকি রহিল না যে, তাহাদের ভারতীয় সেনার অ-বাঙালী যোদ্ধা ও সেনানায়কদের বাহ্যিক প্রভুভক্তির উপৱে নির্ভর করা আর চলিবে না। তাহারা স্পষ্টই দেখিতে পাইল, তাহাদের বড় সাধের সেই ভারতীয় সেন একরূপ ফৌত হইয়া গিয়াছে; এবং অমন যে বিশ্বন্ত মুসলিমগণ তাহারাও আর ব্রিটিশ-রাজের আনুগত্য করিবে না। তখন সেই মহাধুর্ত্ত সাম্রাজ্যনীতিবিদ্ ব্রিটিশ কর্ত্তৃপক্ষ ৱাতারাতি তাহাদের পন্থা পরিবর্ত্তন করিল, এবং সুভাষ বসুর আজাদ-হিন্দ-ফৌজের বিরুদ্ধে মামলা তুলিয়া লইয়া, ভারতবাসীকে ডোমিনিয়নতুল্য স্বাধীনতা-দানের প্রস্তাৰ করিল।.. ...

 “ঐ দুইটী ডোমিনিয়নের প্রতিষ্ঠা ব্রিটিশের সাম্রাজ্য-নীতির পক্ষে বড়ই প্রয়োজনীয় হইয়াছিল; উহার ফলে, তৃতীয় মহাযুদ্ধ উপস্থিত হইলে, দক্ষিণ এশিয়ার শত্রুভাব-বর্জ্জিত এত বড় একটা ভূভাগের সুযোগে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্য নির্ব্বিঘ্নে তাহার কাজ চালাইতে পারিবে।[] এই স্বাধীনতা-দান―বৃটিশের আত্মরক্ষার কুট-কৌশল-নীতি, তাহার যন্ত্রবিদ্যামূলক শিল্পী-নীতি, এবং স্থল-জল-আকাশ-পথে সাম্রাজ্যরক্ষণনীতি―এই সকলের সহিত সামঞ্জস্য করিয়াই পরিকল্পিত হইয়াছে। এই যে ভারতবাসীকে ডোমিনিয়ন-তুল্য স্বাধীনতা-দান―ইহা ব্রিটিশের পক্ষে একরূপ আপদ্ধর্ম্ম-পালন; উহার দ্বারা একদিকে যেমন বৃটিশসাম্রাজ্যকে জগতের চক্ষে ন্যায়বান দেখানো হইয়াছে, তেমনই উহার ভিত্তিও দৃঢ়তর করা হইয়াছে।”

 আগের উক্তিটি ও এই উক্তিটিতে কোন প্রভেদ নাই; তবু একটা কথা এখানে তেমন স্পষ্ট করিয়া উল্লেখ করা হয় নাই―প্রথমটিতে তাহা একটু শ্লেষ সহকারে করা হইয়াছে, যথা―“It was a bloodless victory for sooth, a victory of Ahimsa!” অর্থাৎ, “এই যে জয়লাভ (ইংরাজের নিকটে স্বাধীনতা-লাভ) ইহা বিনা রক্তপাতেই হইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ কি? অহিংসার জয়লাভই বটে!” এ সম্বন্ধে অধ্যাপক সরকার অন্যত্র যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিতে সাহস হয় না, তথাপি করিলাম। এ কথাগুলিও ইংরাজীর অনুবাদ, তবে আমাদের নহে।[] ‘কলিকাতা রিভিউ’ পত্রিকার ‘গান্ধী-স্মৃতি’-সংখ্যার মূল প্রবন্ধটি প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহাতে লেখক বলিতেছেন—

 “যদি কাহাকেও অ-গান্ধী বা গান্ধী-বিরোধী বলিতে হয় তৰে সন্ত্রাসবাদীকেই ঐরূপ বলিতে হইবে। সেইজন্ত ১৯৩১ সালে লণ্ডনের গোলটেবিল-বৈঠকে বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী ও অন্যান্য সকলের নিকট গান্ধী ভারতীয় সন্ত্রাসবাদের সম্পর্কে অনেক কিছু বাতলাইয়াছিলেন।... গান্ধী বলেন, ‘যদি তুমি কংগ্রেসকে সমর্থন কর, এবং কংগ্রেসের দ্বারা কোন কাজ করাইতে চাও, তবেই তুমি সন্ত্রাসবাদকে বিদায় দিতে পরিবে। অধিকন্তু তোমার পক্ষে গবর্ণমেণ্টের মারফৎ সস্ত্রাসযন্ত্র (পুলিস-পলটন ইত্যাদি) ব্যবহার করিবার দরকার হইবে না।’... ...গান্ধীর প্রস্তাব তবে কি ছিল? উত্তর অতি সোজা। তিনি প্রকারান্তরে ঠিক যেন নিম্নলিখিত কথাগুলি বলিতে চাহিয়াছিলেন―  যদি তোমরা আমার কথা অনুসারে কাজ কর তাহা হইলে সন্ত্রাসবাদীরা দেশ দখল করিয়া বসিবে, এবং আমি যাহা কিছু চাই তাহার সব কিছুই তাহাদের নিজ কার্য্যপ্রণালী অনুসারে ঘটাইয়া ছাড়িবে। গান্ধীর নিজ মুখের কথা এইরূপ―

 ‘তোমরা কি চোখ খুলিয়া দেখিবে না―সন্ত্রাসবাদীরা তাহাদের রক্ত দিয়া কি লিখিতেছে?•••স্বাধীনতা না পাইলে আমাদের মধ্যে এমন হাজার হাজার লোক আছে যাহারা নিজদিগকে শান্তি দিবে না, দেশকেও শান্তি দিবে না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে।’

 অহিংসার অবতার গান্ধী ঐ চরমপত্র অতি নিপুণভাবেই খাড়া করিয়াছিলেন। উহা দ্বারা হিংসা বা সন্ত্রাসের স্বপক্ষে যেরূপ বিশ্বব্যাপী ও কার্য্যকরী বেতার-প্রচার সাধিত হইল, এমন আর কোনো কিছুতেই হইত না।”

 অধ্যাপক সরকারের ঐ কথাগুলির অর্থ এই যে, মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশকে ঐ হিংসার ভয় দেখাইয়াই তাহাকে তাঁহার বাধ্য করিবার চেষ্টা করিতেন। কিন্তু ইংরাজ তো শিশু নয় যে, ঐরূপ জুজু দেখিয়া ভয় পাইবে। সে যে অহিংসাকে কিছু মাত্র গ্রাহ্য করে না তাহা আমরাও যেমন দেখিয়াছি, গান্ধীজিও তাহা বার বার দেখিয়াছিলেন। তাঁহার একমাত্র আশা ছিল, যদি ঐ জুজু সত্যই বাঘ হইয়া উঠে, তাহা হইলেই তাঁহার কার্য্যসিদ্ধি হইবে―কারণ অহিংসাকে ইংরাজ বিশ্বাস করে না, হিংসাকে করে। অতএব গান্ধী-পন্থা অর্থে অহিংসার পন্থা নয়―উহা হিংসাপন্থীদের দিয়াই কার্য্যোদ্ধার করিয়া অহিংসার জয় ঘোষণা করা। হইয়াছিলও তাহাই। ব্রিটিশ যদি বা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে কোন রকমে শেষ পর্যন্ত খাড়া থাকিবার আশা করিতেছিল―তথাপি, সর্ব্বশেষে সুভাষচন্দ্রের ঐ আজাদী-ফৌজের সমগ্র কাহিনী জানিয়া, এবং গান্ধীজীর সেই ভীতিপ্রদর্শন স্মরণ করিয়া, ঐ স্বাধীনতা দান করিতে রাজী হইল। ইহা যদি সত্য হয়, তৰে দুইটা কথাই স্বীকার করিতে হইবে; প্রথম,―এই স্বাধীনতা-সংগ্রামে সত্যকার অস্ত্র অহিংসা নহে―হিংসাই; এবং দ্বিতীয়তঃ, এই সংগ্রামে প্রথম হইতেই গান্ধীজীর রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল―কাপুরুষ, মৃত্যুভয়-ভীত, এবং সন্ন্যাসী-ফকির-ভক্ত ভারতকে একটা বিশেষ দলের শাসনাধিকারে সমর্পণ। তাহাতে তাঁহার কি লাভ?―সে প্রশ্নের উত্তর এখনও দিবার সময় হয় নাই! তিনি তখন একটা বড় প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন—ঐ বিপ্লবীদলকে নেতৃত্বচ্যুত করা। তাই ভারতের বিপ্লবী দল ও ইংরাজের মাঝখানে পড়িয়া, ইংরাজের স্বার্থ যতদূর সম্ভব বজায় রাখিয়া, তাহার সহিত একটা লেন-দেনের সম্পর্ক করিয়া, যেটুকু সুবিধা বা অধিকার বাজার-দর অনুসারেই প্রাপ্য, তাহাই আদায় কবিয়া তিনি নিরস্ত হইয়াছিলেন। অহিংসা-অস্ত্রের দ্বারা তিনি জনগণকে বশীভূত করিয়াছিলেন, এবং ইংরাজকে হিংসার ভয় দেখাইয়া, তাঁহার ঐ অহিংসা তাহদের পক্ষে কিরূপ সুবিধাজনক―কতটা মন্দের ভালো―তাহাই ক্রমাগত বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে কিন্তু তাহা বুঝিবে না, তিনিও ছাড়িবেন না। ভারত যে এখনও পূর্ণ স্বাধীনতালাভের যোগ্য হয় নাই, তিনি ইহাই বিশ্বাস করিতেন। তাই ব্রিটিশসম্পর্ক-বর্জ্জিত স্বাধীনতাকে তিনি ভয় করিতেন; এবং এইজন্যই সুভাষচন্দ্রের ঐ নীতি ও কর্ম্ম-পদ্ধতি আদৌ সহ্য করিতেন না। ভারতশাসন-কার্য্যে যেটুকু কর্তৃত্ত্বের প্রয়োজন―তাঁহার, স্বকীয় উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য আবশ্যক―তাহাই যথেষ্ট। সুভাষচন্দ্র তাহাতেই সন্তুষ্ট নহেন। এইখানেই আসল বিরোধ। কিন্তু সুভাষকে বা সুভাষের ঐ সহিংস উপদ্রবকেও তাঁহার প্রয়োজন ছিল―ব্রিটিশকে ভয় দেখাইয়া তাঁহার সহিত একটা রফা করাইবার জন্য। পরে তাহাই বড় কাজে লাগিয়াছিল। অধ্যাপক বিনয় সরকার মহাশয় এই কথাটাই বলিতে চাহিয়াছেন। গান্ধীজী তাঁহার অহিংসাকেই অর্থাৎ শান্তি-পন্থাকেই জয়যুক্ত করিবার জন্য হিংসার সাহায্য লইতে কিছুমাত্র অনিচ্ছুক ছিলেন না; কেবল, সেই হিংসার অস্ত্র তিনি নিজে স্পর্শ করিবেন না। বৱং―“গান্ধীর হিংসাবাদী সহকর্ম্মীরা যে পাপ করিত তাহার প্রায়শ্চিত্বের উপায়-স্বরূপ গান্ধীর ‘অহিংসা’ ব্যবহার করা সম্ভবপর ও সুবিধাজনক ছিল। প্রয়োজন হইলে গান্ধী তাঁহার অহিংসা-নীতিকেও শিকায় তুলিয়া রাখিতে কুণ্ঠিত হইতেন না। দৃষ্টাস্তস্বরূপ বলা যায় যে, তিনি ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়’-প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁহার অহিংসানীতিকে ছুটি দিয়াছিলেন।”

 অধ্যাপক সরকার ইহার আরও দৃষ্টান্ত দিয়াছেন, যথা:―

 “১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট তারিখে ভারতীয় ডোমিনিয়ন গঠিত হইলে, গান্ধী হিংসাকেই ভারত-সস্তানের পক্ষে প্রথম স্বীকার্য্য বলিয়া গ্রহণ করিলেন। সৈন্যবাহিনী, নৌবাহিনীও বিমান ৰাহিণীকে নির্ব্বিবাদে ভারতীয় ডোমিনিয়নের অপরিহার্য্য অঙ্গরূপে তিনি গ্রহণ করিয়াছিলেন।”

 “কি বাহ্যিক, কি আভ্যন্তরীণ―সকল ক্ষেত্রেই হিংসার দ্বারা হিংসার প্রতিকার করিতে হইবে, এই তত্ত্ব তিনি তাঁহার অহিংসামন্ত্রের অন্তর্গত করিয়া লইয়াছিলেন।”

 আমরা জানি, গান্ধীভক্তগণ ইহা স্বীকার করিবেন না; বরং ইহার প্রতিবাদে, ঐ স্বাধীনতালাভের পরেও গান্ধীজী অহিংসা-ধর্ম্মের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য কি কঠিন তপস্যা করিয়াছিলেন, এবং তাহাতেই আত্মাহুতি দিয়াছিলেন―ইহাই তাঁহারা উচ্চৈঃস্বরে এবং ক্রুদ্ধকণ্ঠে ঘোষণা করিবেন। আমি ইহারও কোন প্রতিবাদ করিব না। কিন্তু যাঁহাদের একটুও চিন্তা করিবার শক্তি আছে, এবং যাঁহারা একেবারে সংস্কার-বদ্ধ নহেন, তাঁহারাই বুঝিতে পরিবেন, গান্ধী-নীতি গোড়া হইতে শেষ পর্য্যস্ত একটা অতি গূঢ় এবং অতি দৃঢ় দ্বৈত-নীতিই ছিল। অধ্যাপক সরকার তাঁহার ঐ প্রবন্ধের শেষে যাহা বলিয়াছিলেন ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিক সম্ভবতঃ তাহা একেবারে অস্বীকার করিবেন না―তিনি বলিয়াছেন,“গান্ধীকে সকলযুগেরচরম-সফলতা-প্রাপ্ত, বস্তুনিষ্ঠ রাষ্ট্রবীর, বা নং ১-শ্রেণীর রাষ্ট্রিক খেলোয়াড়বলা যাইতে পারে।”

 এই উক্তি সম্বন্ধে একটা বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে―ঐ “সফলতা-প্রাপ্ত”-কথাটিতে। গাছের উপরে উঠিয়া―অতি উর্দ্ধ হইতে পতনের ভয় অগ্রাহ্য করিয়া, সেই গাছের শাখাগ্র-ভাগ সবলে নাড়া দিয়া ফলটি মাটিতে ফেলিয়া দিল যে, সে তাহা পাইল না―পাইল যে, সে কেবল বৃক্ষকাণ্ডে হাত বুলাইতেছিল; ইহাই যদি ‘সফলতা-প্রাপ্তি’ হয়, তবে তাহা সত্য বটে; এমন কি, ‘খেলোয়াড়ি’ও হয়তে মিথ্যা নয়। কিন্তু ঐ ফল এমনই যে, উহা একজন পাড়িবে, আর একজন কুড়াইবে—তাহা হয় না; যে কুড়াইবে তাহাকেই পাড়িতে হইবে। তাই ফলপ্রাপ্তি যদি হইয়াও থাকে―সফলতাপ্রাপ্তি হয় নাই; কিন্তু আমরা ঐ ফলপ্রাপ্তিতেও বিশ্বাস করি না। এতক্ষণ এই যে আলোচনা করিলাম তাহা কেবল ঐ হিংসা ও অহিংসার জয়লাভ―কোনটা কতখানি সত্য, তাহাই দেখাইবার জন্য। যদি ইহাকেও জয়লাভ বলিতে হয়, তবে শ্রীযুক্ত এ, এন, সরকারের সহিত আমরাও বলি–lt was a bloodless victory forsooth, a victory of Ahimsa!”

 না, সুভাষচন্দ্রের জয়লাভ বা সফল-কীর্ত্তি উহাই নয়,―সে কীর্ত্তি অন্যরূপ। স্বাধীনতা কাহাকে বলে, তাহা কেমন করিয়া লাভ করিতে হয়, এবং তজ্জন্ত কোন একটি বস্তুর প্রয়ােজন, তাহাই হাতে-কলমে করিয়া দেখাইয়া তিনি ভারতবাসীর অজ্ঞতা ও অবিশ্বাস দুর করিয়াছেন। দেশের ভিতরে যাহা করিয়া দেখাইবার উপায় ছিল না, তাহাই একটি ক্ষুদ্র অথচ অখণ্ড আকারে সৃষ্টি করিয়া তিনি চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়াছেন; ত্রিপুরীতে যাহা প্রমাণ করিতে পারেন নাই, সিঙ্গাপুরে তাহাই গড়িয়া দিয়াছিলেন। এ কীর্ত্তি এক হিসাবে অমানুষিক বটে; কিন্তু মানুষের আত্মা তো দেবতার চেয়ে বড়, সেই আত্মার পক্ষে কিছুই অসাধ্য নয়। চাই কেবল সেই আত্মারই শ্রেষ্ঠ শক্তি, যাহার নাম―প্রেম। তিনি নিজে সেই প্রেমের বিগ্রহস্বরূপ হইয়া, অগণিত মানুষকে আত্মার বলে বলীয়ান্ করিয়াছিলেন। হাজার হাজার নর-নারীর সে কি আত্মদান। মানুষের আত্মাই যেন আকাশ-স্পর্শী হইয়া উঠিয়াছে―“জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন!” মানুষ তাহার সর্ব্বস্ব দান করিয়াও দানের ক্ষুধা মিটাইতে পারিতেছে না! এমন দৃশ্য ভারতের মধ্যে কেহ কোথাও দেখিয়াছিল? কেন দেখিতে পায় নাই? হায় রে! ইহার নাম হইয়াছে হিংসা! মানুষের আত্মাকে এমন অপমান মানুষেই করে! এত বড় আত্মাহুতির নাম পাপ! ইহারই বিপরীত যাহা, তাহার নাম অহিংসা―এবং তাহাই মহাধর্ম্ম! ধর্ম্মাধর্ম্মের কি সূক্ষ্ম বিচার! হাঁ, ঐ হিংসার পথেই সুভাষচন্দ্র ক্ষুদ্রাকারে একটি ‘স্বাধীন ভারত’ গড়িয়াছিলেন―যে ‘ভারত’ ভাবী ভারতের আদর্শ হইবে। সেই ‘ভারত’কে দ্বিখণ্ডিত করিবার প্রয়ােজন হয় নাই—এবং ‘নেশন’ বলিতে কি বুঝায়, সেই ভারতই তাহা দেখাইয়াছে। সেই নেশন যেমন অখণ্ড-ভারতের নেশন, তেমনই তাহাতে হিন্দু-মুসলমানকে এক করিবার জন্য ধর্ম্মোপদেশ দিতে হয় না, এক পক্ষের সর্ব্বনাশ করিয়া অপর পক্ষের সন্তুষ্টিসাধন করিতে হয় না। অথবা ‘নেশন’নামের ধমক দিয়া জাতি বা প্রদেশ-বিশেষের প্রভূত্ব-প্রতিষ্ঠা করিতে হয় না। এইখানে, একটা কথা প্রসঙ্গক্রমে বলিব। ‘নেশন’ ও ‘স্বাধীনতা’ যদি একই বস্তু হয়, তবে ভারত যে স্বাধীন হয় নাই―তাহার একটা বড় প্রমাণ এই যে, প্রদেশগুলা এখনও পরস্পরে বিবাদ করিতেছে,―এই বিবাদ এমনই সত্য যে, ইহাকে কিছুতেই চাপা দেওয়া যাইবে না। ভারত যদি সত্যই স্বাধীন হইত, তবে সঙ্গে সঙ্গে নেশন-চেতনাও জাগিত; প্রাদেশিক ঈর্ষ্যা এমন প্রকট হইয়া উঠিত না। দাসেরাই ঈর্ষ্যা করে, উহারা আর একটা প্রভু-শক্তির অধীনে দাস হইয়াই আছে। ঐ দাসত্ব―ব্রিটিশ-দাসত্বেরই নামাস্তর।

 কিন্তু যাহা বলিতেছিলাম। অবিশ্বাসীর দল তবু বলিবে―ঐ কীর্ত্তির মূল্য কি? উহা তো নিষ্ফল হইয়াছে, অতএব উহা মিথ্যা। বিশ্বাসীরা বলিবে, উহা সত্য বলিয়াই নিষ্ফল হইতে পারে না―যে সত্য-সফলতা উহাতে নিহিত আছে তাহা আর একটু কালসাপেক্ষ। যে মিথ্যা-সফলতা আজ এমন গৌরবমণ্ডিত হইয়াছে তাহাই চির-মিথ্যায় বিলীন হইবে―ঐ অচির-মিথ্যাই চির-সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইবে। আমি যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা বলিয়াছি, সে বিশ্বাস সুভাষচন্দ্রকে বিশ্বাস নয়। যাহারা মানুষকে বিশ্বাস করে, যাহারা প্রেমকে, ত্যাগকে বিশ্বাস করে, এবং যাহারা ভারতের মুক্তিতে বিশ্বাসী―আমি, তাহাদিগকেই বিশ্বাসী বলিয়ছি। আর, যাহারা সত্যকে, প্রেমকে, ত্যাগকে এবং ভারতের মুক্তিকেও তাহাদের নিজেদের স্বার্থ ও সুখ-সুবিধার মাপে কাটিয়া ছাঁটিয়া লইতে চায়, তাহাদিগকেই অবিশ্বাসী বলিয়াছি। এই অবিশ্বাসীদের নিকটেই সুভাষচন্দ্রের সকল কীর্ত্তিই মূল্যহীন। ইহাদিগকে বুঝাইবার বা বিশ্বাস করাইবার চেষ্টাই নিষ্ফল।

8

 নেতাজীর সেই পন্থা যে ভ্রান্ত ও অকল্যাণকর ছিল, এবং গান্ধীমন্ত্রই যে ভারতকে―শুধুই রাজনৈতিক সঙ্কট নয়,—একটা আধ্যাত্মিক সঙ্কট হইতে রক্ষা করিয়াছে, এমন কথা এখনও প্রচারিত হইতেছে। হয়তো মিথ্যা যতই অপ্রতিষ্ঠ হইয়া উঠে, ততই বৃহত্তর মিথ্যার সৃষ্টি করিতে হয়। গান্ধী-কংগ্রেসের মূর্ত্তি যতই সুপ্রকট হইয়া উঠিতেছে ততই গান্ধী-নীতিকে বাঁচাইয়া ঐ কংগ্রেসকেই ধর্ম্মভ্রষ্ট বলিয়া গালি দেওয়া আবশ্যক হইয়াছে―অর্থাৎ, বিচারটাকে কারণমুখী না করিয়া মোহটাকেই বজায় রাখিতে হইবে। সম্প্রতি একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তিকেও এমন কথা বলিতে দেখিয়া আমরা বিস্মিত হইয়াছি, যে―

 “রক্তাক্ত বিপ্লবকে এড়াইয়া মহাত্মা বৈদেশিক শাসন-পাশ হইতে ভারতবর্ষকে মুক্ত করিয়া যে আত্মিক সর্ব্বনাশের পথ হইতে জাতিকে রক্ষা করিয়াছিলেন, মহাত্মার অভাবে ইঁহারা (কংগ্রেস-নেতাগণ) পথভ্রষ্ট হইয়া সেই সর্ব্বনাশকেই অনিবার্য্য করিয়া তুলিয়াছেন।”

 এই একটি কথার মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনার কার্য্যকারণ-তত্ত্বও যেমন, তেমনই সহজ যুক্তিকেও লঙ্ঘন করা হইয়াছে। যাহা এত শীঘ্র নষ্ট হইয়া যায় তাহার বিনাশ-বীজ কি সেই বস্তুর উৎপত্তির মধ্যেই ছিল না? মহাত্মার মৃত্যু হইবামাত্র যদি তাঁহার শিষ্যেরা পথভ্রষ্ট হইয়া থাকে তবে তাহাদের গুরু-মন্ত্র কেমন ছিল?―তাঁহার নির্দিষ্ট সেই পথ তাঁহার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গেই এমন ফুরাইয়া যায় কেন? পুঁথিগত সত্য ও সাক্ষাৎ গুরুমুখী সত্য এক নয়; পুঁথির সত্য নির্জ্জীব, কিন্তু গুরুর মুখে সেই সত্যই এমন সজীব হইয়া উঠে যে, অন্ততঃ তাঁহার সাক্ষাৎ-শিষ্যগণ সেই সত্যে অনুপ্রাণিত হইবেই। গুরুর জীবদ্দশায় যাহারা তাঁহাকে এত ভক্তি এত মান্য করিয়াছে, গুরুর অন্তর্দ্ধানমাত্রে তাহারাই তাঁহার সেই প্রকাশ্য ও বহুপ্রচারিত মন্ত্রের এমন অন্যথাচরণ করে কেন? শাস্ত্র, ইতিহাস ও মনুষ্য-বুদ্ধির ইহা অগোচর। এ রহস্য এত সহজে পাশ কাটাইবার নয়। আর, ঐ বৈদেশিক শাসন-পাশ হইতে মুক্তির কথা,―সে কেমন মুক্তি, তাহা কি আজিও, অন্ততঃ কিছু-পরিমাণে অনুভূত হইতেছে না? মুক্তি যদি হইয়াই থাকে, তবে তখনই আবার বন্ধনভয় কেন? সে আবার কেমন মুক্তি?―যে-মুক্তিকে লাভ করিয়াই তাহাতে রং-বেরঙের তাপ্পি লাগাইতে হয়; যে-মুক্তি প্রজা-সাধারণকে ভোগ করাইবার পুর্ব্বে, বাহিরে বিপুল আড়ম্বরে ঘোষণা করিতে হয়: জাতির গৃহ-প্রাঙ্গণের পরিবর্ত্তে আন্তর্জ্জাতিক বৈঠকখানায় যাহাকে মহাৰ্ঘ বেশভূষা পরিয়া হাজিরা দিতে হয়;―প্রজার অন্নকষ্ট তুচ্ছ করিয়া কোটি-কোটি টাকা বিলাস-ব্যসনে, নিত্য-নূতন উৎসব-অনুষ্ঠানে অপব্যয় করিতে হয়―নহিলে ঐশ্বর্য্যের ধাঁধা লাগাইয়া জনগণকে ভক্তি-ত্রস্ত করা যায় না; যে-মুক্তিকে হারাইবার ভয়ে, দরিদ্র-শোষণ ও ধনিক-পোষণ-নীতি অবলম্বন করিতে হয়, এবং ব্রিটিশের বাণিজ্যিক স্বার্থকে পূর্ণ-প্রশ্রয় দিতে হয়;―সেই মুক্তিই কি মহাত্মা গান্ধীর সেই নীতির অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য্য ফল নয়? মহাত্মা বাঁচিয়া থাকিলে, অবশ্যই ঘন-ঘন প্রয়োপবেশন করিতেন; তাহাতে প্রজাগণের আধ্যাত্মিক সহিষ্ণুতা আরও কিছুকাল বজায় থাকিত, তাহারা মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর হইয়াও চীৎকার করিত না। কিন্তু ঐ মুক্তি-বস্তুটার কি কোন রূপান্তর হইত? যে মন্ত্রের যাহা ফল, তাহাই হইত―গান্ধীজী সেই ফলটাকে গালি দিতেন, কিন্তু মন্ত্রটাকে ত্যাগ করিতেন না। ঐ শিষ্যগুলিকে আশীর্ব্বাদও করিতেন, আবার জনগণের দিকে চাহিয়া কাঁদিতেন, এবং প্রয়োবেশনের দ্বারা―সকল পাপের প্রায়শ্চিত্তও করিতেন। গান্ধীজী বাঁচিয়া থাকিলে ইহার বেশি কিছু হইত না; ঐ কংগ্রেসী নেতৃবর্গ তখনও ভালো করিয়াই তাঁহার পূজা করিতেন, এবং পূজার ফলস্বরূপ চতুর্ব্বৰ্গ ভোগ করিতেন। অতএব, এখনও গান্ধীজীর নাম করিয়া ঐ নেতৃবর্গকে গালি দিলে কি হইবে? গান্ধীজীর অন্তরঙ্গ শিষ্য যাহারা, যাহারা এতকাল গান্ধীজীর সঙ্গে যোগযুক্ত হইয়া ঐ মন্ত্রের সাধনা করিয়াছে, তাহাদের চেয়ে আর কেহ উহা বেশি জানে? মোহ কি কিছুতেই ঘুচিবে না? তারপর―

 “ব্যর্থ হইলে (গান্ধী-নীতির পরাভব হইলে), অর্থাৎ রক্তাক্ত বিপ্লবের পথে এই কার্য্য সাধিত হইলে, সেই রক্তস্রোতে শুধু ইংরেজ ভাসিয়া যাইত না, ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যও ভাসিয়া যাইত। ইংরেজের সাম্রাজ্য যাইত, কিন্তু পাশ্চাত্য জীবনবাদের নীতিহীন প্রেমহীন জীবন-ধর্ম্ম ভারতবর্ষে কায়েম হইয়া থাকিত।”

 এখানে লেখক স্পষ্টই নেতাজীর সেই প্রয়াসকে অতিশয় কঠিন আক্রমণ করিয়াছেন। ইহার উত্তরে প্রথমেই বলিতে হয়― “Forgive them, Father, for they know not what they do”। পাপমাত্রেই অজ্ঞান-প্রসূত, তথাপি, এমন পাপও আছে, যাহা অজ্ঞানকৃত হইলেও মানুষকে স্তম্ভিত করে; শুধুই পাপীর জন্য নয়, মানুষমাত্রেরই জন্য ভগবানের নিকটে ক্ষমা ভিক্ষা করিতে হয়। এই পাপও সেইরূপ। লেখক নীতিহীন, প্রেমহীন জীবন-ধর্ম্মের কথা বলিয়াছেন―নেতাজীর প্রয়াসকেও তাহা হইলে সেইরূপ প্রয়াস বলিতে হইৰে! নীতিহীন, প্রেমহীন জীবনধর্ম্ম আমরাও চাহি না, কিন্তু তাহার সহিত ‘রক্তাক্ত বিপ্লবের’ সম্পর্ক কি, তাহা বুঝিলাম না। মহাত্মার জীবনবাদ ভারতকে ইংরেজের সাম্রাজ্যপাশ হইতে কিরূপ মুক্ত করিয়াছে তাহাও আমরা দেখিয়াছি; সেই নীতিরই অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হইয়াছে এই যে, ভারত তাহার আত্মাকেও হারাইতে বসিয়াছে। অবশ্য ইহাই যে মহাত্মার কামনা বা অভিপ্রায় ছিল তাহা বলিতেছি না, কিন্তু তাঁহার সেই রাজনৈতিক অহিংসা-নীতির (উৎকৃষ্ট ধর্ম্মনীতিও বটে) পরিণাম উহা ছাড়া যে আর কিছুই হইতে পারে না, তাহা ঐ মুক্তিলাভের সর্ত্তগুলি অস্বীকার না করিলে, এবং ভাল করিয়া চিন্তা করিলে, না বুঝিবার কারণ থাকিবে না। উহারই অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন-বশে ভারতের শাসনতন্ত্র হইতে ধর্ম্মকে বহিস্কৃত করা হইয়াছে―তাহাও অহিংসা-ধর্ম্মেরই নামে; কারণ, অহিংসা একটা মহামানবীয় ধর্ম্ম, কোন জাতি বা সমাজের ধর্ম্ম নয়। সমাজকেও যুরোপীয় ছাঁচে ঢালিবার জন্য গান্ধীশিষ্যগণ হিন্দু আইন উঠাইয়া দিতেছেন; ইহার কারণ, গান্ধীর সামাজতন্ত্রবাদ তাঁহার অহিংসাবাদের মতই যুক্তি-বিরুদ্ধ ও অবান্তর, তাহাতে আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজতন্ত্রবাদও যেমন ছিল না, তেমনই ভারতীয় আদর্শের সেই মূলনীতির যুগোচিত সংস্কার-চিন্তাও ছিল না। তাই তাঁহার শিষ্যগণ বিলাতী আদর্শের অনুকরণ করিয়া ‘অশিক্ষিত’ ও অসভ্য ভারতবাসীর উপরে নিজেদের সেই snobbery-র মহিমা ঘোষণা করিতেছে। নব্য রাষ্ট্ৰতন্ত্রে ঐ যে ধনিকের আধিপত্য,―তাহার মূল গান্ধীজীর ধর্ম্মামুশাসনে পাওয়া যাইবে না, কিন্তু তাঁহার রাজনৈতিক কর্ম্মচর্য্যায় পাওয়া যাইতে পারে। ইহাতেও যদি মতভেদ থাকে, তথাপি ‘ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্য’ ও মহাত্মার ঐ অহিংসা-ধর্ম্মের মধ্যে কোথায় সেই অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে, তাহা আমরা বুঝিলাম না। আমরা আর সকলই সহ্য করিতে পারি, কিন্তু এই মিথ্যাটা অসহ্য হইয়া উঠিয়াছে; তার কারণ, আমরা রাজনীতি বুঝি না বটে, কিন্তু হিন্দুর ধর্ম ও ঐতিহ্য কি তাহা কিঞ্চিৎ বুঝিবার দাবী রাখি―রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক সম্পাদকের মত সর্ব্বসংস্কারমুক্ত খাঁটি হিন্দু আমরা নহি। ‘রক্তাক্ত বিপ্লব’ কথাটা অতিশয় কটু, তাহাতে সন্দেহ নাই―লেখক উহা আধুনিক পাশ্চাত্য ভাষা হইতে সংকলন করিয়াছেন বলিয়া মনে হয়। কিন্তু ঐরূপ দুই একটি আধুনিক বচনের দ্বারা মানব-ইতিহাস, তথা ভারত-ইতিহাসের সত্য উড়াইয়া দেওয়া যায় না। ভারতবর্ষ কুরুক্ষেত্রকে ধর্ম্মক্ষেত্র বলে―সেই ‘রক্তাক্ত বিপ্লবে’র ভূমিটাই তাহার পরম পবিত্র তীর্থ হইয়া আছে। গান্ধী-ধর্ম্মও ভারতে নূতন নয়, বস্ততঃ গান্ধীজীর একটি কথাও মৌলিক নয়―কেবল তাহার পন্থা বা প্রয়োগ বিধিটাই নূতন―অর্থাৎ 'unhistorical’। ঐ অহিংসা-ধর্ম্মও বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্মের একটা রাজনৈতিক সংস্করণ মাত্র। আবার, ভারতীয় শাস্ত্র, দর্শন ও ভারতের যোগমার্গ যাঁহারা জীবনে অভ্যাস করিয়াছেন তাঁহাদের অনেকের মতে ঐ বৌদ্ধধর্ম্মই ভারতের অধঃপতনের কারণ। উপরি-উদ্ধৃত উক্তিটি যাঁহার তিনি কি ভারতীয় ঐতিহ্য-বিষয়ে এমনই ব্যুৎপন্ন―এবং সার্ব্বজনীন জীবনধর্ম্ম সম্বন্ধেও এমনই জ্ঞানবান যে, গান্ধীপ্রচারিত ঐ ধর্ম্মকে শ্রেষ্ঠ জীবন-বাদ ও ভারতীয় ঐতিহ্যের সারতত্ত্ব বলিয়া এমন অকুতোভয়ে মত প্রকাশ করিয়াছেন? ভারতে এখনও হিন্দুধর্ম্মজ্ঞ অনেক সিদ্ধ-সাধক এবং সন্ন্যাসী-গুরু বাঁচিয়া আছেন ―তাঁহাদের মত কি? না, তাহারা অতিশয় সংঙ্কীর্ণচেতা এবং মূর্খ―আধুনিক রাজনীতিবিদ্ পণ্ডিত এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখকেরাই হিন্দুর ঐতিহ্য সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠ অথরিটি? আমার আপত্তির কারণ আর কিছুই নহে―গুরুবাদ বা গুরুভক্তির নিন্দা আমরা করিব না, কারণ আমরাও হিন্দু। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ধর্ম্মমতকে―বিশেষতঃ যে ধর্ম্মমত একটা রাজনীতির দ্বারা দূষিত ও খণ্ডিত বলিয়া খাঁটি হিন্দুমত নয়―সেই ধর্ম্মমতকে ভারতের ঐতিহ্য-নামে প্রচার করিবার সময়ে আর একটু সাবধান হওয়া উচিত। কারণ, ভারতের এখন সত্যই বড় দুঃসময়; নানা বিজাতীয় মতবাদের আক্রমণে, এবং ঘরেই একটা অতি-বিরুদ্ধ ধর্ম্মসম্প্রদায়ের সংঘর্ষে, তাহার আত্মা নিহত হইবার উপক্রম হইয়াছে। এ সময়ে তাহার সেই স্বধর্ম্ম সম্বন্ধে―তাহার যুগ-যুগান্তরের ঐতিহ্য সম্বন্ধে―কোন ভুল ধারণা জন্মাইলে, সে একেবারেই তলাইয়া যাইবে; যদি এতটুকু ভুল করে, তবে আর রক্ষা নাই। অতএব, যাঁহারা বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল, এবং যাঁহারা তাঁহদের চিন্তা ও উপদেশের দ্বাবা জনগণকে শিক্ষিত করিবার ভার লইয়াছেন, তাঁহাদের দায়িত্ব বড়ই গুরুতর। ভারতের ঐতিহ্য লইয়া এইরূপ টানাটানি না করিলেই ভাল হয়। সে ঐতিহ্য এত বিপুল, বিচিত্র ও গভীর যে, কোন এক ক্ষুদ্র কালের একটা মানুষই তাহার বাহন হইতে পারে না -অবতারের কথা স্বতন্ত্র। ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, ‘রক্তাক্ত বিপ্লবে’র অর্থ যেমনই হৌক―হিংসা ও অহিংসার বিরোধ ভারতবর্ষ যেমন মিটাইয়াছে, পৃথিবীর আর কোন জাতি তেমন পারে নাই। একহিসাবে তাহাই ভারতের শ্রেষ্ঠ গৌরব  উপরের ঐ প্রসঙ্গেই আমরা আর একটি কথা বলিয়া আজিকার আলোচনা শেষ করিব। ভারতের ঐতিহ্য ও মানব-ইতিহাসের সদ্যতম ধারা—এই দুইয়ের যদি কোথাও সমন্বয় হইয়া থাকে, অর্থাৎ ভারতের সেই ‘সনাতন’ যদি কোথাও যুগোচিত মুর্ত্তি ধারণ করিয়া থাকে তবে তাহা ঐ একটি পুরুষের জীবনে—তাহার জ্ঞানে, তাহার প্রেমে, ও তাহার কর্ম্মে। কারণ, সুভাষচন্দ্র শুধুই আজাদ-হিন্দ্-ফৌজের নেতাজী নহেন—সমগ্র ভারতের প্রাণ-গঙ্গার গঙ্গাধর।


  1. ইহা যে কত সস্তা তাহা এক্ষণে প্রায় চাক্ষুষ হইয়া উঠিয়াছে।
  2. অনুবাদটি একটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল।