জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/উপসংহার
৭
উপসংহার
১৯০৮ সালের পর হইতে রবীন্দ্রনাথ কোন প্রকাশ্য রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেন নাই। একথা পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু সেভাবে যোগ না দিলেও তিনি একেবারে উহার সংস্পর্শ এড়াইতে পারেন নাই। দেশের ও জাতির স্বার্থরক্ষার জন্য যখনই তাঁহার সহযোগিতা অপরিহার্য হইয়া পড়িয়াছে, তখনই তিনি সে আহ্বানে সাড়া দিতে কার্পণ্য করেন নাই। কয়েকটি প্রধান প্রধান দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যাইতে পারে। ১৯১৬ সালে কলিকাতায় কংগ্রেসের যে অধিবেশন আহুত হয়, তাহাতে চরমপন্থী ও নরমপন্থী দলের মধ্যে আবার বিবাদ বাধিয়া উঠে। চরমপন্থী বা নবীন জাতীয়তাবাদী দল প্রস্তাব করেন যে, মিসেস অ্যানি বেশান্তকে ঐ অধিবেশনের সভানেত্রী করা হউক। মিসেস বেশান্ত তাহারই কিছু পূর্বে “হোমরুল আন্দোলন”-এর জন্য বিনা বিচারে অন্তরীণ হইয়াছিলেন। নরমপন্থী মডারেট দলের নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি মিসেস বেশান্তের সভাপতিত্বের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন। এই সময়ে চরমপন্থী বা নবীন জাতীয়তাবাদী দলের মুখপাত্র স্বরূপ ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল, চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল ঘোষ, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, মৌলবী ফজলুল হক, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি। রবীন্দ্রনাথও ইহাদের সঙ্গে মিসেস বেশান্তকেই সভানেত্রীরূপে বরণ করিবার প্রস্তাব করেন। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ লইয়া ঐরূপ মতদ্বৈধ হইয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ মডারেটগণ বহরমপুরের প্রখ্যাতনামা বৈকুণ্ঠনাথ সেনকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিপদে নির্বাচিত করিতে চাহেন। কিন্তু নবীন জাতীয়তাবাদী দল ইহাতে সম্মত হইলেন না। তাঁহারা রবীন্দ্রনাথকে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ গ্রহণ করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাহাতে সম্মত হইলেন। এইরূপে দুই দলে মতভেদ হইয়া উঠিল, তখন সৌভাগ্যক্রমে একটা আপোষের ব্যবস্থা হইল। মডারেট দল মিসেস অ্যানী বেশান্তকে সভানেত্রীরূপে স্বীকার করিয়া লইলেন। রবীন্দ্রনাথও শেষ মুহূর্তে বৈকুণ্ঠনাথ সেনের অনুকূলে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির পদ ত্যাগ করিলেন। কলিকাতার কংগ্রেসের অধিবেশন সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হইল। রবীন্দ্রনাথ এই অধিবেশনে যোগ দেন এবং “জাতীয় প্রার্থনা” পাঠ করেন।
তৎকালীন নবজাতীয়তাবাদী দলের অন্যতম নেতা শ্রীযুত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত রবীন্দ্রনাথের শেষ জন্মোৎসব উপলক্ষে ‘পরিচয়’ পত্রে এ সম্বন্ধে যে চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি,—
“কলিকাতায় কংগ্রেস হইবার কথা, অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হইতেছে এবং ঐ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হইতেছেন। নরম দল ও গরম দলের মধ্যে ইতিপূর্বেই মনোবাদ বাধিয়াছে—আমি গরম দলভুক্ত। আমরা চাই মিসেস বেশান্তকে সভানেত্রীর আসন দিতে—নরম দলের তাহাতে বিশেষ আপত্তি। Indian Association হলে সভা বসিয়াছে। বৈকুণ্ঠনাথ সেন মহাশয়কে সভাপতি (অভ্যর্থনা সমিতির) করিবার প্রস্তাব পেশ হইল। আমি উঠিয়া আপত্তি করিলাম। বলা উচিত তখন আমার ত ‘দ্বন্দ্ব সহিষ্ণুতা’ ছিলই না (এখনও যে বিশেষ আছে একথা বলি না)—দ্বন্দ্বপ্রিয়তা যথেষ্ট ছিল। তাহার ফলে এবং গরমপন্থীর বন্ধুদের সহযোগিতায় মিটিং ভাঙ্গিয়া গেল। অবশ্য নরম দলেরা বিলক্ষণ চটিলেন। কিন্তু আমরা তাঁহাদের উপেক্ষা করিয়া অভ্যর্থনা সমিতির দ্বিতীয় বৈঠক করিলাম এবং রবীন্দ্রনাথকে ঐ সমিতির সভাপতি নির্বাচিত করিলাম। তাঁহার মত নিরীহ লোকের এ বিবাদে না যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কর্তব্যের অনুরোধে এবং ভারত জননীর একান্ত সেবিকা মিসেস বেশান্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নিদর্শনরূপে রবীন্দ্রনাথ ‘মদরত’দিগের অশেষ অনুনয় উপেক্ষা করিয়া সভাপতিত্ব করিতে স্বীকৃত হইলেন। ইহার ফলে আমাদের দল বেশ প্রবল হইয়া উঠিল এবং জনসাধারণ দলে দলে ঐ অভ্যর্থনা সমিতির সদস্যভুক্ত হইল। অবস্থা বুঝিয়া ‘মদরতে’রা মিসেস বেশান্তকে কংগ্রেসের সভাপতিত্বে বরণ করিলেন। কাজেই সাময়িক বিবাদ মিটিয়া গেল। তখন রবীন্দ্রনাথ অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিত্ব ত্যাগ করিয়া বৈকুণ্ঠনাথ সেন মহাশয়কে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত করিলেন।” (রবীন্দ্র প্রসঙ্গ—পরিচয়, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৮)।
১৯১৯ সালে রাউলেট আইনের প্রতিবাদে দেশময় তুমুল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলন আরম্ভ করেন। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল ১লা বৈশাখ নববৎসরের দিন—অমৃতসরের জালিওয়ানাবাগে জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলী বর্ষিত হয়। বহুলোক হতাহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারী হয়। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিবরণ প্রথমত সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইতে পারে নাই। জননায়কগণও যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িয়াছিলেন। রবীন্দ্রনাথই প্রথমে এই নৃশংস ব্যাপারের প্রকাশ্যে তীব্র প্রতিবাদ করেন। তিনি বড়লাটকে একখানি পত্র লিখিয়া জালিওয়ানাবাগের হত্যাকাণ্ড ও পাঞ্জাবের সামরিক আইন জারীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন এবং গভর্মেণ্ট কর্তৃক প্রদত্ত ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই পত্রে কবির লেখনী হইতে যে তেজোময়ী বাণী নিঃসৃত হইয়াছিল, তাহার তুলনা নাই। সংবাদপত্রে রবীন্দ্রনাথের পত্র যখন প্রকাশিত হইল, তখন দেশবাসী পাঞ্জাবে দমননীতির তাণ্ডব এবং জালিওয়ানাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা জানিতে পারিল। ফলে দেশের সর্বত্র ঘোর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইল। বিভিন্ন প্রদেশ হইতে জননায়কগণ পাঞ্জাবে গিয়া সমবেত হইলেন এবং জালিওয়ানাবাগের হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে তদন্ত আরম্ভ করিলেন।
রবীন্দ্রনাথ বড়লাটের নিকট যে প্রতিবাদ-পত্র লিখিয়াছিলেন তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধত করিতেছি:—
“The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab for quelling some local disturbances has with a rude shock revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India.
Considering that such treatment has been meted out to a population, disarmed and resourceless, by a power which has the most terribly efficient organization for destruction of human lives, we must strongly assert that it can claim no political expediency, far less moral justification.
The accounts of insults and sufferings undergone by our brothers in the Punjab have trickled through the gagged silence reaching every corner of India, and the universal agony of indignation roused in the hearts of our people has been ignored by our rulers—possibly congratulating themselves for imparting what they imagine as salutory lessons.
Knowing that our appeals have been in vain and that the passion of vengeance is blinding the noble vision of statesmanship in our Government which could so easily afford to be magnanimous as befitting its physical strength and moral tradition, the very least that I can do for my country is to take all consequences upon myself in giving voice to the protest of the millions of my countrymen, surprised into a dumb anguish of terror.
The time has come when badges of honour make our shame glaring in their incongruous context of humiliation, and I, for my part, wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of my countrymen who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings.”
১৯৩১ সালে হিজলীর বন্দিশালায় একটি গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে। এই বন্দিশালায় বিনা বিচারে আটক রাজনৈতিক বন্দিগণ ছিলেন। একটা গোলযোগের ফলে প্রহরীদের সঙ্গে তাঁহাদের সংঘর্ষ ঘটে, প্রহরীরা গুলী চালনা করে, ফলে দুইজন রাজনৈতিক বন্দী নিহত এবং অনেকে আহত হন। এই শোচনীয় ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হইলে দেশময় প্রবল বিক্ষোভের সঞ্চার হয়। গুলী চালনার প্রতিবাদে কলিকাতার টাউন হলে বিরাট জনসভার আয়োজন হয় এবং রবীন্দ্রনাথকেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করিবার জন্য অনুরোধ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সে আহ্বানে সাড়া না দিয়া থাকিতে পারেন নাই। কিন্তু সভায় নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব হইতেই টাউন হলে এরূপ বিপুল জনসমাগম হইতে থাকে যে, সেখানে সভা করা অসম্ভব হইয়া উঠে। অবশেষে গড়ের মাঠে অক্টারলোনী মনুমেণ্টের নীচে সভা করা হইল। রবীন্দ্রনাথ সেখানে যে বক্তৃতা করেন বহু দিন তাঁহার কণ্ঠে সেরূপ তীব্র আবেগময় বক্তৃতা শুনি নাই। তিনি যেন সমগ্র বাঙালী জাতির ক্ষোভ ও মর্মবেদনাই তাঁহার অননুকরণীয় ভাষার মধ্য দিয়া ব্যক্ত করিয়াছিলেন।
মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করিতে পারেন নাই, বরং কলিকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে “শিক্ষার মিলন” ও “সত্যের আহ্বান” নামে পর পর দুইটি বক্তৃতা করিয়া তিনি গান্ধীজীর অবলম্বিত পন্থার তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা কিছুমাত্র হ্রাস হয় নাই। ১৯৩২ সালে মহাত্মাজী যখন সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রতিবাদে আমরণ অনশন বরণ করেন, তখন রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিচলিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি এইজন্য গভীর বেদনা প্রকাশ করিয়া শাস্তিনিকেতনে কয়েকটি বক্তৃতা করেন এবং পুণার যারবেদা জেলে গিয়া গান্ধীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গান্ধীজী রবীন্দ্রনাথের সম্মুখেই অনশন ভঙ্গ করেন।
ইহার পর মহাত্মা গান্ধী এবং তাঁহার নেতৃত্বে কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা সম্বন্ধে যে ‘না গ্রহণ না বর্জন’ নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাহার ফল দেশের পক্ষে ঘোর অনিষ্টকর হইয়াছে। বিভিন্ন প্রদেশের নেতারা, বিশেষ করিয়া বাঙলাদেশের নেতারা সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা তথা কংগ্রেসের এই ‘না গ্রহণ না বর্জন’ নীতির তীব্র বিরোধিতা করেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁহাদের সঙ্গে যোগ দেন। ১৯৩৬ সালে কলিকাতা টাউন হলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রতিবাদ করিবার জন্য যে বিরাট জনসভা হয়, রবীন্দ্রনাথই তাহার সভাপতিত্ব করেন। রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভাল ছিল না। বক্তৃতার প্রারম্ভে তিনি বলেন, “আমাদের পক্ষে ইহার (বাঁটোয়ারার) অপমান এমন দুর্বিসহ যে, বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যহীনতার অজুহাত দেখাইতে আমি লজ্জাবোধ করিলাম এবং আমার চিরপ্রিয় নির্জনতা পরিত্যাগ করিয়া সাবধান বাণী উচ্চারণ করিতে আসিলাম।”
সভায় এত বেশী ভীড় হইয়াছিল যে, রবীন্দ্রনাথ বিশেষ কষ্ট অনুভব করিতে থাকেন। সৌভাগ্যক্রমে তাঁহার চিকিৎসক স্যার নীলরতন সরকার তাঁহার পার্শ্বে ই ছিলেন। বক্তৃতা করিবার সময় রবীন্দ্রনাথ যাহাতে অক্সিজেন বাষ্প গ্রহণ করিতে পারেন, সে ব্যবস্থা তিনি করেন। বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যহীনতা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ যে সেদিন তাঁহার কর্তব্য পালনে পশ্চাদ্পদ হন নাই, ইহা তাঁহার গভীর স্বদেশপ্রেমেরই নিদর্শন।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রতিবাদ করিয়া রবীন্দ্রনাথ যে সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছিলেন, গত কয়েক বৎসরে তাহা অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছে। ব্রিটিশ গভর্মেণ্টের তথা আমাদের জননায়কগণের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথাগুলি এখনও গভীরভাবে ভাবিয়া দেখা উচিত এবং বাঁটোয়ারার রদ না করিলে দেশের যে কল্যাণ নাই,—রাজনৈতিক তথা সাম্প্রদায়িক শান্তি কখনই প্রতিষ্ঠিত হইবে না, তাহা উপলব্ধি করা কর্তব্য। রবীন্দ্রনাথের সেই সারগর্ভ অভিভাষণ হইতে দুই একটি কথা উদ্ধৃত করিতেছি:—
“সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা দেশের রাজনৈতিক জীবনকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিবার জন্য একটা অভিশাপ। যে সকল দল ও সম্প্রদায় বাঁটোয়ারা চাহে নাই, তাহাদেরও উপর এই অভিশাপ বর্ষিত হইয়াছে। ভারতবাসীদিগকে রাজনীতি হিসাবে আঠারটা পৃথক ভাবে বিভক্ত করিবার আয়োজন হইয়াছে। মহাত্মা গান্ধী ইহাকে ভারতবর্ষের জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই ব্যবচ্ছেদের ফলে ভারতবর্ষ প্রাণহীন শব মাত্রে পরিণত হইবে।......
মুসলমান সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলেন,
“আসুন, আমরা দূরদর্শিতা অবলম্বন করিয়া বুঝিবার চেষ্টা করি যে, সাবধানীর পৃষ্ঠপোষকতায় যে সুবিধা লাভ হয়, তাহা ভাগ্যবান অনুগৃহীত এবং দুর্ভাগ্য বিমুখ—উভয়ের পক্ষেই সমান ক্ষতিকর। তাহার ফলে যে সকল জটিলতার সৃষ্টি হইবে, তাহা পরস্পরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কাইয়া দিবে এবং যাহারা পৃষ্ঠপোষকতা লাভে সস্তায় কিস্তীমাত করে, পরিণামে তাহাদেরও কোন মঙ্গল হইবে না। আমরা, যাহারা এক জন্মভূমির সন্তান, সভ্য জাতিস্বরূপ অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য, এমন কি, আত্মরক্ষার জন্য তাহাদের উচিত পরস্পরের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করা, উভয় সম্প্রদায়েরই ক্ষোভের কারণ ও প্রলোভন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া দেশ ও বিদেশের তাহাদিগকেই উপেক্ষা করা উচিত, যাহারা তাহাদের বন্ধুত্বের পথে কণ্টক স্থাপন করে।......
“এই অন্যায় অনুগ্রহের যে একটা নিশ্চিত প্রতিক্রিয়া আছে, তাহাই চিন্তার বিষয়; কারণ একদিন আসিবে যেদিন আর এইরূপ অনুগ্রহ করা সম্ভব হইবে না, যে দিন এক তরফা আব্দার পালনে স্বেচ্ছাচারীরও চক্ষুলজ্জা হইবে; অথচ সেই দিনও অন্যায় অনুগ্রহ লাভের আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হইবে না।”...
ব্রিটিশ শাসকদিগকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলেন,—
“যাঁহারা ইউরোপের বর্তমান পরিস্থিতি লক্ষ্য করিয়াছেন, তাঁহারাই জানেন, কোন দেশের অধিবাসীদিগকে সাময়িক কালের জন্য নিস্তেজ করিয়া ফেলিয়া অপমানের বোঝা শিরে বহিতে বাধ্য করা যায় বটে কিন্তু তাহাদিগকে চিরতরে তাহা মানিয়া লইতে বাধ্য করা যায় না। শীঘ্রই হউক, আর বিলম্বেই হউক, ঐ অপমান প্রতিনিক্ষিপ্ত হয় এবং উহার বিষ চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হয়।”
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেমের আর একটা দিকের কিছু পরিচয় দিয়া আমরা এখন এই আলোচনা শেষ করিব। রবীন্দ্রনাথ জীবনের প্রথম হইতেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভক্ত ছিলেন। বাল্যে পিতার নিকট হইতে যে শিক্ষা তিনি লাভ করিয়াছিলেন, তাহাতে এইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক। উপনিষদের মধ্য দিয়া আমাদের প্রাচীন ঋষিরা যে সব সার সত্য ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথের মতে উহাই ভারতের আত্মার শাশ্বত বাণী। ভারতের এই শাশ্বত বাণী রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করিয়াছে। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে তাঁহার গভীর পরিচয় ছিল, সেই সভ্যতার মধ্যে যে তেজস্কর সত্য আছে, তাহার প্রতি স্বদেশবাসীর দৃষ্টি চিরদিনই তিনি আকর্ষণ করিয়াছেন। কিন্তু অন্য দিকে ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐশ্বর্যের কথা দেশবাসী যাহাতে না ভুলে, সেই দিকেও তাঁহার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। কেবল তাহাই নয়, স্বামী বিবেকানন্দের মত তিনিও মনে করিতেন যে, ভারতের পক্ষ হইতে তাহার সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বার্তা বর্তমান জগতের নিকট প্রচার করা কর্তব্য। কেননা তাহাতে বিশ্বমানবের প্রকৃত কল্যাণ হইবে। জীবনের শেষ ভাগে এই কারণেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করিয়া ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বার্তা প্রচার করিয়াছিলেন। এক কথায় তিনি হইয়াছিলেন আধুনিক জগতের নিকট ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির দূত। আর এই দৌত্যকার্য তিনি এমন কৃতিত্বের সঙ্গে করেন যে, বিশ্বের দরবারে ভারতের মর্যাদা বাড়িয়া গিয়াছিল।
রবীন্দ্রনাথের এই দৌত্য কার্যের বিবরণ লিখিতে হইলে একখানি বৃহৎ গ্রন্থই লিখিতে হয়। হয়ত ভবিষ্যতে কোন যোগ্য লেখক সেই কর্তব্য পালন করিবেন। বন্ধুবর শ্রীযুত জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ “দেশভ্রমণে রবীন্দ্রনাথ” নামক গ্রন্থে এই কর্তব্য কিয়দংশে পালন করিয়াছেন। আমরা এখানে অতি সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের বিদেশ ভ্রমণের সামান্য কিছু পরিচয় দিলাম।
১৯১২-১৩ খৃঃ—গ্রেটব্রিটেন, নিউইয়র্ক (উপনিষদ সম্বন্ধে বক্তৃতা); সিকাগো (ভারতীয় সভ্যতার আদর্শ)।
১৯১৬—জাপান, আমেরিকা।
১৯২০—ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যাণ্ড; আমেরিকা (নিউইয়র্ক, সিকাগো, টেকসাস)।
১৯২১—ফ্রান্স, সুইজারল্যাণ্ড, জার্মানী (কবি এইবার জার্মানীর নানা স্থানে বক্তৃতা করেন ও বিপুলভাবে সম্বর্ধিত হন)।
১৯২৪—চীন, দক্ষিণ আমেরিকা। ১৯২৫ ও ১৯২৬—ইটালী, নরওয়ে, জার্মানী।
১৯২৭—সুমাত্রা, জাভা, বলী, মালাক্কা।
১৯২৯—কানাডা।
১৯৩০—ব্রিটেন (অক্সফোর্ড); রাশিয়া। রাশিয়ার অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথের মনের উপর খুবই প্রভাব বিস্তার করে। রাশিয়া যে নূতন প্রণালীতে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করিতেছে তাহার মূল সূত্র আমাদের দেশে অনুসৃত হইলে জাতির কল্যাণ হইবে, এই বিশ্বাস তাঁহার হইয়াছিল। রাশিয়ার চিঠিতে একথা তিনি স্পষ্টভাবেই লিখিয়াছিলেন।
১৯৩২—পারস্য ও ইরাক। ৭১ বৎসর বয়সে কবি বিমানযোগে এই দুই দেশ ভ্রমণ করেন। ইহাতে তাঁহার অসাধারণ মানসিক বলেরই পরিচয় পাওয়া যায়।
আধুনিক সভ্য জাতিদের ঘোর বর্ণবিদ্বেষ, স্বার্থপরতা ও পররাজ্য-লোলুপতা এবং পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক সভ্যতার ধ্বংসকারী প্রবৃত্তি ও আত্মহত্যাকর নীতি দেখিয়া রবীন্দ্রনাথ জীবনের অপরাহ্ণে অত্যন্ত বেদনা পাইয়াছিলেন এবং মানব জাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হইয়াছিলেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালেও মানব প্রকৃতির অন্তর্নিহিত মহত্ত্বের উপর তিনি একেবারে বিশ্বাস হারান নাই। কলিকাতা টাউন হলে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার বিরুদ্ধে তিনি যে বক্তৃতা করেন, তাহাতেও বিশেষভাবে ইংরাজ জাতিকে লক্ষ্য করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন,—
“এখনো মানবতার আদর্শের প্রতি পাশ্চাত্যের মজ্জাগত আকর্ষণ বিষয়ে আমার মনে দৃঢ় আস্থা বিদ্যমান। এইজন্যই আমাদিগকে আষ্টে পৃষ্ঠে বাঁধিয়া ফেলিবার জন্য, ভবিষ্যৎ প্রগতির পথে আমাদের গতিকে চিরতরে পঙ্গু করিয়া ফেলিবার জন্য সুকৌশলী রাজনীতিকের দৃঢ় ফাঁদের বেষ্টন নিজেদের আশে পাশে যদিও অনুভব করিতে পারিতেছি, তথাপি আমি পাশ্চাত্য জগতের শ্রেষ্ঠ চিন্তাধারার বাহক ও পোষক ইংরেজদের বীরসুলভ মানবতার দোহাই না দিয়া পারিতেছি না।”......
কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইবার পর আধুনিক সভ্যজাতিদের তথা পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক সভ্যতার প্রতি তাঁহার আস্থা একেবারেই লোপ পাইয়াছিল বলিলেই হয়। বিশেষত, বৃটিশসাম্রাজ্যবাদীরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নামে বর্তমান মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইবার পরও পরাধীন ভারতের প্রতি যে ব্যবহার করিতেছেন, তাহাতে তাঁহার আজন্মের শিক্ষা ও সংস্কারপোষিত শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের উৎস একেবারে শুকাইয়া গিয়াছিল। স্বদেশ ও স্বজাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া তিনি গভীর উদ্বেগ অনুভব করিয়াছিলেন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ তাঁহার শেষ জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে ‘সভ্যতার সঙ্কট’ নামে দেশবাসীর নিকট তিনি যে বাণী প্রচার করেন, স্বদেশ, স্বজাতি ও বিশ্বমানবের কল্যাণ চিন্তায় তাহাই তাঁহার শেষ উক্তি। রবীন্দ্রনাথের গভীর দেশপ্রেম ও মানবপ্রীতির নিদর্শনরূপে ইহা চিরদিন অক্ষয় হইয়া থাকিবে। এই অমর বাণী হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করি।
পাশ্চাত্য সভ্যতার আভ্যন্তরীণ কদর্যমূর্তির স্বরূপ প্রকাশ করিয়া রবীন্দ্রনাথ বলেন:—“এই বিদেশীয় সভ্যতা, যদি একে সভ্যতা বলো, আমাদের কি অপহরণ করেছে তা জানি। সে তার পরিবর্তে দণ্ড হাতে স্থাপন করেছে যাকে নাম দিয়েছে Law and Order—বিধি এবং ব্যবস্থা, যা সম্পূর্ণ বাইরের জিনিস, যা দারোয়ানি মাত্র। পাশ্চাত্য জাতির সভ্যতা-অভিযানের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা অসাধ্য হয়েছে। সে তার শক্তিরূপ আমাদের দেখিয়েছে, মুক্তিরূপ দেখাতে পারেনি। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা এই ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছে।”......
উপসংহারে গভীর ক্ষোভ ও বেদনার সঙ্গে কবি বলেন—
“ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতসাম্রাজ্য ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু কোন্ ভারতবর্ষকে সে পিছনে ত্যাগ করে যাবে, কী লক্ষ্মীছাড়া দীনতার আবর্জ্জনাকে! একাধিক শতাব্দীর শাসনধারা যখন শুষ্ক হয়ে যাবে তখন একী বিস্তীর্ণ পঙ্কশয্যা দূর্বিসহ নিষ্ফলতাকে বহন করতে থাকবে! জীবনের প্রথম আরম্ভে, সমগ্র মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম ইউরোপের সম্পদ অন্তরের এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি, পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটীরের মধ্যে, অপেক্ষা করে থাকব সভ্যতার দৈববাণী নিয়ে সে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি—পিছনের ঘাটে কি দেখে এলুম, কি রেখে এলুম, ইতিহাসের কি অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে, বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপরাধ মনে করি।
এই কথা আজ ব’লে যাব প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয়, তার প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে—নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে,—
অধর্মে নৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলস্তূ বিনশ্যতি।”
কবি তাঁহার এই শেষবাণীতে যে মর্মান্তিক সত্য ব্যক্ত করিয়াছেন, নির্মম নিয়তির মতো তাহাই যে বর্তমান মানবসভ্যতার পরিণাম নির্দেশ করিতেছে সে বিষয়ে কে সন্দেহ করিবে!
বন্দে মাতরম