জাতীয় আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ/পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট

“স্বদেশী যুগে” বাংলা সাহিত্য

 স্বদেশী যুগে বাংলা সাহিত্য জাতীয় আন্দোলনে যে প্রবল শক্তি সঞ্চার করিয়াছিল, তাহার কিছু পরিচয় আমার এই গ্রন্থে দিয়াছি। রবীন্দ্রনাথ যে এই কার্যে প্রধান অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আরও বহু কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার প্রভৃতির দানও বিশেষভাবে স্মরণীয়। স্বদেশী যুগে সহস্র সহস্র কবিতা ও জাতীয়সংগীত রচিত হইয়াছিল। সভাস্থলে, শোভাযাত্রায়, পথে ঘাটে, বাংলার ঘরে ঘরে এই সব সংগীত গান করা হইত। বাঙ্গালীর মনে জাতীয় ভাব উদ্বোধনে এই সব গান যে কতদূর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। (পুরাতন জাতীয় সংগীতের মধ্যে কবি মনমোহন বসুর ‘দিনের দিন সবে দীন’, এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘চলরে চল সবে ভারত সন্তান’ গান দুইটাই বেশী গীত হইত।)

 রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সংগীতের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। অন্যান্য স্বদেশপ্রেমাত্মক সংগীত রচয়িতাদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, সরলা দেবী, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য্য, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিজেন্দ্রলালের ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ ও “আমার জন্মভূমি” তাঁহার কবি-প্রতিভার অক্ষয় কীর্তিস্তম্ভ। কালীপ্রসন্ন কাব বিশারদের—

যায় যাবে জীবন চলে
জগৎ মাঝে তোমার কাজে
‘বন্দে মাতরম্’ বলে—

এই গান গাহিয়া রাজপথে শত শত শোভাযাত্রা বাহির হইয়াছিল এবং অনেকস্থলে শোভাযাত্রাকারীরা অবিচলিতভাবে পুলিসের লাঠি-বৃষ্টি সহা করিয়াছিল। অতুল সেন ও রজনী সেনের স্বদেশী সংগীতের নূতন করিয়া পরিচয় দিবার প্রয়োজন নাই, তাঁহাদের গান এখনও বাংলার সর্বত্র গীত হইয়া থাকে। কবি কামিনী ভট্টাচার্যের নাম এখন হয়ত লোকে ভুলিয়া গিয়াছেন। কিন্তু স্বদেশী যুগে তাঁহার রচিত সংগীতগুলি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। সরলা দেবীর ‘নমো হিন্দুস্থান’ বিখ্যাত স্বদেশপ্রেমের সংগীত,— কংগ্রেস, কনফারেন্স, সভা, সমিতি সর্বত্র উহা গীত হইত, এখনও হইয়া থাকে।

 স্বদেশী যুগে বহু নাট্যকার নাটকের মধ্য দিয়া স্বদেশপ্রেম ও জাতীয় ভাবের উদ্বোধন করিয়াছিলেন। তন্মধ্যে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিবে। গিরিশচন্দ্র প্রথমে পৌরাণিক এবং পরে সামাজিক নাটক রচনাতেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু স্বদেশী যুগে তিনি নূতন রূপে দেখা দিলেন, তাঁহার রচিত ‘সিরাজুদ্দৌলা’, ‘মীরকাসিম’, ‘ছত্রপতি শিবাজী’ প্রভৃতি নাটক স্বদেশপ্রেমের উদ্বোধনে অশেষ কার্য করিল। বিশেষভাবে তাঁহার ‘সিরাজুদ্দৌলা’ নাটক এক অপূর্ব সৃষ্টি, দেশবাসীর মনে এই নাটক যে শক্তি সঞ্চার করিয়াছিল, ভাষায় তাহা বর্ণনা করা যায় না।

 স্বদেশী যুগে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটক। ইহাকে যুগপ্রবর্তক নাটক বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। ক্ষীরোদপ্রসাদ যদি একখানি মাত্র নাটক লিখিতেন, তাহা হইলেও তিনি অমর হইয়া থাকিতেন। এই নাটক স্বদেশী যুগে রঙ্গমঞ্চে শত শত রজনীতে অভিনীত হইয়া দেশবাসীর মনে প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করিয়াছিল। সেকালে এই নাটক দেখিবার জন্য এত ভীড় হইত যে প্রতিদিনই স্থানাভাবে বহু দর্শককে হতাশ হইয়া ফিরিতে হইত। এখনও এই নাটক সগৌরবে বাংলা রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইয়া থাকে, ইহা কখনও ‘পুরাতন’ হইবে না। ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘রঞ্জাবতী’ প্রভৃতি নাটকও স্বদেশপ্রেমের উদ্বোধনে যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিল।

 দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাঙ্গলার নাট্যসাহিত্যে নূতন ভাব ও রচনাভঙ্গী প্রবর্তন করেন। কবিতা ও হাসির গান রচনায় তিনি পূর্বেই খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। স্বদেশী যুগে নাটকরচনাতেও তিনি অক্ষয় কীর্তি অর্জন করিলেন। তীব্র স্বদেশানুরাগ তাঁহার প্রকৃতিগত ছিল। তাঁহার হাসির গানগুলির মধ্য দিয়াও এই স্বদেশপ্রেম অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত প্রবাহিত। স্বদেশী আন্দোলনে তাঁহার সেই স্বদেশপ্রেম জ্বালাময় গৈরিক স্রাবের মত নাটক ও জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়া নির্গত হইতে লাগিল। ‘রাণা প্রতাপ’, ‘দুর্গাদাস’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘মেবার পতন’, ‘সিংহল বিজয়’ প্রভৃতি নাটকের মধ্য দিয়া স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়ভাবকে প্রবুদ্ধ করাই দ্বিজেন্দ্রলালের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্য যে বহুল পরিমাণে সিদ্ধ হইয়াছিল, তাহা কে অস্বীকার করিবে? দ্বিজেন্দ্রলালের সতেজ ওজস্বিনী ভাষা, বলিষ্ঠ রচনাভঙ্গী, বাংলা ভাষাকে নূতন শক্তি দান করিয়াছিল, নাট্যসাহিত্যে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করিয়াছিল।

 গিরিশচন্দ্র, ক্ষীরোদপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল প্রভৃতি নাট্যকারদের স্বদেশ প্রেমাত্মক নাটক অভিনয় করিয়া বাংলার নাট্যশালাগুলি যে জাতীয় আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। এজন্য বাঙ্গালীজাতি চিরদিন তাহাদের নিকট ঋণী হইয়া থাকিবে।