জাপান-যাত্রী/১
জাপান-যাত্রী
১
বম্বাই থেকে যতবার যাত্রা করেচি জাহাজ চলতে দেরি করে নি। কলকাতার জাহাজে যাত্রার আগের রাত্রে গিয়ে বসে থাকতে হয়। এটা ভাল লাগে না। কেননা যাত্রা করার মানেই মনের মধ্যে চলার বেগ সঞ্চয় করা। মন যখন চলমান মুখে তখন তাকে দাঁড় করিয়ে রাখা তার এক শক্তির সঙ্গে আর-এক শক্তির লড়াই বাধানো। মানুষ যখন ঘরের মধ্যে জমিয়ে বসে আছে, তখন বিদায়ের আয়োজনটা এই জন্যেই কষ্টকর; কেন না, থাকার সঙ্গে যাওয়ার সন্ধিস্থলটা মনের পক্ষে মুস্কিলের জায়গা,— সেখানে তাকে দুই উল্টো দিক সামলাতে হয়,—সে একরকমের কঠিন ব্যায়াম।
বাড়ির লোকেরা সকলেই জাহাজে চড়িয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেল, বন্ধুরা ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিয়ে বিদায় দিলো, কিন্তু জাহাজ চলল না। অর্থাৎ যারা থাকবার তারাই গেল, আর যেটা চলবার সেটাই স্থির হয়ে রইল,—বাড়ি গেল সবে, আর তরী রইল দাঁড়িয়ে। বিদায় মাত্রেরই একটা ব্যথা আছে,― সে ব্যথাটার প্রধান কারণ এই, জীবনে যা কিছুকে সব চেয়ে নির্দ্দিষ্ট করে’ পাওয়া গেছে, তাকে অনির্দ্দিষ্টের আড়ালে সমর্পণ করে’ যাওয়া। তার বদলে হাতে হাতে আর একটা কিছুকে পাওয়া না গেলে এই শূন্যতাটাই মনের মধ্যে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সেই পাওনাটা হচ্ছে অনির্দ্দিষ্টকে ক্রমে ক্রমে নির্দ্দিষ্টের ভাণ্ডারের মধ্যে পেয়ে চলতে থাকা। পরিচয়কে ক্রমে ক্রমে পরিচয়ের কোঠার মধ্যে ভুক্ত করে নিতে থাকা। সেই জন্যে যাত্রার মধ্যে যে দুঃখ আছে, চলাটাই হচ্চে তার ওষুধ। কিন্তু যাত্রা করলুম অথচ চল্লুম না— এটা সহ্য করা শক্ত।
অচল জাহাজের ক্যাবিন হচ্চে বন্ধনদশার দ্বিগুণ-চোলাই-করা কড়া আরক। জাহাজ চলে বলেই তার কাম্রার সঙ্কীর্ণতাকে আমরা ক্ষমা করি। কিন্তু জাহাজ যখন স্থির থাকে তখন ক্যাবিনে স্থির থাকা, মৃত্যুর ঢাকনাটার নীচে আবার গোরের ঢাক্নার মত।
ডেকের উপরেই শোবার ব্যবস্থা করা গেল। ইতিপূর্ব্বে অনেকবার জাহাজে চড়েচি, অনেক কাপ্তেনের সঙ্গে ব্যবহার করেচি। আমাদের এই জাপানি কাপ্তেনের একটু বিশেষত্ব আছে। মেলামেশায় ভালমানুষিতে হঠাৎ মনে হয় ঘোরো লোকের মত। মনে হয় এঁকে অনুরোধ করে’ যা-খুসি-তাই করা যেতে পারে,— কিন্তু কাজের বেলায় দেখা যায় নিয়মের লেশমাত্র নড়চড় হবার জো নাই। আমাদের সহযাত্রী ইংরেজ বন্ধু ডেকের উপরে তাঁর ক্যাবিনের গদি আনবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কর্ত্তৃপক্ষের ঘাড় নড়ল, সে ঘটে উঠ্লনা। সকালে ব্রেক্ফাস্টের সময় তিনি যে টেবিলে বসেছিলেন, সেখানে পাখা ছিল না; আমাদের টেবিলে জায়গা ছিল, সেই দেখে তিনি আমাদের টেবিলে বসবার ইচ্ছা জানালেন। অনুরোধটা সামান্য, কিন্তু কাপ্তেন বল্লেন, এবেলাকার মত বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, ডিনারের সময় দেখা যাবে। আমাদের টেবিলে চৌকি খালি রইল, কিন্তু তবু নিয়মের ব্যত্যয় হল না। বেশ বোঝা যাচ্চে, অতি অল্পমাত্রও ঢিলেঢালা কিছু হতে পারবে না।
রাত্রে বাইরে শোয়া গেল, কিন্তু এ কেমনতরো বাইরে? জাহাজের মাস্তুলে মাস্তুলে আকাশটা যেন ভীষ্মের মত শরশয্যায় শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করচে। কোথাও শূন্যরাজ্যের ফাঁকা নেই। অথচ বস্তুরাজ্যের স্পষ্টতাও নেই। জাহাজের আলোগুলো মস্ত একটা আয়তনের সূচনা করেছে, কিন্তু কোনো আকারকে দেখ্তে দিচ্চে না।
কোনো একটি কবিতায় প্রকাশ করেছিলুম যে, আমি নিশীথরাত্রির সভাকবি। আমার বরাবর একথাই মনে হয় যে দিনের বেলাটা মর্ত্ত্যলোকের, আর রাত্রিবেলাটা সুরলোকের। মানুষ ভয় পায়, মানুষ কাজকর্ম্ম করে, মানুষ তার পায়ের কাছের পথটা স্পষ্ট করে’ দেখতে চায়, এই জন্যে এত বড় একটা আলো জ্বালতে হয়েচে। দেবতার ভয় নেই, দেবতার কাজ নিঃশব্দে গোপনে, দেবতার চলার সঙ্গে স্তব্ধতার কোনো বিরোধ নই, এই জন্যেই অসীম অন্ধকার দেবসভার আস্তরণ। দেবতা রাত্রেই, আমাদের বাতায়নে এসে দেখা দেন।
কিন্তু মানুষের কারখানা যখন আলো জ্বালিয়ে সেই রাত্রিকেও অধিকার করতে চায়, তখন কেবল যে মানুষই ক্লিষ্ট হয়, তা নয়,—দেবতাকেও ক্লিষ্ট করে তোলে। আমরা যখন থেকে বাতি জ্বেলে রাত জেগে এগ্জামিন পাশ করতে প্রবৃত্ত হয়েচি, তখন থেকে সূর্য্যের আলোয় সুস্পষ্ট নির্দ্দিষ্ট নিজের সীমান্য লঙ্ঘন করতে লেগেছি, তখন থেকেই সুর-মানবের যুদ্ধ বেধেচে। মানুষের কারখানা-ঘরের চিম্নিগুলো ফুঁদিয়ে দিয়ে নিজের অন্তরের কালীকে দ্যুলোকে বিস্তার করচে, সে অপরাধ তেমন গুরুতর নয়,―কেন না দিনটা মানুষের নিজের, তার মুখে সে কালী মাখালেও দেবতা তা নিয়ে নালিশ করবেন না। কিন্তু রাত্রির অখণ্ড অন্ধকারকে মানুষ যখন নিজের আলো দিয়ে ফুটো করে দেয়, তখন দেবতার অধিকারে সে হস্তক্ষেপ করে। যেন নিজের দখল অতিক্রম করে আলোকের খুঁটি গেড়ে দেবলোকে আপন সীমানা চিহ্ণিত করতে চায়।
সেদিন রাত্রে গঙ্গার উপরে সেই দেববিদ্রোহের বিপুল আয়োজন দেখ্তে পেলুম। তাই মানুষের ক্লান্তির উপর সুরলোকের শাস্তির আশীর্ব্বাদ দেখা গেল না। মানুষ বল্তে চাচ্চে আমিও দেবতার মত, আমার ক্লান্তি নেই। কিন্তু সেটা মিথ্যা কথা—এইজন্যে সে চারিদিকের শান্তি নষ্ট করচে। এইজন্যে অন্ধকারকেও সে অশুচি করে তুলেচে।
দিন আলোকের দ্বারা আবিল, অন্ধকারই পরম নির্ম্মল। অন্ধকার রাত্রি সমুদ্রের মত,—তা অঞ্জনের মত কালো, কিন্তু তবু নিরঞ্জন। আর দিন নদীর মত, তা কালো নয়, কিন্তু পঙ্কিল। রাত্রির সেই অতলস্পর্শ অন্ধকারকেও সেদিন সেই খিদিরপুরের জেটির উপর মলিন দেখ্লুম। মনে হল, দেবতা স্বয়ং মুখ মলিন করে’ রয়েচেন।
এম্নি খারাপ লেগেছিল এডেনের বন্দরে। সেখানে মানুষের হাতে বন্দী হয়ে সমুদ্রও কলুষিত। জলের উপরে তেল ভাসচে, মানুষের আবর্জ্জনাকে স্বয়ং সমুদ্রও বিলুপ্ত করতে পারচে না। সেই রাত্রে জাহাজের ডেকের উপর শুয়ে অসীম রাত্রিকেও যখন কলঙ্কিত দেখলুম তখন মনে হল এক্দিন ইন্দ্রলোক দানবের আক্রমণে পীড়িত হয়ে ব্রহ্মার কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন— আজ মানবের অত্যচার থেকে দেবতাদের কোন্ রুদ্র রক্ষা করবেন?