জাহাজ ছেড়ে দিলে। মধুর বহিছে বায়ু ভেসে চলি রঙ্গে।

 কিন্তু এর রঙ্গটা কেবলমাত্র ভেসে চলার মধ্যেই নয়। ভেসে চলার একটি বিশেষ দৃষ্টি ও সেই বিশেষ দৃষ্টির বিশেষ রস আছে। যখন হেঁটে চলি তখন কোনো অখণ্ড ছবি চোখে পড়ে না। ভেসে চলার মধ্যে দুই বিরোধের পূর্ণ সামঞ্জস্য হয়েচে— বসেও আছি, চল্‌চিও। সেই জন্যে চলার কাজ হচ্চে, অথচ চলার কাজে মনকে লাগাতে হচ্চে না। তাই মন, যা সামনে দেখচে তাকে পূর্ণ করে দেখ্‌চে। জল স্থল আকাশের সমস্তকে এক করে মিলিয়ে দেখ্‌তে পাচ্চে।

 ভেসে চলার মধ্যে দিয়ে দেখার আর একটা গুণ হচ্চে এই যে, তা মনোযোগকে জাগ্রত করে, কিন্তু মনোযোগকে বদ্ধ করে না। না দেখতে পেলেও চল্‌ত, কোনো অসুবিধে হত না, পথ ভুল্‌তুম না, গর্ত্তয় পড়তুম না। এই জন্যে ভেসে চলার দেখাটা হচ্চে নিতান্তই দায়িত্ববিহীন দেখা,― দেখাটাই তার চরম লক্ষ্য― এই জন্যেই এই দেখাটা এমন বৃহৎ, এমন আনন্দময়।

 এতদিনে এইটুকু বোঝা গেছে যে, মানুষ নিজের দাসত্ব করতে বাধ্য, কিন্তু নিজের সম্বন্ধেও দায়ে-পড়া কাজে তার প্রীতি নেই। যখন চলাটাকেই লক্ষ্য করে পায়চারি করি, তখন সেটা বেশ; কিন্তু যখন কোথাও পৌঁছবার দিকে লক্ষ্য করে চল্‌তে হয়, তখন সেই চলার বাধ্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার শক্তিতেই মানুষের সম্পদ প্রকাশ পায়। ধন জিনিষটার মানেই এই― তাতে মানুষের প্রয়োজন কমায় না কিন্তু নিজের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার নিজের বাধ্যতা কমিয়ে দেয়। খাওয়া পরা, দেওয়া নেওয়ার দরকার তাকে মেটাতেই হয়, কিন্তু তার বাইরে যেখানে তার উদ্বৃত্ত সেইখানেই মানুষ মুক্ত, সেইখানেই সে বিশুদ্ধ নিজের পরিচয় পায়। এই জন্যেই ঘটিবাটি প্রভৃতি দরকারী জিনিষকেও মানুষ সুন্দর করে’ গড়ে’ তুলতে চায়— কারণ, ঘটিবাটির উপযোগিতা মানুষের প্রয়োজনের পরিচয় মাত্র কিন্তু তার সৌন্দর্য্যে মানুষের নিজেরই রুচির নিজেরই আনন্দের পরিচয়। ঘটিবাটির উপযোগিতা বল্‌চে মানুষের দায় আছে, ঘটিবাটির সৌন্দর্য্য বল্‌চে মানুষের আত্মা আছে।

 আমার না হলেও চল্‌ত, কেবল আমি ইচ্ছা করে করচি এই যে মুক্ত কর্ত্তৃত্বের ও মুক্ত ভোক্ত্তৃত্বের অভিমান, যে অভিমান বিশ্বস্রস্টার এবং বিশ্বরাজেশ্বরের,―সেই অভিমানই মানুষের সাহিত্যে এবং আর্টে। এই রাজ্যটি মুক্ত মানুষের রাজা, এখানে জীবনযাত্রার দায়িত্ব নেই।

 আজ সকালে যে প্রকৃতি সবুজ পাড়-দেওয়া গেরুয়া নদীর সাড়ি পরে’ আমার সাম্‌নে দাঁড়িয়েছে, আমি তাকে দেখচি। এখানে আমি বিশুদ্ধ দ্রষ্টা। এই দ্রষ্টা আমিটী যদি নিজেকে ভাষায় বা রেখায় প্রকাশ করত, তাহলে সেইটেই হত সাহিত্য, সেইটেইই হত আর্ট খামকা বিরক্ত হয়ে এমন কথা কেউ বলিতে পারে “তুমি দেখ্‌চ তাতে আমার গরজ কি? তাতে আমার পেটও ভরবে না, আমার ম্যালেরিয়া ও ঘুচবে না, তাতে আমার ফসল-ক্ষেতে বেশি করে ফসল ধরবার উপায় হবে না।” ঠিক কথা। আমি যে দেখচি এতে তোমার কোন গরজ নেই। অথচ আমি যে শুদ্ধমাত্র দ্রষ্টা, এ সম্বন্ধে বস্তুতই যদি তুমি উদাসীন হও—তাহলে জগতে আর্ট এবং সাহিত্য সৃষ্টির কোনো মানে থাকে না।

 আমাকে তোমরা জিজ্ঞাসা কর্‌তে পার, আজ এতক্ষণ ধরে’ তুমি যে লেখাটা লিখচ, ওটাকে কি বল্‌বে? সাহিত্য, না তত্ত্বালোচনা।

 নাই বল্লুম তত্বালোচনা। তত্ত্বালোচনায় যে ব্যক্তি আলোচনা করে, সে প্রধান নয়, তত্ত্বটাই প্রধান। সাহিত্যে সেই ব্যক্তিটাই প্রধান, তত্ত্বটা উপলক্ষ্য। এই যে শাদা মেঘের ছিটে-দেওয়া নীল আকাশের নীচে শ্যামল-ঐশ্বর্যময়ী ধরণীর আঙিনার সামনে দিয়ে সন্যাসী জলের স্রোত উদাসী হয়ে চলেচে, তার মাঝখানে প্রধানত প্রকাশ পাচ্ছে দ্রষ্টা আমি। যদি ভূতত্ত্ব বা ভূবৃত্তান্ত প্রকাশ কর্‌তে হত, তাহলে এই আমিকে সরে দাঁড়াতে হত। কিন্তু এক-আমির পক্ষে আর-এক আমির অহেতুক প্রয়োজন আছে, এই জন্য সময় পেলেই আমরা ভূতত্ত্বকে সরিয়ে রেখে সেই আমির সন্ধান করি।

 তেম্‌নি করেই কেবলমাত্র দৃশ্যের মধ্যে নয়, ভাবের মধ্যেও যে ভেসে চলেছে, সেও সেই দ্রষ্টা-আমি। সেখানে, যা বল্‌চে সেটা উপলক্ষ্য, যে বল্‌চে সেই লক্ষ্য। বাহিরের বিশ্বের রূপধারার দিকেও আমি যেমন তাকাতে তাকাতে চলেচি, আমার অন্তরের চিন্তাধারা ভাবধারার দিকেও আমি তেমনি চিত্তদৃষ্টি দিয়ে তাকাতে তাকাতে চলেচি। এই ধারা কোনো বিশেষ কর্ম্মের বিশেষ প্রয়োজনের সূত্রে বিধৃত নয়। এই ধারা প্রধানত লজিকের দ্বারাও গাঁথা নয়, এর গ্রন্থনসূত্র মুখ্যত আমি। সেইজন্যে আমি কেয়ারমাত্র করিনে সাহিত্য সম্বন্ধে বক্ষ্যমান রচনাটিকে লোক পাকা কথা বলে গ্রহণ করিবে কি না। বিশ্বলোকে এবং চিত্তলোকে “আমি দেখচি” এই অনাবশ্যক আনন্দের কথাটা বলাই হচ্ছে আমার কাজ। এই কথাটা যদি ঠিক করে বল্‌তে পারি তাহলে অন্য সকল অমির দলও বিনা প্রয়োজনে খুসি হয়ে উঠবে। গান।

 উপনিষদে লিখচে, এক-ডালে দুই পাখী আছে, তার মধ্যে এক পাখী খায়, আর এক পাখী দেখে। যে পাখী দেখচে তারি আনন্দ বড় আনন্দ; কেন না, তার সে বিশুদ্ধ আনন্দ, মুক্ত আনন্দ। মানুষের নিজের মধ্যেই এই দুই পাখী আছে। এক পাখীর প্রয়োজন আছে, আর-এক পাখীর প্রয়োজন নেই। এক পাখী ভোগ করে আর-এক পাখী দেখে। যে-পাখী ভোগ করে সে নির্ম্মাণ করে, যে পাখী দেখে সে সৃষ্টি করে। নির্ম্মাণ করা মানে মাপে তৈরি করা; অর্থাৎ যেটা তৈরি করা হচ্ছে সেইটেই চরম নয়, সেইটেকে অন্য কিছুর মাপে তৈরি করা,― নিজের প্রয়োজনের মাপে বা অন্যের প্রয়োজনের মাপে। আর সৃষ্টি করা অন্য কোনো-কিছুর মাপের অপেক্ষা করে না, সে হচ্চে নিজেকে সর্জ্জন করা, নিজেকেই প্রকাশ করা। এই জন্যে ভোগী পাখী যে সমস্ত উপকরণ নিয়ে কাজ করচে তা প্রধানত বাইরের উপকরণ, আর দ্রষ্টা পাখীর উপকরণ হচ্ছে আমি পদার্থ। এই আমির প্রকাশই সাহিত্য, আর্ট। তার মধ্যে কোনো দায়ই নেই, কর্ত্তব্যের দায়ও না।

 পৃথিবীতে সব চেয়ে বড় রহস্য, দেখবার বস্তুটি নয়, যে দেখে সেই মানুষটি। এই রহস্য আপনি আপনার ইয়ত্তা পাচ্চে না,―হাজার হাজার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে আপনাকে দেখ্‌তে চেষ্টা করছে। যা-কিছু ঘট্‌ছে এবং যা-কিছু ঘট্‌তে পারে, সমস্তর ভিতর দিয়ে নিজেকে বাজিয়ে দেখ্‌চে।

 এই যে আমার এক-আমি, এ বহুর মধ্যে দিয়ে চলে’ চলে’ নিজেকে নিত্য উপলব্ধি করতে থাকে। বহুর সঙ্গে মানুষের সেই একের মিলনজাত রসের উপলব্ধিই হচ্চে সাহিত্যের সামগ্রী। অর্থাৎ দৃষ্ট বস্তু নয়, দ্রষ্টা আমিই তার লক্ষ্য।

তোসা মারু জাহাজ ২০শে বৈশাখ, ১৩২৩।