জাপান-যাত্রী/৩
৩
বৃহস্পতিবার বিকেলে সমুদ্রের মোহানায় পাইলট নেবে গেল। এর কিছু আগে থাক তেই সমুদ্রের রূপ দেখা দিয়েছে। তার কূলের বেড়ি খসে’ গেচে। কিন্তু এখনও তার মাটীর রং ঘোচে নি। পৃথিবীর চেয়ে আকাশের সঙ্গেই যে তার আত্মীয়তা বেশি, সে কথা এখনো প্রকাশ হয় নি,— কেবল দেখা গেল জলে আকাশে এক-দিগন্তের মালা বদল করেচে। যে ঢেউ দিয়েচে, নদীর ঢেউয়ের ছন্দের মত তার ছোট ছোট পদ বিভাগ নয়; এ যেন মন্দাক্রান্তা—কিন্তু এখন সমুদ্রের শার্দ্দূল বিক্রীড়িত সুরু হয় নি।
আমাদের জাহাজের নীচের তলার ডেকে অনেকগুলি ডেক প্যাসেঞ্জার; তাদের অধিকাংশ মাদ্রাজি, এবং তারা প্রায় সকলেই রেঙ্গুনে যাচ্চে। তাদের পরে এই জাহাজের লোকের ব্যবহারে কিছুমাত্র কঠোরতা নেই, তারা বেশ স্বচ্ছন্দে আছে। জাহাজের ভাণ্ডার থেকে তারা প্রত্যেকে একখানি করে’ ছবি আঁকা কাগজের পাখা পেয়ে ভারি খুসি হয়েছে।
এরা অনেকেই হিন্দু, সুতরাং এদের পথের কষ্ট ঘোচান কারো সাধ্য নয়। কোন মতে আখ চিবিয়ে, চিঁড়ে খেয়ে এদের দিন যাচ্ছে। একটা জিনিষ ভারি চোখে লাগে, সে হচ্ছে এই যে, এরা মোটের উপর পরিস্কার—কিন্তু সেটা কেবল বিধানের গণ্ডির মধ্যে,—বিধানের বাইরে এদের নোংরা হবার কোনো বাধা নেই। আখ চিবিয়ে তার ছিব্ড়ে অতি সহজেই সমুদ্রে ফেলে দেওয়া যায়, কিন্তু সেটুকু কষ্ট নেওয়া এদের বিধানে নেই, যেখানে বসে খাচ্চে তার নেহাৎ কাছে ছিব্ড়ে ফেলছে; —এমনি করে’ চারিদিকে কত আবর্জ্জনা যে জমে উঠ্ছে তাতে এদের ভ্রক্ষেপ নেই। সব চেয়ে আমাকে পীড়া দেয় যখন দেখি থুথু ফেলা সম্বন্ধে এরা বিচার করে না। অথচ বিধান অনুসারে শুচিতা রক্ষা করবার বেলায় নিতান্ত সামান্য বিষয়েও এরা অসামান্য রকম কষ্ট স্বীকার করে।আচারকে শক্ত করে তুল্লে বিচারকে ঢিলে করতেই হয়। বাইরে থেকে মানুষকে বাঁধলে মানুষ আপনাকে আপনি বাঁধবার শক্তি হারায়।
এদের মধ্যে কয়েকজন মুসলমান আছে; পরিষ্কার হওয়া সম্বন্ধে তারা যে বিশেষ সতর্ক তা নয়, কিন্তু পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে তাদের ভারি সতর্কতা। ভাল কাপড়টি পরে’ টুপিটি বাগিয়ে তারা সর্ব্বদা প্রস্তুত থাকতে চায়। একটু মাত্র পরিচয় হলেই অথবা না হলেও তারা দেখা হলেই প্রসন্ন মুখে সেলাম করে। বোঝা যায় তারা বাইরের সংসারটাকে মানে। কেলমাত্র নিজের জাতের গণ্ডির মধ্যে যারা থাকে, তাদের কাছে সেই গণ্ডির বাইরেকার লোকালয় নিতান্ত ফিকে। তাদের সমস্ত বাঁধাবাঁধি জাত-রক্ষার বন্ধন। মুসলমান জাতে বাঁধা নয় বলে’ বাহিরের সংসারের সঙ্গে তার ব্যবহারের বাঁধাবাঁধি আছে। এই জন্যে আদব কায়দা মুসলমানের। আদব কায়দা হচ্চে সমস্ত মানুষের সঙ্গে ব্যবহারের সাধারণ নিয়ম। মনুতে পাওয়া যায় মা মাসী মামা পিসের সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করতে হবে, গুরুজনের গুরুত্বের মাত্রা কার কতদূর,—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের মধ্যে পরস্পরের ব্যবহার কিরকম হবে;—কিন্তু সাধারণভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার কিরকম হওয়া উচিত, তার বিধান নেই। এই জন্যে সম্পর্ক-বিচার ও জাতি-বিচারের বাইরে মানুষের সঙ্গে ভদ্রতা রক্ষার জন্যে, পশ্চিম ভারত, মুসলমানের কাছ থেকে সেলাম শিক্ষা করেচে। কেননা, প্রণাম নমস্কারের সমস্ত বিধি কেবল জাতের মধ্যেই খাটে। বাহিরের সংসারটাকে ইতিপূর্ব্বে আমরা অস্বীকার করে’ চলেছিলুম বলেই সাজসজ্জা সম্বন্ধে পরিচ্ছন্নতা, হয় আমরা মুসলমানের কাছ থেকে নিয়েছি, নয় ইংরাজের কাছ থেকে নিচ্চি। ওটাতে আমাদের আরাম নেই। সেই জন্যে ভদ্রতার সাজ সম্বন্ধে আজ পর্য্যন্ত আমাদের পাকাপাকি কিছুই ঠিক হল না। বাঙালী ভদ্রসভায় সাজসজ্জার যে এমন অদ্ভুত বৈচিত্র্য, তার কারণই এই। সব সাজই আমাদের সাজ। আমাদের নিজের সাজ, মণ্ডলীর ভিতরকার সাজ,―সুতরাং বাহিরের সংসারের হিসাবে সেটা বিবসন বল্লেই হয়, —অন্তঃপুরের মেয়েদের বসনটা যেরকম, অর্থাৎ দিগ্বসনের সুন্দর অনুকরণ। বাইরের লোকের সঙ্গে আমরা ভাই খুড়ো দিদি মাসী প্রভৃতি কোন-একটা সম্পর্ক পাবার জন্যে ব্যস্ত থাকি,―নইলে আমরা থই পাইনে। হয় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা, নয় অত্যন্ত দূরত্ব, এর মাঝখানে যে একটা প্রকাণ্ড জায়গা আছে, সেটা আজো আমাদের ভাল করে’ আয়ত্ত হয় নি। এমন কি, সেখানকার বিধিবন্ধনকে আমরা হৃদ্যতার অভাব বলে নিন্দা করি। এ কথা ভুলে যাই, যে-সব মানুষকে হৃদয় দিতে পারিনে, তাদেরও কিছু দেবার আছে। এই দানটাকে আমরা কৃত্রিম বলে’ গাল দিই, কিন্তু জাতের কৃত্রিম খাঁচার মধ্যে মানুষ বলেই এই সাধারণ আদবকায়দাকে আমাদের কৃত্রিম বলে’ ঠেকে। বস্তুত ঘরের মানুষকে আত্মীয় বলে’, এবং তার বাইরের মানুষকে আপন সমাজের বলে’, এবং তারো বাইরের মানুষকে মানব সমাজের বলে’ স্বীকার করা মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। হৃদয়ের বন্ধন, শিষ্টাচারের বন্ধন, এবং আদবকায়দার বন্ধন,— এই তিনই মানুষের প্রকৃতিগত।
কাপ্তেন বলে’ রেখেচেন, আজ সন্ধ্যাবেলায় ঝড় হবে, বারোমিটার নাবচে। কিন্তু শান্ত আকাশে সূর্য্য অস্ত গেল। বাতাসে যে-পরিমাণ বেগ থাক্লে তাকে মন্দ পবন বলে, অর্থাৎ যুবতীর মন্দ গমনের সঙ্গে কবিরা তুলনা করতে পারে,―এ তার চেয়ে বেশি; কিন্তু ঢেউগুলোকে নিয়ে রুদ্রতালের করতাল বাজাবার মত আসর জমেনি,—যেটুকু খোলের বোল দিচ্চে তাতে ঝড়ের গৌরচন্দ্রিকা বলেও মনে হয়নি। মনে করলুম মানুষের কুষ্ঠির মত, বাতাসের কুষ্ঠি গণনার সঙ্গে ঠিক মেলে না,—এ যাত্রা ঝড়ের ফাঁড়া কেটে গেল। তাই পাইলটের হাতে আমাদের ডাঙার চিঠিপত্র সমর্পণ করে’ দিয়ে প্রসন্ন সমুদ্রকে অভ্যর্থনা করবার জন্যে ডেক-চেয়ার টেনে নিয়ে পশ্চিমমুখো হয়ে বস্লুম।
হোলির রাত্রে হিন্দুস্থানী দরোয়ানদের খচমচির মত বাতাসের লয়টা ক্রমেই দ্রুত হয়ে উঠ্ল। জলের উপর সূর্য্যাস্তের আলপনা-আঁকা আসনটি আচ্ছন্ন করে’ নীলাম্বরীর ঘোমটা-পরা সন্ধ্যা এসে বস্ল। আকাশে তখনও মেঘ নেই, আকাশসমুদ্রের ফেনার মতই ছায়াপথ জ্বল্জ্বল্ করতে লাগল।
ডেকের উপর বিছানা করে’ যখন শুলুম, তখন বাতাসে এবং জলে বেশ একটা কবির লড়াই চল্চে,―একদিকে সোঁ সোঁ শব্দে তান লাগিয়েছে, আর একদিকে ছল্ ছল্ শব্দে জবাব দিচ্চে, কিন্তু ঝড়ের পালা বলে মনে হলনা। আকাশের তারাদের সঙ্গে চোখোচোখি করে’ কখন্ এক সময় চোখ বুজে এল।
রাত্রে স্বপ্ন দেখ্লুম আমি যেন মৃত্যু সম্বন্ধে কোন একটি বেদমন্ত্র আবৃত্তি করে সেইটে কাকে বুঝিয়ে বল্চি। আশ্চর্য্য তার রচনা, যেন একটা বিপুল আর্ত্তস্বরের মত, অথচ তার মধ্যে মরণের একটা বিরাট বৈরাগ্য আছে। এই মন্ত্রের মাঝখানে জেগে উঠে দেখি আকাশ এবং জল তখন উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। সমুদ্র চামুণ্ডার মত ফেনার জিব মেলে প্রচণ্ড অট্টহাস্যে নৃত্য করচে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘগুলো মরিয়া হয়ে উঠেচে, যেন তাদের কাণ্ডজ্ঞান নেই,―বল্চে, যা’ থাকে কপালে। আর জলে যে বিষম গর্জ্জন উঠ্ছে, তাতে মনের ভাবনাও যেন শোনা যায় না, এমনি বোধ হতে লাগ্ল। মাল্লারা ছোট ছোট লণ্ঠন হাতে ব্যস্ত হয়ে এদিকে ওদিকে চলাচল করচে,— কিন্তু নিঃশব্দে। মাঝে মাঝে এঞ্জিনের প্রতি কর্ণধারের সঙ্কেত-ঘণ্টাধবনি শোনা যাচ্চে।
এবার বিছানায় শুয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু বাইরে জলবাতাসের গর্জ্জন, আর আমার মনের মধ্যে সেই স্বপ্নলব্ধ মরণমন্ত্র ক্রমাগত বাজ্তে লাগল। আমার ঘুমের সঙ্গে জাগরণ ঠিক যেন ঐ ঝড় এবং ঢেউয়ের মতই এলোমেলো মাতামাতি করতে থাক্ল,—ঘুমচ্চি কি জেগে আছি বুঝতে পারচি নে।
রাগী মানুষ কথা কইতে না পারলে যেমন ফুলে ফুলে ওঠে, সকাল-বেলাকার মেঘগুলোকে তেমনি বোধ হল। বাতাস কেবলই শ ষ স, এবং জল কেবলি বাকি অন্ত্যস্থ বর্ণ য র ল ব হ নিয়ে চণ্ডীপাঠ বাধিয়ে দিলে, আর মেঘগুলো জটা দুলিয়ে ভ্রূকুটি করে বেড়াতে লাগল। অবশেষে মেঘের বাণী জলধারায় নেবে পড়ল। নারদের বীণাধ্বনিতে বিষ্ণু গঙ্গা-ধারায় বিগলিত হয়েছিলেন একবার, আমার সেই পৌরাণিক কথা মনে এসেছিল। কিন্তু এ কোন্ নারদ প্রলয়-বীণা বাজাচ্চে? এর সঙ্গে নন্দী ভৃঙ্গীর যে মিল দেখি, আর ওদিকে বিষ্ণুর সঙ্গে রুদ্রের প্রভেদ ঘুচে গেচে।
এপর্য্যন্ত জাহাজের নিত্যক্রিয়া এক রকম চলে যাচ্ছে, এমন কি আমাদের প্রাতরাশেরও ব্যাঘাত হল না। কাপ্তেনের মুখে কোনো উদ্বেগ নেই। তিনি বল্লেন এই সময়টাতে এমন একটু আধটু হয়ে থাকে;―আমরা যেমন যৌবনের চাঞ্চল্য দেখে বলে’ থাকি, ওটা বয়সের ধর্ম্ম।
ক্যাবিনের মধ্যে থাক্লে ঝুমঝুমির ভিতরকার কড়াইগুলোর মত নাড়া খেতে হবে তার চেয়ে খোলাখুলি ঝড়ের সঙ্গে মোকাবিলা করাই ভাল। আমরা শাল কম্বল মুড়ি দিয়ে জাহাজের ডেকের উপর গিয়েই বস্লুম। ঝড়ের ঝাপট পশ্চিম দিক থেকে আসছে, সেইজন্যে পূর্ব্বদিকের ডেকে বসা দুঃসাধ্য ছিল না।
ঝড় ক্রমেই বেড়ে চল্ল। মেঘের সঙ্গে ঢেউয়ের সঙ্গে কোনো ভেদ রইল না। সমুদ্রের সে নীল রং নেই,—চারিদিক ঝাপসা, বিবর্ণ। ছেলেবেলায় আরব্য উপন্যাসে পড়েছিলুম, জেলের জালে যে ঘড়া উঠেছিল তার ঢাকনা খুল্তেই তার ভিতর থেকে ধোঁয়ার মত পাকিয়ে পাকিয়ে প্রকাণ্ড দৈত্য বেরিয়ে পড়ল। আমার মনে হল, সমুদ্রের নীল ঢাকনাটা কে খুলে ফেলেচে, আর ভিতর থেকে ধোঁয়ার মত লাখো লাখো দৈত্য পরস্পর ঠেলাঠেলি কর্তে কর্তে আকাশে উঠে পড়চে।
জাপানী মল্লারা ছুটোছুটি করচে কিন্তু তাদের মুখে হাসি লেগেই আছে। তাদের ভাব দেখে মনে হয়, সমুদ্র যেন অট্টহাস্যে জাহাজটাকে ঠাট্টা করচে মাত্র;—পশ্চিম দিকের ডেকের দরজা প্রভৃতি সমস্ত বন্ধ, তবু সে সব বাধা ভেদ করে এক একবার জলের ঢেউ হুড়মুড় করে এসে পড়ছে, আর তাই দেখে ওরা হো হো করে উঠচে। কাপ্তেন আমাদের বারবার বল্লেন,― ছোট ঝড় সামান্য ঝড়। এক সময় আমাদের স্টুয়ার্ড এসে টেবিলের উপর আঙুল দিয়ে এঁকে ঝড়ের খাতিরে জাহাজের কিরকম পথ বদল হয়েচে, সেইটে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা কর্লে; ইতিমধ্যে বৃষ্টির ঝাপটা লেগে শাল কম্বল সমস্ত ভিজে শীতে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। আর কোথাও সুবিধা না দেখে কাপ্তেনের ঘরে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। কাপ্তেনের যে কোনো উৎকণ্ঠা আছে, বাইরে থেকে তার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলুম না।
ঘরে আর বসে থাক্তে পারলুম না। ভিজে শাল মুড়ি দিয়ে আবার বাইরে এসে বস্লুম! এত তুফানেও যে আমাদের ডেকের উপর আছড়ে আছড়ে ফেলচে না, তার কারণ জাহাজ আকণ্ঠ বোঝাই। ভিতরে যার পদার্থ নেই তার মত দোলায়িত অবস্থা আমাদের জাহাজের নয়। মৃত্যুর কথা অনেকবার মনে হল। চারিদিকেই ত মৃত্যু, দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্য্যন্ত মৃত্যু—আমার প্রাণ এর মধ্যে এতটুকু। এই অতি ছোটটার উপরেই কি সমস্ত আস্থা রাখব, আর এই এত সড়টাকে কিছু বিশ্বাস করব না?―বড়র উপরে ভরসা রাখাই ভাল।
ডেকে বসে থাকা আর চল্চে না। নীচে নাবতে গিয়ে দেখি সিঁড়ি পর্য্যন্ত জুড়ে সমস্ত রাস্তা ঠেসে ভর্ত্তি করে ডেক্-প্যাসেঞ্জার বসে। বহু কষ্টে তাদের ভিতর দিয়ে পথ করে ক্যাবিনের মধ্যে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। এইবার সমস্ত শরীর মন ঘুলিয়ে উঠ্ল। মনে হল দেহের সঙ্গে প্রাণের আর বন্তি হচ্চে না; দুধ মথন করলে মাখনটা যে রকম ছিন্ন হয়ে আসে প্রাণটা যেন তেমনি হয়ে এসেছে। জাহাজের উপরকার দোলা সহ্য করা যায়, জাহাজের ভিতরকার দোলা সহ্য করা শক্ত। কাঁকরের উপর দিয়ে চলা, আর জুতার ভিতরে কাঁকর নিয়ে চলার যে তফাৎ, এ যেন তেমনি। একটাতে মার আছে বন্ধন নেই, আর একটাতে বেঁধে মার।
ক্যাবিনে শুয়ে শুয়ে শুন্তে পেলুম ডেকের উপর কি যেন হুড়মুড় করে ভেঙে ভেঙে পড়চে। ক্যাবিনের মধ্যে হাওয়া আসবার জন্যে যে ফানেলগুলো ডেকের উপর হাঁ করে নিশ্বাস নেয়, ঢাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে,― কিন্তু ঢেউয়ের প্রবল চোটে তার ভিতর দিয়েও ঝলকে ঝলকে ক্যাবিনের মধ্যে জল এসে পড়চে। বাইরে উনপঞ্চাশ বায়ুর নৃত্য, অথচ ক্যাবিনের মধ্যে গুমট। একটা ইলেকট্রিক পাখা চল্চে তাতে তাপটা যেন গায়ের উপর ঘুরে ঘুরে লেজের ঝাপটা দিতে লাগ্ল।
হঠাৎ মনে হয় এ একেবারে অসহ্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে শরীর মন প্রাণের চেয়েও বড় একটা সত্তা আছে। ঝড়ের আকাশের উপরেও যেমন শান্ত আকাশ, তুফানের সমুদ্রের নীচে যেমন শান্ত সমুদ্র—সেই আকাশ সেই সমুদ্রই যেমন বড়, মানুষের অন্তরের গভীরে এবং সমুচ্চে সেইরকম একটি বিরাট শান্ত পুরুষ আছে—বিপদ এবং দুঃখের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখ্লে তাকে পাওয়া যায়—দুঃখ তার পায়ের তলায়, মৃত্যু, তাকে স্পর্শ করে না।
সন্ধ্যার সময় ঝড় থেমে গেল। উপরে গিয়ে দেখি জাহাজটা সমুদ্রের কাছে এতক্ষণ ধরে যে চড় চাপড় খেয়েচে, তার অনেক চিহ্ন আছে। কাপ্তেনের ঘরের একটা প্রাচীর ভেঙে গিয়ে তাঁর আসবাবপত্র সমস্ত ভিজে গেছে। একটা বাঁধা লাইফ্-বোট জখম হয়েছে। ডেকে প্যাসেঞ্জারদের একটা ঘর এবং ভাণ্ডারের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। জাপানী মাল্লারা এমন সকল কাজে প্রবৃত্ত ছিল যাতে প্রাণ সংশয় ছিল। জাহাজ যে বরাবর আসন্ন সঙ্কটের সঙ্গে লড়াই করেছে, তার একটা স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল—জাহাজের ডেকের উপর কর্কের তৈরি সাঁতার দেবার জামাগুলো সাজানো। এক সময়ে এগুলো বের করবার কথা কাপ্তেনের মনে এসেছিল।―কিন্তু ঝড়ের পালার মধ্যে সব চেয়ে স্পষ্ট করে’ আমার মনে পড়ছে জাপানী মাল্লাদের হাসি।
শনিবার দিনে আকাশ প্রসন্ন কিন্তু সমুদ্রের আক্ষেপ এখনাে ঘােচে নি। আশ্চর্য্য এই, ঝড়ের সময় জাহাজ এমন দোলে নি, ঝড়ের পর যেমন তার দোলা। কালকেকার উৎপাতকে কিছুতেই যেন সে ক্ষমা করতে পারচে না, ক্রমাগতই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে। শরীরের অবস্থাটাও অনেকটা সেই রকম,—ঝড়ের সময় সে একরকম শক্ত ছিল, কিন্তু পরের দিন ভুল্তে পার্চে না তার উপর দিয়ে ঝড় গিয়েছে।
আজ রবিবার। জলের রং ফিকে হয়ে উঠেছে। এতদিন পরে আকাশে একটি পাখী দেখ্তে পেলুম— এই পাখীগুলিই পৃথিবীর বাণী আকাশে বহন করে নিয়ে যায়— আকাশ দেয় তার আলাে, পৃথিবী দেয় তার গান। সমুদ্রের যা’-কিছু গান সে কেবল তার নিজের ঢেউয়ের—তার কোলে জীব আছে যথেষ্ট, পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু তাদের কারাে কণ্ঠে সুর নেই—সেই অসংখ্য বােবা জীবের হয়ে সমুদ্র নিজেই কথা কচ্চে। ডাঙার জীবেরা প্রধানত শব্দের দ্বারাই মনের ভাব প্রকাশ করে, জলচরদের ভাষা হচ্চে গতি। সমুদ্র হচ্চে নৃত্যলােক, আর পৃথিবী হচ্চে শব্দলােক।
আজ বিকেলে চারটে পাঁচটার সময় রেঙ্গুনে পৌঁছবার কথা। মঙ্গলবার থেকে শনিবার পর্য্যন্ত পৃথিবীতে নানা খবর চলাচল করছিল, আমাদের জন্যে সেগুলো সমস্ত জমে রয়েছে;— বাণিজ্যের ধনের মত নয় প্রতিদিন যার হিসাব চল্চে; কোম্পানির কাগজের মত, অগােচরে যার সুদ জম্চে।
২৪শে বৈশাখ, ১৩২৩।